ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর
১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
বিশিষ্ট ভাষা-সৈনিক, প্রবীণ লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আবদুল গফুরের জন্ম ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৯ সালে। তিনি ফরিদপুর জেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের হাজী হাবিল উদ্দিন মুন্সী ও শুকুরুন্নেছা খাতুনের গৌরবময় সন্তান। তার শিক্ষাজীবন পাড়ার মক্তব থেকে শুরু করে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে বের হওয়া অবধি সকল ফলাফল ছিল কৃতিত্বের সাথে। ফরিদপুর জেলার কৃতি এই সন্তান ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র দু’মাস আগে ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের তমদ্দুন মজলিসের কাজে নিরলস কর্মী হিসাবে আত্মনিয়োগ করায় সেই ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি আর অংশগ্রহণ করতে পারেননি। যদিও তিনি পরবর্তী সময় ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ইংরেজি বিভাগে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। অত্যন্ত মেধা ও প্রজ্ঞাশীল এই রাজনৈতিক কর্মী ৯৬ বছরের সংগ্রামী জীবনের কোনো পর্যায়েই অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াননি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সূচক আন্দোলন। এই আন্দোলনের জের ধরে ৬২, ৬৯-এর আন্দোলন অতিবাহিত করে আসে কাঙ্খিত ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফলস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ। অধ্যাপক আবদুল গফুর ভাষা আন্দোলনের নেতা ও সংগঠকের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত সৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও পরবর্তীতে সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আজন্ম সাংবাদিক। সাংবাদিকতা তার নেশা। দৈনিক ইনকিলাবের সূচনা (১৯৮৬) থেকে মৃত্যু অবধি ফিচার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অবশ্য তার কর্মজীবন শুরুই হয়েছিল সাংবাদিকতার মাধ্যমে। জীবনের শেষ পর্যায়েও তিনি সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শুরুটা ১৯৪৭ সালে পাক্ষিক জিন্দেগী-তে। ১৯৪৮-১৯৫৬ পর্যন্ত সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সহ-সম্পাদক ও সম্পাদক, এরপর যথাক্রমে দৈনিক মিল্লাত (১৯৫৭) ও দৈনিক নাজাত (১৯৫৮) এর সহকারী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে দৈনিক আজাদ এর বার্তা সম্পাদক, দৈনিক পিপল (১৯৭২-৭৫) এর সহকারী সম্পাদক, দৈনিক দেশ (১৯৭৯-৮০) এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা ও ফরিদপুর কলেজে ১৪ বছর অধ্যাপনা করেছেন। প্রখর মেধাবী, নিরহংকারী, স্বল্পভাষী সাহসী এই দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও এর শ্রীবৃদ্ধির জন্য। স্বদেশ ও স্বজাতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্তেও তিনি একজন লড়াকু সৈনিক। অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন প্রকৃত ভাষা সৈনিক ও স্বাধীনতাযোদ্ধা। অত্যন্ত সৎ, আদর্শবান এবং সুশৃংখল জীবনের অধিকারী এই সদালাপী কখনো সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। এমনটা হলে হয়ত তাকে এভাবে অভাব অনটন, চিকিৎসাহীনে জীবন অতিবাহিত করতে হত না। গুণীর কদর এ দেশ কখনো করেনি। বিশেষ করে স্বৈরাচার-লেজুড়ভিত্তিক সরকারের অজানা ছিল না তার এই দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত হওয়ার কথা। তবুও উপযুক্ত সহায়তা তিনি পাননি। সাহিত্য বিশারদ অধ্যাপক আবদুল গফুর বাংলা ও ইংরেজিতে বহু গ্রন্থ লিখে গেছেন। তার গদ্যশৈলী ও ভাষার সরলতা তাকে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে আখ্যায়িত করে। তিনি একাধারে প্রবন্ধ, শিশুতোষ, আত্মজীবনীসহ ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং ইসলাম ও সমসাময়িক বিশ্ব পরিক্রমায় রাজনৈতিক গ্রন্থ লিখেছেন। তবে বিশেষ করে ইসলামিক চিন্তক এই লেখক আজন্ম ইসলামি শাসন ব্যবস্থার আকাঙ্খা করেছেন। শ্বাশত ও ন্যায়ের পক্ষ থেকে সত্য তুলে ধরেছেন নির্ভয়ে। তার লেখায় সেসব স্পষ্ট। ইসলামিক সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে কোরআনি সমাজের রূপরেখা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী উমর, ইসলামের জীবনদৃষ্টি, কর্মবীর সোলায়মান, ইসলাম কি এ যুগে অচল, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, শাশ্বত নবী, পাকিস্তানে ইসলামী আন্দোলন, খোদার রাজ্য উল্লেখযোগ্য। শিশুতোষ গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছেথথ ভাষা নিয়ে লড়াই, আসমান জমিনের মালিক, খোদার রাজ্য, স্বাধীনতার গল্প শোনো।রাজনৈতিকসমূহেথ সমাজকল্যাণ পরিক্রমা, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এছাড়াও তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আমার কালের কথা উল্লেখযোগ্য। তার ইংরেজি গ্রন্থ ঝড়পরধষ ডবষভধৎব, ঝড়পরধষ ঝবৎারপবং সাড়া জাগানো।
অধ্যাপক আবদুল গফুর জীবনভর সাহিত্য-সংস্কৃতির একজন একনিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন। মূলত দৈনিক ইনকিলাব তার সূতিকাগার। সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই পত্রিকার রেশ ধরে বহু লেখকের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন করেছেন তেমনি নতুন সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকদের সহায়তা করে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন।
ভাষাসংগ্রাম, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক আবদুল গফুর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে একুশে পদক (২০০৫) উল্লেখযোগ্য। জাতির অভিভাবকস্বরূপ অধ্যাপক আবদুল গফুর বৈষম্যহীন, শোষণহীন ও কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কেননা তিনি সারাজীবন বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন। জীবনের শেষ সময়ে তাকে যথেষ্ট আর্থিক সংকটে ভুগতে হয়েছে যেখানে তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম সূতিকাগারের নেতা ছিলেন সেখানে বার্ধ্যকে এসেও তাকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে। সর্বোপরি তার মর্যাদা, সম্মান ও দুর্দিনে সহায়তা না পাওয়া কতটা কষ্টের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা এখন সময়ের দাবি। ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি অকুতোভয় সৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী এই মহান নেতা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে পরলোকগমন করেন। এ দেশ যতদিন বেঁচে থাকবে এ জাতি ততদিন শ্রদ্ধা ভরে তাকে স্মরণ করবে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের
গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা
রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি
বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার
লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭
প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু
কী আছে তৌফিকার লকারে?
ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা
অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা
শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা
৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি
৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ