রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১০ এএম
মনে হয় একদিন কাক জ্যোৎস্নায় তুমিও দরোজা খুলে ফিরে আসবে..ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এই উক্তি করেছিলেন তা কেবল কবি নিজেই জানেন। তবে আমি এই উক্তির সার্থকতা খুঁজে পাই কিছুটা ভিন্ন মাত্রায়। এই যেমন কবির অকালমৃত্যু সত্ত্বেও তারুণ্য ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে বারবার তিনি আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসেন, ফিরে ফিরে আসবেন। আমরাও ক্ষণজন্মা এই কিংবদন্তির কবিতা পাঠে সমৃদ্ধ হই। কবির জীবন দর্শন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আমরাও ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহি:প্রকাশ ঘটাই। কবির জীবন থেকে বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিজেরা শিক্ষিত হই।
তারুণ্য ও সংগ্রামের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রি: তৎকালীন বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জ রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি বর্তমান বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার সাহেবের মেঠ গ্রামে। তার বাবার নাম ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। তিনি মুলত একজন বাংলাদেশী কবি ও গীতিকার। তাঁর জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম “বাতাসে লাশের গন্ধ”। কবির স্মরণে বাগেরহাট জেলার মোংলার মিঠাখালীতে গড়ে উঠেছে “রুদ্র স্মৃতি সংসদ”।
শৈশব থেকেই সাহিত্যের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করতেন কবি রুদ্র। তার ছোটকালের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বোনের ট্র্যাংক থেকে তিনি ও তার মামাতো ভাইয়েরা মিলে টাকা ধার করেন। অবশ্য কারো কারো মতে, চুরি করেন। কথা ছিল সেই টাকা দিয়ে তারা সিনেমা দেখতে যাবেন। কিন্তু কবি রুদ্র বলে কথা! ভাবলেন এক, কিন্তু করলেন আরেক। সেই টাকা দিয়ে তারা একটি লাইব্রেরি তৈরি করলেন। সেই লাইব্রেরির নাম দেয়া হয় বনফুল লাইব্রেরি। এছাড়া ছোটবেলায় রুদ্র অনেক অভিমানীও ছিলেন। একটা ঘটনা থেকে তা আঁচ করা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি তার স্কুলের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। আবার একই স্কুলের পরিচালনা পরিষদে ছিলেন তার বাবা। নিজের ছেলেকে প্রথম স্থানের পুরস্কার দেয়াটা তিনি সমীচীন মনে করেননি। তিনি ভেবেছিলেন সেটা স্বজনপ্রীতি হতে পারে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি অবশ্য অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন তার ছেলেকে। কিন্তু অভিমানী রুদ্র তার বাবার দেয়া সব বই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । অবশ্য যৌবনে রুদ্র ছিলেন প্রাণবন্ত এবং কিছুটা উচ্ছন্ন। খেয়ালীপনা তার মধ্যে ছিল না বললেই চলে। তার চুল ছিল কোকড়ানো। মুখে ছিল খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। জিন্স পরতেন প্রায় সময়ই। আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অনেক মনোযোগী থাকতেন। একদা তার এই অস্থিরভাব নিয়ে কবি শামসুল হক বলেছিলেন, “তার মধ্যে যে বাউন্ডুলেপনা ছিল তা তাকে সুস্থির হতে দেয়নি।”
ছাত্র হিসেবে তিনি বরাবরই মেধাবী ছিলেন। ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করেন। চার বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচ এস সি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নেন। এজন্যই তিনি প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত পান। কবি তার অবরোধ চারদিকে” কবিতায় লিখেন, তুমি কোথায় পালিয়ে যাবে?/সারাক্ষণ ছায়ার মতো সাথে-সাথে ঘুরবে ঘাতক,/অনুশোচনার কালো এক কুকুর/তোমায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে ফিরবে/তুমি কোথায় পালিয়ে যাবে!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। নিজ কণ্ঠে কবিতার আবৃত্তিতে যে কজন কবি খ্যাতিমান হন; তিনি তাদের অন্যতম। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং “ভালো আছি ভালো থেকো”সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগ্রন্থ যথাক্রমে- উপদ্রুত উপকূল, ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম, মানুষের মানচিত্র, ছোবল, গল্প, দিয়েছিলে সকল আকাশ, মৌলিক মুখোশ, খুটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা, একগ্লাস অন্ধকার ইত্যাদি। তিনি মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার এবং একুশে পদক (২০২৪, মরণোত্তর) লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে কবি ছিলেন বহুল আলোচিত সমালোচিত তসলিমা নাসরিনের স্বামী। অবশ্য বেশিদিন তাদের সংসার টিকেনি। আমার কাছে মনে হয়, তসলিমা নাসরিনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ কবির বিশাল মনোপীড়ার কারণ হয়। যা তার বিভিন্ন কবিতায় স্পষ্ট হয়। এই যেমন: ‘তুমি বরং কুকুর পোষো’ কবিতায় তিনি বলেছেন, লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো/শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়/কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।/ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,/তুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো/ উংক পাবে, জলও পাবে।/চুল ভেজারও তেমন কোন আশঙ্কা নেই,/ইচ্ছেমত যেমন খুশি নাইতে পারো।’
বিচ্ছেদের পর তিনি আরো মুক্ত এবং বেপরোয়া জীবন যাপন করতে শুরু করেন। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম করতেন। নিজের শরীরের যতœ নিতেন না। ফলে তার পাকস্থলিতে গভীর ক্ষতসহ তার শরীরে আরও নানান উপসর্গ দেখা দেয়। ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে তিনি মারা যান এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠাখালি মামার বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। অনন্ত যাত্রার পরেও কবি যেন তার কবিতার মাধ্যমে এখনও আমাদের সাথে কথা বলেন। পরস্পর ভাব বিনিময় করেন। ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় কবির তারুণ্যদীপ্ত উচ্চারণ- ‘এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো,/ জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর।/ আজ তারা আলোহীন খাঁচা/ ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।/ এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,/ স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম?/ একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?/ জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।’
প্রিয়কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র তারুণ্য ও সংগ্রাম আমাদের জন্য নগদ অনুপ্রেরণার উৎস। সকল প্রকার অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। ‘কবিতার নির্বাসন চাই”... কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘নিয়মিত দৈনিকের পাতায় পাতায়/ বিবিধ সংবাদ ছাপা হয় এখনো এবং হবে,/বাঁচার ইচ্ছায় ঘুন পোক ধরে/ জনতার শ্লোগান তাই গদ্য চাই,/ কবিতা নয়
কাজেই রবীন্দ্রনাথ নির্বাসনে যাও/ সুকান্ত ফিরে এসো পুনশ্চ।/ কবিতারা নির্বাসনে যাও/ কবিরা গদ্য লিখুক, গান নাটক।/ কবিতায় জীবন চাই, খাদ্যাভাব/ সঠিক মনন ও মানুষ, ছায়া নয়/ নচেৎ তুমুল চিৎকারে বলি
কবিতার নির্বাসন চাই/ আমরণ নির্বাসন....কবির জীবন দর্শন এবং বাস্তববাদিতার এ যেন এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আজ ষোল অক্টোবর প্রিয়কবির শুভ জন্মদিন। জন্মদিনে কবির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ২ কমিটি গঠন
কনস্টাসকে ধাক্কা দেওয়ার শাস্তি পেলেন কোহলি
আটঘরিয়ায় ফসলী জমিতে চলছে পুকুর খনন আশঙ্কাজনক হারে কমছে জমি
পাইকগাছায় অসুস্থ গরীবদের জন্য জিয়া প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারের দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
কেশবপুর উপজেলা মৎসলীগের সভাপতি ও সুফলাকাঠী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম মুনজুর রহমান ডিবি পুলিশের হাতে আটক
মাদারীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদ্রাসার শিক্ষকের প্রান গেল
বিদেশি নাগরিকদের বৈধতা অর্জনের সময়সীমা বেঁধে দিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
কুলাউড়ায় মোবাইল চুরির অপবাদ সইতে না পেরে যুবকের আত্মহত্যা
মাদারীপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের মানববন্ধন
তারাকান্দায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত-৬
আওয়ামীলীগ লাশের ওপর নৃত্য করে ফ্যাসিস্ট ইতিহাস তৈরি করেছিল : ড. রেজাউল করিম
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নীলফামারী ছাড়লেন আসিফ মাহমুদ
ডিমলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া
কচুয়ার একাধিক মামলার আসামি বাবু দুমকীতে গ্রেফতার
পূর্বাচলের সরকারি প্লটে অনিয়ম: হাসিনা-রেহানার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
ধামরাইয়ে ২ সন্তানের জননীর আত্মহত্যা স্বামী আটক
দৌলতদিয়ায় বয়স্ক যৌনকর্মীদের শীতবস্ত্র ও শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
যারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত: বদিউল আলম
নাচোল পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মুসা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত