যৌতুক
২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
রূপসী বাংলার যশোর জেলার ঝিকরগাছার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের চির সবুজে ঘেরা গাঁ নারাংগালী। সে গাঁয়েরই এক বর্গাচাষী নাম ‘ধনী’। তারই উঠতি বয়সী বারো তেরো বছরের কৃষ্ণ বরণ কিশোরী এক মেয়ে ‘চৈতী’। যার দেহের রঙটা কালো। কিন্তু দেহের রঙ কালো হলে কি হবে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট বেলুনে বলা দেহের গড়ন তার। মুখশ্রীও বেশ গোলগাল আকর্ষণীয়। আর মুক্তার মত গালে ঝকঝকে সারি বাঁধানো দাঁত। হাস্যউজ্জ্বল, চঞ্চলা, দূরান্তমনার এক বালিকা। সারাদিন যার এ গাছে ও গাছে চড়ে বেড়ানো আর গায়ের সারা পাড়া ঘুরে দাপিয়ে বেড়ানো অভ্যাস। সে গুনগুন করে গান গাই। আর তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে এ গাছের ফল ও গাছের ফল পেড়ে খায় আর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। গাঁয়ে চলার মেঠো পথে যখন যার সাথে দেখা হয় সে হেসে বলে কি দাদু ভালো তো? কি দাদী ভালো আছ ? চাচা কেমন আছ? চাচী তোমার শরীর কেমন আছে? কিরে ছোট ? কিরে পিচ্চি ভালো আছিস? এভাবে হেসে হেসে সকলের সাথে সে কথা বলে। কখনো কেউ তার মুখে দুঃখের কালো
মেঘ দেখতে পাইনা। গাঁয়ের লোকজন কমবেশি সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। তবে কোন কোন হিংসুটে পুরুষ মহিলারা আবার হিংসাও করে।
সত্যি বলতে....
এই সমাজে ভালো মানুষের বড় অভাব....
আর কুচক্রী নিন্দে ভর্ৎসনা করাটাই যেনো স্বভাব।
এমন বহু মানুষ আছে....
যারা অপরের হাসি মুখ, সুখ সৈহ্য করতে পারেনা।
কিন্তু কারোর চোখে জল দুঃখ কষ্ট দেখলে
তাদের মনে যেনো আর আনন্দ ধরে না।
তেমনি চৈতীকে দেখে গাঁয়ের কোন কোন মহিলা মুখ ভ্যাংচিকেটে বলে হুম...ধনীর একটা মেয়ে হয়েছে বটে।
ধুমড়ি মেয়ে একটা। মেয়ে তো নয়, যেনো একটা গ্যাঁচো ইঁদুর। আবার কেউ কেউ বলে গাছ বাওয়া একটা কাঠবিড়ালি।
সারাদিন কাঠবিড়ালির মত শুধু পরের গাছ বেয়ে বেড়ায়। বলি, ধনী কেনো যে অমন ধুমড়ি মেয়েটাকে বিয়ে দেয় না, কে জানে? চৈতী কারোর কোন কথা কানে করে না। শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়।
এবছর সে তার নারাংগালী গাঁয়ের পাশের গ্রাম পানিসারার সুরুজজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। কিন্তু বয়সের তুলনায় চৈতী বেশ দাওড়াচাওড়া আর উঁচু লম্বা হয়ে উঠেছে। একদিন গাঁয়ের একটা মধ্যবয়সী লোক, নাম কালু সে ধনীর বাড়িতে এসে বলে....
বাপু, তোমার জন্য যে আমাদের গাঁয়ের
গেলো সব কুল, মান, জাত
বুঝিনে বাপু, ধাঙ্গড় মেয়ে ঘরে রেখে তুমি
কি করে যে মুখে তোলো ভাত?
এভাবে আরো নানান লোকে নানান কথা বলতে থাকে। আরেকদিন একটা কুটনী বুড়ী, যার গাঁয়ে
ঘুরে ঘুরে মানুষের খুঁচা মারা আর এর বাড়ির কথা
ও বাড়ি বলে বেড়ানো স্বভাব। সেও মুখ ঝামটি কেটে চৈতীর মাকে বললো....বাপু মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারো না শুনি? নাকি ঘরের খুঁটি করে
বাড়িতেই রেখে দেবে হুম..? চৈতীর মা শুনে কোনো কথা বলে না। এভাবে ধনীর স্ত্রী পূর্ণবতী গাঁয়ের পাঁচজনার পাঁচ
কথা শুনতে শুনতে একসময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
সে রাতে শোয়ার সময় চৈতীর বাবা ধনীকে বলে। ওগো.., এভাবে তো গাঁয়ের মানুষের কথা শুনে আর পারা যায় না। তারচেয়ে একটা ছেলে দেখে মেয়ে চৈতীকে বিয়ে দিয়ে দাও। শুনে ধনী বললো, বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে দেওয়া যায় না তাইনা? বিয়েতে তো একটা মোটা অংকের খরচ-খরচারও ব্যাপার-স্যাপার আছে।
আসলে....
চৈতীর বাবা নামেই যা-শুধু ধনী,
অথচ ধনদৌলত বলতে কোন কিছুই তার নেই।
পরের জমি বর্গা চাষ করে আর গাঁয়ের মানুষের
ক্ষেতখামারে জনমজুরী খেটে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে কোন রকম তার টানাপোড়নের সংসারটা চলে।
তবু, রাতে যখন তার স্ত্রী পূর্ণ বতী মেয়েকে বিয়ে
দেওয়ার কথা বললো। ধনী বললো, চৈতীর মা,
তুমি যে চৈতীকে বিয়ে দিতে বলছো..। কতোই-বা
বয়স হয়েছে মেয়েটার বলো? আর তাছাড়া ওর
এখন কিশোরী মন। এখনো ওর ছেলে মানুষী যায়নি। স্বামী, শশুর-শাশুড়ী সংসার বুঝার মতো
বয়স কি এখনো ওর হয়েছে বলো? এই বয়সে বিয়ে দেওয়াটাকে যে বাল্য বিবাহ বলে। পূর্ণ বতী বললো, সেতো ঠিক আছে, কিন্তু গাঁয়ের মানুষের পাঁচজনের পাঁচ কথা শুনে তো আর পারা যাচ্ছে না। আর তাছাড়া বিয়ে দিলে দেখবে আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। আমিও তো কোন ছোট্টকালে এ
ঘরে এসেছি তোমার বউ হয়ে। কই! আমি কি সংসার করছি না?
ধনী বললো, ঠিক আছে তুমি যখন বলছো। কাল
ঘটককে একটা ভালো সম্বন্ধ আনতে বলে দেবো।
পরদিন সকালে ঘটক কুতুবউদ্দিনকে বললো। সে
যেনো একটা ভালো ছেলে দেখে তার মেয়ের জন্য। এরপর থেকে মাঝেমধ্যে ঘটক কুতুবউদ্দিন
এক একটা সম্বন্ধ নিয়ে ছেলে পক্ষের লোকজন নিয়ে হাজির হয় ধনীর বাড়ি। দেখা, মতামত নাস্তা পর্ব শেষ হলে দেনা-পাওনা, মানে যৌতুক নিয়ে দরকষাকষি চলে। কিন্তু সব ধনীর সাধ্য সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় বিয়ে আর হয়ে ওঠে না। সর্বশেষে
চৈতীর মা-বাপ দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো। মেয়ে
তাদের কালো। মোটা যৌতুক ছাড়া কেউ মেয়েকে
বিয়ে করবে না। তাই তার নিজের যে দশ কাঠা জমি আছে। সেটুকুই সে বন্ধক রেখে মেয়ে চৈতীর বিয়ে দেবে। ধনীর যেকথা সেই কাজ। তারপরদিন ঘটককে বললো... শেষে যে পাত্র নিয়ে এসেছিল তাদের গার্জেন পক্ষদের নিয়ে আসতে। সে তাদের দেনা-পাওনার বিষয় কথা বলবে। ঘটক দু,দিন
পরেই ছেলের গার্জেন পক্ষকে নিয়ে আসলো ধনীর কাছে। দেনাপাওনার কথা উঠতেই ছেলের বাপ হেসে বললো...খুব বেশি কিছু দিতে হবেনা বুঝলেন বেয়াই মশাই?
এই ধরুন সাংসারিক টুকিটাকি যেসব লাগে আর কি...যেমন থালাবাসন, হাঁড়িকুঁড়ি, কাঁথা বালিশ, আর আমার ছেলের বহু দিনের শখ একটা নতুন মোটরসাইকেল চড়ার। আর পঞ্চাশ হাজার মতো টাকা দিলেই হবে বুঝলেন? চৈতীর বাবা ধনী বললো জ্বি বুঝেছি। চৈতীর বাবা ধনী রাজি হয়ে গেলো দিতে। তবে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা বিয়ের কিছুদিন পরে দিবে বলে সময় নিলো ছেলের বাপের কাছে। দু,দিন পর শুক্রবার চৈতীর বিয়ে।
বিয়ের কথা শুনে চৈতী কান্না শুরু করেছে। এতো-
দিন গাঁয়ের লোকজন যারা চৈতীর মুখে হাসি দেখতো। এই প্রথম তারা চৈতীকে কান্না করতে দেখলো। এদিকে চৈতীর বাবা ধনী তার দশ কাঠা জমি গাঁয়ের টাকা-ওয়ালা একজনের কাছে বন্দক থুয়ে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিলো। দুই চারটি আত্মীয় ঘরের লোকজন। আর গাঁয়ের কিছু গণ্যমান্য লোকজনকে দাওয়াত দিলো ধনী।
শুক্রবার বিয়ের দিন সকালে চৈতীকে বেনারসি শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে বউ সাজানো হয়েছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। চৈতীর বয়সী তার গাঁয়ের সখিরাও এসেছে। দুপুরের আগেই বরযাত্রী
চলে এলো সব। বর এসেছে বর এসেছে বলে হৈ-হুল্লোড় করে চেচামেচি করতে লাগলো। জুমার নামাজের পর কাজি সাহেব চলে এলো বিয়ে পড়াতে। তারপর বিয়ে হয়ে গেলো চৈতীর। (চলবে)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ না বানাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান মির্জা ফখরুলের
ক্রিসমাসকে ঘিরে বর্ণিল সাজে সজ্জিত স্পেন
সমৃদ্ধ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গঠনে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ: প্রধান উপদেষ্টা
প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে যুবদের দক্ষতা উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার তাগিদ বিশিষ্টজনদের
কেরানীগঞ্জে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্কের ১২ মাসে ১২ হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি
বেনাপোলে আবাসিক হোটেল থেকে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্য জব্দ
গফরগাঁওয়ে বালুভর্তি লড়ি চাপায় যুবকের মৃত্যু
‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ উক্তি সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী'
মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা করায় ইউক্রেনকে সমালোচনা ট্রাম্পের
সংবিধানে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন করতে হবে
জামিন পেলেন অভিনেতা আল্লু অর্জুন
অপরাধীদের ক্ষমায় রেকর্ড করলেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন
লামায় চতুর্থ শ্রেণী সরকারি কর্মচারী সমিতির নতুন সভাপতি দুলাল, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম
৭২ সংবিধানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করেছেন শেখ মুজিব মাওলানা মামুনুল হক
নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেবে: জয়শঙ্কর
ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে মাড়াই কার্যক্রম উদ্বোধন
তাহেরির মাহফিল থেকে পুলিশের ওপর আক্রমণ
শিক্ষার্থীরা যেমন ছাত্ররাজনীতি চায়
উৎপাদন বাড়িয়ে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে