ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫ | ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

আবদুল গফুর একজন নিরেট জ্ঞানতাপস

Daily Inqilab ড. মুসাফির নজরুল

১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় আমার যাওয়া-আসা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে। আমি তখন অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। সে সময় ফিচার বিভাগের শেষ মাথায় কাঁচ ঘেরা একটি কক্ষে অতিশয় এক ভদ্রলোককে দেখা যেতো সবসময়ই মাথা নিচু করে লিখছেন। তেমন কোনো আড্ডা ছিলো না তাঁর কক্ষে। প্রায় প্রতিদিনই যেতাম পত্রিকা অফিসে। কক্ষের বাইরের টেবিলেই বসতেন কবি ও সাহিত্যিক হাসনাইন ইমতিয়াজ। অনেকটা অসুস্থ শরীর তাঁর। একটু দূরেই বসতেন সাহিত্য পাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত কবি ফাহিম ফিরোজ। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই নজরুল ইসলাম মিশা পাঠিয়েছিলেন তাঁর কাছে। উদ্দেশ্য ছিলো অমর একুশে গ্রন্থমেলার উপর ফিচার লেখা।

কয়েকদিনের মাথায় কবি ফাহিম ফিরোজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘অনুবাদ করতে পারবা?’ আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে বললামÑ ‘পারবো।’ আমার যোগ্যতা হিসেবে জানালামÑ ‘আমি উইলস্ লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াই।’ যে কথা সেই কাজ, কবি ফাহিম ফিরোজ আমাকে বললেন- ‘ওই যে ভিতরের রুমে একজন বসে আছেন, উনার নাম অধ্যাপক আবদুল গফুর, ফিচার এডিটর, তুমি সালাম দিয়ে স্যারের ওখানে থাকা ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার একটি বান্ডিল নিয়ে এসো। ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় সাহিত্য বিষয়ক অনেক লেখা আছে, সেখান থেকে অনুবাদ করবা।’ আমি আস্তে করে স্যারের রুমে ঢুকলাম এবং সালাম দিয়ে আমার প্রবেশের কারণ জানালাম, স্যার মাথাটা একটু উঁচু করে বললেন, ‘ওই তাকে রাখা আছে, ওখান থেকে নিয়ে যাও।’

আমি এক বা-িল ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা নিয়ে ফাহিম ভাইয়ের পাশের টেবিলে রেখে একটা একটা করে দেখতে লাগলাম, বেশ কয়েকদিনের পত্রিকা দেখার পর নামেচেনা একজন লেখকের উপর একটি বিশাল আর্টিকেল দেখতে পেলাম। আমি পত্রিকাটি নিয়ে ফাহিম ভাইকে দেখালাম, তিনি বললেন, ‘বুধবার রাত ১১ টা পর্যন্ত তোমার সময়। এরমধ্যে অনুবাদটি দিতে হবে।’ সেদিন ছিলো সোমবার। আমি অনেকটা আবেগেই বললামÑ ‘আচ্ছা’। এরপর পত্রিকার বাকি পত্রিকাগুলোর বান্ডিলটা আবারও ভালোভাবে বেঁধে তাকের সেই জায়গাতেই রাখলাম। আসার সময় আবারও গফুর স্যারকে ‘আসি’- বলে বিদায় নেওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম। তখন স্যার স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পেয়েছো?’ আমি বললাম, ‘জ্বি স্যার’Ñ বলে সেদিনের মতো বের হয়ে এলাম।

বাসায় এসেই সবকিছু বাদ দিয়ে শুরু করলাম অনুবাদের কাজ। জীবনের প্রথম অনুবাদ। সময় দুই-দিন এক-রাত। খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। তবুও খুবই সুক্ষ্মভাবে অনুবাদের কাজ শেষ করে বেঁধে দেওয়া সময় বুধবার রাত এগারোটার আগেই লেখা নিয়ে উপস্থিত হলাম ফাহিম ভাইয়ের সামনে। তিনি কিছুটা অবাক হলেন। সব কাজ বাদ দিয়ে পুরো লেখাটি পড়লেন। আমি ভীষণ ভয়ে ছিলাম, কারণ এর আগে কখনো আর্টিকেল অনুবাদ করিনি। ফাহিম ভাই বললেন, ‘অসাধারণ হয়েছে’। দু’দিন পর শুক্রবার সকালেই হকারের কাছ থেকে পত্রিকাটি নিয়ে দেখি ‘উইলিয়াম ফকনার : তাঁর সাহিত্য’ শিরোনামে এক বিশাল লিড লেখা আমার নামে ছাপা হয়েছে। এটিই জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আমার জীবনের প্রথম অনুবাদ। সে এক অন্যরকম আনন্দ, অন্যরকম অনুভূতি। আর ইনকিলাব পত্রিকা তখন ঢাকার প্রায় ঘরে ঘরে। কয়েকদিন পরে পত্রিকা অফিসে গিয়ে গফুর স্যারের সঙ্গে দেখ করতেই তিনি অনেক প্রশংসা করলেন অনুবাদটির। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। বললেনÑ ‘এতো অল্প বয়সে তুমি এতো ভালো অনুবাদ করলে কিভাবে?’ আমিও স্যারকে জানালাম, ‘স্যার আমি উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াই, তাই অনুবাদ করা সম্ভব হয়েছে।

এরপর থেকে দৈনিক ইনকিলাকে নিয়মিত যাওয়া আসার সুবাদে গফুর স্যারের সঙ্গে কথা হতো প্রায়ই। আস্তে আস্তে ব্যক্তিগত পরিচয় পর্বও শেষ করেন স্যার। আমার উপজেলাতে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে বলেও তিনি জানান, তাদের বিষয়ে প্রায়ই খোঁজ-খবরও নিতেন। আমিও স্যারের বিষয়ে খোঁজখবর নিতাম। একপর্যায়ে জানতে পারলাম স্যার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমুদ্দিন মজলিশ’ গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অন্যতম। মহান ভাষা আন্দোলনে অন্যতম অগ্রসৈনিক ছিলেন তিনি। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৫ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন।

গফুর স্যারের অনুপ্রেরণায় দৈনিক ইনকিলাবে অর্ধ-শতাধিক ফিচার ও কবিতার অনুবাদ ছাপা হয়েছে আমার। এরমধ্যে ‘উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ কি ওয়ার্থ গুপ্তচর ছিলেন?’, বিটিশ রাজকবি টেড হিউজের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে তাঁর উত্তর রাজকবি এন্ডুমোশানের লেখা বাহাত্তর লাইনের দীর্ঘ কবিতা ‘টেড হিউজের স্মরণে’, ‘হ্যারল্ড রবিনস্ : আমি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক’, ‘সিএফ আলেকজেন্ডারের কবিতা’, ‘জন অরভিং : শ্রেষ্ঠ কমিডি লেখক’, ‘জুলিয়ান বার্নেস : তাঁর আগ্নেয় উপন্যাস’, ‘ছয়জন সাহিত্যিক গুপ্তচর’, ‘জন পাওয়েজ প্রতিভায় টলস্টয়ের কাছাকাছি’, ‘ক্রিস্টা ওলফ্ : বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক’, ‘স্টিফেন কিং : ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক’, ‘জন লি কেরী : একজন সফল কথাসাহিত্যিক’, ‘টি.এস এলিয়টের কবিতা’, ‘ডোনাল্ড জাস্টিস : জীবন ও সাহিত্যকর্ম’, ‘আলফ্রেড টেনিসন-এর কবিতা’, ‘জন ডান-এর কবিতা’ প্রভৃতি। প্রতিটি লেখাতেই গফুর স্যার অকৃত্রিম উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাতেন।

‘আমার কালের কথা’ শিরোনামে গফুর স্যারের আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা একসময় দৈনিক ইনকিলাবের সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকা হাতে পেয়েই লেখাটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক সিটিংয়েই পড়ে ফেলতাম। কারণ, তাঁর এ লেখায় দেশবিভাগ, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি সময়ের এদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। এ লেখা পড়তে গিয়ে মনে হতো আমিও সেই কালের যাবতীয় বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী। গভীর চিন্তনশক্তি ও সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ ছিলো লেখাগুলো। এক সংখ্যার লেখা পড়ার পর পরবর্তী সংখ্যার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতাম।
কলেজ শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে ২০০১ সালে মাগুরায় চলে আসার পর থেকে স্যারের সঙ্গে সেই প্রতিদিনের দেখা আর হতো না। তবে যতবার ঢকায় গিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে গিয়েছি, ততবার স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অনেক। বিশেষ করে তিনি আমার এম.ফিল ও পিএইচ.ডির থিসিসের বিষয়ে প্রায়শই খোঁজ-খবর নিতেন। এম.ফিলে ‘বিভাগোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে প্রতিফলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা’ এবং পিএইচ.ডিতে ‘মানিক বেন্দ্যাপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রতিফলিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বরূপ’Ñ দু’টি বিষয়ই তাঁর পছন্দ হয়েছিলো। (অসমাপ্ত)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
জুলাইবিপ্লবের রক্তাক্ত দলিল
অপেক্ষার শেষ রাত
সত্য, সুন্দর ও মুক্তি
কবিতা
আরও
X

আরও পড়ুন

এবার দিল্লির হোটেলে ব্রিটিশ নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

এবার দিল্লির হোটেলে ব্রিটিশ নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

মেহেরপুর জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসের মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি

মেহেরপুর জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসের মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি

পদ্মা নদীতে বালু কাটা বাংলা ড্রেজিংসহ ১ জন  গ্রেফতার

পদ্মা নদীতে বালু কাটা বাংলা ড্রেজিংসহ ১ জন  গ্রেফতার

ভারতে মাইক ব্যবহারে বাধা, মুখেই সেহরির জন্য ডাকছেন ঈমাম সাহেব! ভিডিও ভাইরাল

ভারতে মাইক ব্যবহারে বাধা, মুখেই সেহরির জন্য ডাকছেন ঈমাম সাহেব! ভিডিও ভাইরাল

প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা পাবেন ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা

প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা পাবেন ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা

শুক্রবার হোলি উৎসব ভারতে, বহু মসজিদে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে জুমার নামাজ

শুক্রবার হোলি উৎসব ভারতে, বহু মসজিদে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে জুমার নামাজ

আদালত চত্বর থেকে পালিয়ে যাওয়া ধর্ষণ মামলার আসামি ফের গ্রেপ্তার

আদালত চত্বর থেকে পালিয়ে যাওয়া ধর্ষণ মামলার আসামি ফের গ্রেপ্তার

সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

ভারতে অবৈধ অভিবাসন রোধে কঠোর প্রস্তাব, অনুপ্রবেশ করলে ৫ বছর কারাদণ্ড

ভারতে অবৈধ অভিবাসন রোধে কঠোর প্রস্তাব, অনুপ্রবেশ করলে ৫ বছর কারাদণ্ড

উত্তরপত্রসহ ছাত্রীকে প্রশ্ন সরবারহের অভিযোগ কুবি শিক্ষক কাজী আনিছের বিরুদ্ধে

উত্তরপত্রসহ ছাত্রীকে প্রশ্ন সরবারহের অভিযোগ কুবি শিক্ষক কাজী আনিছের বিরুদ্ধে

বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের ঋণমান কমিয়েছে মুডিস

বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের ঋণমান কমিয়েছে মুডিস

সঙ্গীতে আসিফের হাত ধরে দ্যুতি ছড়াবেন জ্যোতি

সঙ্গীতে আসিফের হাত ধরে দ্যুতি ছড়াবেন জ্যোতি

রোজা না রাখায় কান ধরে ওঠবস করানো লক্ষীপুরের সেই নেতার প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা

রোজা না রাখায় কান ধরে ওঠবস করানো লক্ষীপুরের সেই নেতার প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা

মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার : প্রধান উপদেষ্টা

মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার : প্রধান উপদেষ্টা

ইফতারে তরমুজ খাওয়ার উপকারিতা

ইফতারে তরমুজ খাওয়ার উপকারিতা

বাংলাদেশিদের জন্য ওমরাহ ভিসা কমিয়েছে সউদী আরব

বাংলাদেশিদের জন্য ওমরাহ ভিসা কমিয়েছে সউদী আরব

অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব আশুলিয়ার ৬ পোশাক শ্রমিকের পাশে দাঁড়ালেন শ্রমিক নেতা

অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব আশুলিয়ার ৬ পোশাক শ্রমিকের পাশে দাঁড়ালেন শ্রমিক নেতা

‘ডেমন সিটি' নিয়ে কেন এতটা মাতামাতি জাপানে?

‘ডেমন সিটি' নিয়ে কেন এতটা মাতামাতি জাপানে?

মাগুরার শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন, দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা

মাগুরার শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন, দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা

আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে আর কোনো আলাপ নয়, ফুলস্টপ: হাসনাত

আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে আর কোনো আলাপ নয়, ফুলস্টপ: হাসনাত