কবিতার বাঁক বদল এবং নতুন ধারা
০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
বলা হয় গতিই জীবন, গতিই পৃথিবীর ত্রাণকর্তা। বার্গসীয় সুত্রে পৃথিবীতে সর্বদা পুরনো ভেংগে নতুন সৃষ্টি হয়, আর যারা নতুন সৃষ্টি করে সময় তাদের বাহবা দেয়। বাংলা কবিতার পথ ভাঙ্গার ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে আমরা দেখি, কত জাতের কবিতা, কত তার বর্ণ, কত তার রুপ-কিন্তু মাটির কবিতাই যেন পাঠককে বেশি টানে। কারণ, তা নাড়িজাত এবং দেশজ। জ্যামিতিক-গাণিতিক কবিতাও লেখা হয়েছে বহু, এখন লেখা হচ্ছে। কিন্তু তরঙ্গ যেন তাতে নেই। যেন ছবি আছে কিন্তু তাতে জীবন নেই। থাকলেও তা দৃশ্যমান নয়। তারপরও তা কবিতা। কিন্তু কবিতার কবিতা নয়। আবার বিজ্ঞান আর কবিতা এক নয়। শেলি, কীটস সহ বহু কবি এবং আমাদের ৩০ দশকের দু’জন কবি বাদে বাকিরা কবিতায় বিজ্ঞানে মুখরিত ছিলেন না। একথা সত্য যে বিজ্ঞানের বড় সমস্যা তার শরীর কলকব্জাময়, জীবনশূন্য। এ কারণে কবির কল্পনা শক্তিও সে খর্ব করে। কল্পনা যেখানে নেই, তাকে কবিতা না বলাই শ্রেয়। আবার ফিলোসোফি বা জটিল চিন্তাও কবিতা নয়। এসব করতে গেলে কবিতার কোমল পাখিটাই শেষপর্যন্ত মারা যায়। তাই বলে ফিলোসোফিকে একেবারে কবিতা হতে বাদ দেয়াও সম্ভব নয়। কারণ, কবিতা ভাবাতেও কখনো কখনো পছন্দ করে। তবে শেষ পর্বে আকাশ থেকে নেমে আসা দেশজ কবিতারই জয় হয়। চিরকাল তাই হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। আধুনিক কবিতা সৌন্দর্য চর্চা করে পুরোমাত্রায়। যদিও তা কৃত্রিম আর প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্য ছাড়া আর কোনো সৌন্দর্য তার নেই। কৃত্রিম এবং নকল তো নকলই-কৃত্রিম। যা সত্য নয়। আধুনিক কবিতা এখানেই বড় হোঁচট খায়। নতুন ধারার কবিতা তা নয়। সে সত্যের পূজারী। যে সত্য সৌন্দর্যময়! যা চিরন্তন। যা পৃথিবী বিলোপের আগ পর্যন্ত অক্ষয়।৩
নতুন ধারা ইস্তেহার
মহামারী করোনায় যেভাবে বিশ্ব আজ দলিত-মথিত ও দ্রুত পরিবর্তিত। এখানে মৃত্যু, আর্তনাদ, শোক, একাকীত্ব, সন্দেহ, খাদ্যাভাব, অর্থ সংকট, বেকারত্ব, জন্মহীনতা প্রভৃতি যেন গ্রাস করেছে যা নিকট অতীতে বিশ্ব মনুষ্য সমাজ এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি। চারদিকে জীবানু হাতিয়ারের ঈংগিত। বিশ্ব জুড়ে লেখককুল তাদের সৃষ্টিতে অতিমারী জনিত বিষয়াদি অগ্রাধিকার দিয়ে লিখছেন। আধুনিক বিশ্বের মৃত্যু ঘটছে বলাই বাহুল্য। এ প্রসঙ্গে কবি ফাহিম ফিরোজের ভাষ্য হলো- “নতুন বিশ্ব এখন প্রসারিত। সমস্ত কিছুর আদল দ্রুত বদলাচ্ছে। আধুনিক মতবাদের মতো অভেদ্য কাব্য নয়, তা এখন কিঞ্চিত সহজবোধ্য, বলা যায় কবিতার কোনো অংশকণা লইয়া দীঘল ভাবনার অবসর কম রৈবে। নন্দন তত্ত্ব অনেকাংশে শক্তি হারাবে। শিল্প, ছন্দ, অছন্দ রৈবে। উপমা, রুপকল্পে কাঠিন্য নয়, সহজ স্বাভাবিক রুপ রৈবে বা না থাইকলেও ক্ষতি নাই। কাব্য গঠনে শিথিলতা রৈবে। যাহা আধুনিকে আছিলোনা। মানুষ মৃত্যু আতংকে কম বেশি ধর্মমুখী হবে। আধুনিকরা যাহা নিষিদ্ধ কৈরছিলো। আস্তিক-নাস্তিক রৈবে। পরিহার্য্য রাজনৈতিক কোন্দল। এতে প্রকৃতি, বিয়ং (রহস্যময়তা), কল্পনা, অলৌকিকতা জরুরি। নতুন শব্দ খেইল, ভোগবিমুখতা, নির্জনতা থাকবে। অসাম্যতার মৃত্যু ঘটিবে। নয়া পৃথিবীর এগিয়ে যাবে প্রগতির চাকা ছুঁয়ে, সবুজ ও মৃত্তিকার মেলবন্ধনে। শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য নয়, এবার পুরাকীর্তি গণ্য হবে অধিক। পুরাকীর্তি না থাইকলে সে ইতিহাস মিথ্যাময়। অথচ আধুনিকতায় ইতিহাসকই কম হৈলেও গুরুত্ব দেয়া হৈছিলো”।
ইশতেহারে বর্ণিত নতুন ধারা কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য মূলত দুটি। যথা:
১. আত্মীয় আর সম্পর্ক বাচক শব্দের নাম সহ প্রয়োগ অপরিহার্য।
২. জরুরি প্রমিত ভাষার সাথে লোকাল ভাষার কোমল মিশ্রণ।
এ প্রসঙ্গে নতুন ধারার বক্তব্য হলো, এ দুটো বৈশিষ্ট্য নতুন পৃথিবীর নতুন ধারায় কবিতায় অনস্বীকার্য। যা আধুনিক কবিতায় দূরের কথা, হাজার বছরের অধিক বাংলা কবিতায়ও ছিল না। প্রথমটি কারো কবিতায় থাকলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায়। কিন্তু নতুন ধারার কবিতায় সবার জন্য তা আবশ্যক বলে ইস্তোহারে উল্লেখ। এখানে বহুরৈখিকতা আবশ্যক। আধুনিকের মতো শুধু মৌল নয়, গৌণদের কথাও বলবে। কেননা সমাজ কাঠামো নির্মাণে তাহাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা, কাম, নারীর সৌন্দর্য ও ক্ষমতায়ন এ ধারায় বৈধ। নতুন পৃথিবীতে সব কিছুই নবীকরণ। আধুনিকতার সাথে যার দোস্তী ভাব নাই। করোনাকালীন সৃষ্ট সাহিত্যই বিশ্বে ‘নতুন ধারা’। এটা করোনাকালে ধুমকেতুর মত হঠাৎ, দৈবিক সৃষ্টি, কোনো বিবর্তন নয়, কারন বিবর্তন ঘটে ধীরে।৪
নতুন ধারার উপ-বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. নতুন ধারায় ধর্ম ও অধর্ম থাকবে।
২. বাস্তব ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী।
৩. পুরো নয় আংশিক নন্দনতত্ত্ব সর্মথন।
৪. শিল্পের প্রতি নতজানু- রহস্যময়তায় বা বিয়ং এ আস্থাশীল।
৫. কাঠামো শিথিল হবে।
৬. ইতিহাস-ঐতিহ্য- প্রগতি-দর্শন নির্ভর।
নতুন ধারায় ‘বিয়ং’ শব্দটি অপরিহার্য। এর সরল অর্থ হলো রহস্যময়তা বা ছলাকলাময়। নতুন ধারায় কবিতায় ‘বিয়ং’ উজ্জ্বল। যা এ ধারার কবিতার একটা বৃহৎ শক্তিও বটে। প্রকৃত কবিতা সব সময় কিছুটা লুকাতে পছন্দ করে অর্থাৎ রহস্য তৈরি করে। সত্যিকার কবিতার পোকারা এই রহস্য বা ছলাকলা পছন্দ করেন। তারা ইংগিতে তা বুঝে নেন। কিছু পাঠক আবার আমূল বুঝতে চান। এসব পাঠক কখনোই শুদ্ধ নয়। পুঁথিবাদী চেতনায় বিশ্বাসী। এদের নতুন ধারায় দরকার নেই বলে ইশতেহারে মত দেন। তাতে আরও বলা হয়েছে- ‘নতুন ধারার কবিতায় যারা ‘বিয়ং’ মানেন না, তারা নতুন করে ‘বিয়ং’ লইয়া ভাবুন। শুধু প্রমিত ও লোকাল ভাষার মিশ্রণই নতুন ধারা নয়। সাথে ‘বিয়ং’ এর দরকার রৈছে। কিন্তু বেশি মাত্রায় নয়। কম কম। পাশ্চাত্যে এই ‘বিয়ং’ লইয়া ঝড় বইতাছে!৫
শুরুতেই বলেছি সময়ের নিয়ম বদলে যাওয়া এ ক্রান্তিকালে চলছে একুশ শতকের অতি আধুনিককাল। সম্প্রতি সে বদলের হাওয়া লেগেছে সাহিত্যে ‘নতুনধারা’ নামে। তথাকথিত আধুনিকতার বাহানায় নষ্ট নাগরিকতা, নাস্তিক্যবাদ, মার্কসবাদ, ফ্রয়েডিয় যৌনতত্ত্ববাদ, হেগেলের বস্তুবাদতত্ত্বের পুরনো ভাবধারাকে ডিঙ্গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, নতুন বিষয়ে শুরু হওয়া এই ‘নতুন ধারা’। বলা হয়ে থাকে আধুনিক কবিতা ৩০ দশকের লালিত যা ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত। বৃটিশ-পাকিস্তান আমলেও এদেশে শিল্প-সাহিত্যের কোনো ইশতেহার ছিল না। ১৯৩০ দশক এবং ‘৬০ দশকে কোলকাতায় ইশতেহার ঘোষণা হয়েছিল। এ শূন্যতা ঘোচাতেই যেন গত ২৬ নভেম্বর, ২০২১ মৌচাক টাওয়ার, মালিবাগে ‘শরীয়তপুর সাহিত্য পরিষদ’র আয়োজনে পালিত হয় নতুন ধারার ইশতেহার ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা। যা আমাদের অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
আবারো ‘নতুন ধারা’ প্রসঙ্গে আসা যাক। পৃথিবীতে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, চুরি-ডাকাতি, খুন, গুম, ধর্ষণ, ব্যাভিচার, যেনা, পরকীয়া, সমকামিতার মতো জঘন্য কাজের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে প্রকৃতির সহজাত নিয়মেই বিশ্বব্রহ্মা-এর স্রষ্টা শতবছর পর পর রাশ টেনে ধরেন নানামুখী মহামারি, প্রাকৃতিক দূর্যোগ দিয়ে। তাতে প্রলয় আসে প্রাণহানির। বিশ্বজুড়ে সংখ্যা দাঁড়ায় মিলিয়ন বিলিয়ন তারও বেশি। অতিমারি চক্রের কালচিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৩২০ সালে দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবোনিক প্লেগ, ১৪২০ সালে দ্য এ ওইডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ (দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়), ১৫২০ সালে গুটিবসন্ত, ১৬২০ সালে মহামারির প্রলয়ে মূর্চ্ছা যায় রক্তিম ‘ মে ফ্লাওয়ার’ (স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস), ১৭২০ সালে দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই, ১৮২০ সালে ভারতবর্ষে কলেরা, যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার, ১৯২০ সালে দ্য স্প্যানিশ ফ্লু এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে নোভেল করোনাভাইরাস যার প্রাণঘাতি ক্ষয়-ক্ষতি একুশ সালেও বর্তমান এবং তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা আমরা জানি না। এক একটি মৃত্যুপ্রলয় অনেক দাম্ভিক নাস্তিককেও আস্তিকমুখী করেছে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে। মানুন বা না-ই মানুন, এটাই সত্য। দেখা যায় প্রতি একশো বছর পরপর যেন পৃথিবীতে এককটা প্রাকৃতিক ঘনঘটা মানব সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য এবং মানবিক মননের পরিবর্তন ঘটিয়েছে প্রকৃতি আপন ছন্দে। আর তার প্রভাব পড়েছে কবিতাসাহিত্যেও। কারন বহুরৈখিকতা একটি কবিতায় বিবিধ অনুষঙ্গ। (চলবে)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার
সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!
সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে
ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩
সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা
যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু - ডা.মাজহার
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?
ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা
মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!
আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন
পরিবহনব্যবস্থা
রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর
ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন
জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ