বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতী ভাষা ও সংস্কৃতি

Daily Inqilab মো: জোবায়ের আলী জুয়েল

৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম

বাংলাদেশে বাঙালিরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হলেও এখানে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশে উপজাতির সংখ্যা চল্লিশের অধিক। অপর এক গবেষণা মতে বাংলাদেশে উপজাতির ভাষার সংখ্যা ছাব্বিশটি (ইনডিজেনাস কমিউনিটিস গ্রন্থে)। তারা প্রধানত বাস করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, বরগুণা, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে।  উপজাতীয় ভাষাগুলির মধ্যে ওঁরাও, খাসিয়া, গারো, চাকমা, মগ, মনীপুরী, মুন্ডা ও সাঁওতালি উল্লেখ যোগ্য। এছাড়াও রয়েছে খুমি, কোচ, হাজং, চাক, খাড়িয়া, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি।   
১। ওঁরাও ভাষাঃ- বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের চা-বাগান এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাতৃভাষা ওঁরাও। ওঁরাও ভাষীদের সর্বোচ্চ সংখ্যা রংপুরে এবং সর্ব নিম্ন সিলেটে। ওরাও ভাষা কুরুখ নামে সমধিক পরিচিত। এ ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই, তবে তা’ লোক সাহিত্য সমৃদ্ধ। ওঁরাও ভাষায় অসংখ্য উপকথা, রূপকথা, গীত, ছড়া, ধাঁ ধাঁ, প্রবাদ ইত্যাদি রয়েছে।
লোক সাহিত্য ওঁরাওদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হাসিকান্নার বাহক। প্রেম, প্রকৃতি, জীবিকা, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত ওঁরাও লোকসঙ্গীত যথেষ্ট কাব্যময় ও শাক্তিশালী। এ ভাষায় অগণিত ছেলে ভূলানো ছড়া ও ঘুম পাড়ানি গান রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে মুন্ডা ও ওঁরাও ভাষা একই। ওঁরাও ও বাংলা ভাষায় কিছু গহনার নাম এক যথা- টিকলি, বালা, পায়রা, বালি, কানপাশা ইত্যাদি। সন্বন্ধসূচক অনেক ওঁরাও এবং বাংলাশব্দও এক যথা- মা, বাবা, মামা, ভাগিনা ইত্যাদি। এছাড়াও আরও কিছু বাংলা শব্দ ও ওরাঁও শব্দের মধ্যে যথেষ্ট মিল, দেখা যায় যথা- ওঁরাও ভাগোয়ান, বাংলা ভগবান, ওরাঁও ভগতি, বাংলা ভক্তি, ওরাঁও ভূত, বাংলা ভূত ইত্যাদি।
২। খাসিয়া ভাষা: খাসিয়া ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। খাসিয়া ভাষায় গ্রামকে “পুঞ্জি” বলে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ও পার্বত্য অরণ্য অঞ্চলে তাদের বসবাস। খাসিয়া ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রধানত পাড়, লিংগাম ও ওয়ার। পাড় মানে পর্বত ও খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাই পাড়। লিংগাম শব্দে গারো পাহাড়কে বোঝায়। তাই গারো পাহাড়ের সন্নিকটস্থ অঞ্চলের ভাষাই লিংগাম নামেই সমধিক পরিচিত। ওয়ার মানে উপত্যকা।
এক সময় খাসিয়া ভাষা বাংলা হরফে লিখিত হতো। বাংলা অক্ষরে বাইবেলের কিছু অংশ খাসিয়া ভাষায় প্রথম অনুদিত হয়েছিল। বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় রোমান অক্ষরে চেরাপুঞ্জি ও এতদ অঞ্চলের খাসিয়া ভাষা লিখিত হচ্ছে। মেঘালয় রাজ্য এ ভাষাকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম করা হয়েছে। বাংলাদেশে খাসিয়াদের জনসংখ্যা অত্যাধিক নয়। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন পার্বত্য ও অরণ্যে অঞ্চলে তাদের বসবাস।
৩। গারো ভাষা: গারো ভাষা প্রধানত চীনা-তিব্বতী ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত এবং অনক্ষর ও অলিখিত একটি প্রাচীন অনার্য ভাষা। চীনা ভাষার সঙ্গে এ ভাষার শব্দ, ব্যাকরণ ও ভাষা তত্ত্বগত প্রচুর মিল রয়েছে। এ ভাষা প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, গান, ছড়া, কিংবদন্তী, উপকথা, পালাগান ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এতে নৃতত্ত্ব ও ধর্মের কথাও আছে। বহু ভাষার শব্দ দ্বারা গারো ভাষার শব্দ কোষ পুষ্ট। এ ভাষার বাক্য গঠন, পদ বিন্যাস, বিভক্তি, প্রত্যয়ের অবস্থান, ক্রিয়া ও শব্দের রূপান্তর উন্নত ভাষার মতো সুশৃঙ্খল। বাংলা ও অসমীয়া ভাষার সঙ্গে এ ভাষার সাদৃশ্যের কারণে কেউ কেউ গারো ভাষাকে এই দুই ভাষার মিশ্ররূপ বলে মনে করেন। গারোরা বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে বলে এ ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ দেখা যায়। খ্রিষ্টান মিশনারিরা গারো ভাষায় রোমান অক্ষর প্রচলন  করেন। বাংলা হরফে গারো ভাষা স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। বর্তমানে গারোদের পারিবারিক ভাষা গারো কিন্তু তাদের পোশাকি ভাষা বাংলা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তে রয়েছে গারোদের বসবাস।
৪। চাকমা ভাষা: চাকমা ভাষা বাংলাদেশের উপজাতীয় ভাষা সমূহের মধ্যে উন্নততর। এ ভাষায় কিছু প্রাচীন পুথি রয়েছে। সে সবের মধ্যে তালপাতায় লিখিত “চাদিগাং চারা” পালা একটি। এ থেকে জানা যায় যে চাকমারা নেপাল থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ পরিক্রম করে ব্রহ্মদেশ ও আরকানের মধ্য দিয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে এসে উপনীত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে তাদের আনাগোনা থাকলেও মাত্র তিনশ বছর পূর্বে তারা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের আদিনাম “শাক” (ঞঝ ধশ)। পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন লক্ষাধিক লোক চাকমা ভাষায় কথা বলে। চাকমা ভাষার বর্ণমালা থাইল্যান্ডের ক্ষের, আন্নাম, লাওস, কন্বোডিয়া, শ্যাম ও দক্ষিণ ব্রহ্মের লিপির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।  চাকমা ভাষায় চীনা ভাষার মতো টান (ঞড়হব) আছে, যে কারণে একই শব্দের অর্থ পার্থক্য ঘটে, তবে তা’ তেমন প্রকট নয়। শব্দতত্ত্ব, ছন্দ প্রকরণ, লোকসাহিত্য, বাগ বিন্যাস ও ধ্বনিতত্ত্বের দিক দিয়ে চাকমা ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার খুব মিল রয়েছে। বাংলা ভাষার সব ধ্বনি চাকমা ভাষায় রয়েছে। রঙ্গামাটি থেকে “চাকমা প্রথম পাঠ” নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রণেতা নয়ণ রাম চাকমা। চাকমা ভাষায় রচিত অনেক গীতও আছে, যেগুলি চাকমা কথ্য ভাষায় রচিত। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা কবি শিবচরণ রচিত “গোজেল লামা”র ভাষা প্রায় হুবহু বাংলা, এতে “পূর্ববঙ্গ গীতিকার” মতো বন্দনা গীতি রয়েছে। “রাধামন ধানপাতি” ও “চাদিগাং চারা” পালা চাকমাদের দুটি উল্লেখযোগ্য পালা। চাকমা ও বাংলা ছড়ার ছন্দ প্রায় অভিন্ন। এ দুটি ভাষার পদবিন্যাসও প্রায়ই একই রকম। চাকমা লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। বহু লোকগাঁথা ও কিংবদন্তী রয়েছে এ ভাষায়”। “উভাগীত” চাকমাদের প্রিয় ঐতিহাসিক গান। প্রবাদ-প্রবচন চাকমা ভাষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এতে প্রধানত কৃষি, পশুপাখি, প্রকৃতি, সমাজ, ধর্ম, দেহ-তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় বিধৃত হয়েছে। চাকমা ভাষায় প্রবাদ-প্রবচনকে বলে “দগ অ ক ধা”। বর্তমান এ ভাষা রূপগতভাবে বাংলা, অসমিয়া, রাজবংশী, গারো, সাঙ্ঘমা ও চাটগেঁয়ে ভাষার কাছাকাছি। এ ভাষার ছয়টি আঞ্চলিক রূপ রয়েছে। এমন কি, চাকমা গোত্রে-গোত্রেও এর পৃথক কথ্যরূপ দেখা যায়। ৫। মগভাষা: মগভাষা হলো আরকানি ভাষার কথ্য রূপ এবং একটি সংকর ভাষা। তিব্বতী-বর্মণ গোষ্ঠীভূক্ত এ ভাষায় অষ্ট্রো-এশীয় ভাষার প্রচুর উপাদান রয়েছে। চীনা, প্রাচীন বর্মি এবং মিজো ভাষার সঙ্গে এ ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে সবচেয়ে বর্মি ভাষার সঙ্গে রয়েছে এর ঘনিষ্ট সম্পর্ক। মগ ভাষার আদিনিবাস আরকাণ। বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক লোক মগ ভাষায় কথা বলে।
মগভাষা আরাকাণ ও বাংলাভাষার সংমিশ্রিত ভাষা। এক সময় ব্রহ্মদেশীয় রাজার অত্যাচারে দুই-তৃতীয়াংশ আরাকাণি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার সংমিশ্রণে মগভাষার উৎপত্তি হয়।
মগ বর্ণমালার নাম “ঝা”। বর্ণগুলি মানুষের কোন-না-কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামে উচ্চারিত হয়। এর আকৃতিতে চীনা চিত্রলিপির ছাপ লক্ষণীয়। আরকান ও বাংলাদেশেও এক শ্রেণির মগ আছে। যাদের ভাষা বাংলা। বড়ুয়ারা মূলত মগ, কিন্তু বাংলা ভাষী। পালি মগদের ধর্মীয় ভাষা। এ কারণে বহু পালি শব্দ কিছুটা বিকৃত কিংবা অবিকৃত ভাবেই মগ ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন- ভিক্ষু, নির্ব্বাণ, বিহার, ভাবনা (ধ্যান), দুক্খ, বস্সা (বর্ষা) ইত্যাদি। বাংলা ও মগ ভাষার কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ ও অর্থে এক, যথা: আদ্য, মধ্য, উপাধি, আপত্তি ইত্যাদি। আত্মীয় সূচক কিছু মগ শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়, যা’ উচ্চারণ ও অর্থে এক। আবার কোন কোনটিতে অর্থের কিছু তারতম্য ঘটেছে, যথা:- বাবা, বাজী, মা। আঞ্চলিক বাংলায় বাবা, বাজী সমার্থক, কিন্তু মগভাষায় বাজী মানে জেঠা। মগরা ছোট মেয়েকে বলে “মা”, কিন্ত আঞ্চলিক বাংলায় মেয়েকে আদর করে বলা হয় “মা”।
বর্মী ও মগ ভাষায় বার ও মাসের নাম এবং সংখ্যা গণনা অভিন্ন। মগরা আরাকাণে থাকতেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিল, কারণ মধ্যযুগে আরাকানে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হতো।। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ফেনী, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা ও মগ ভাষার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব লক্ষণীয়। 
মগভাষায় সৃজনশীল সাহিত্য না থাকলেও লোকসাহিত্যের উপাদান আছে প্রচুর। এতে রয়েছে প্রবাদ, ধাঁ ধাঁ, উপকথা, গীত, ভূতের গল্প, জাতকের গল্প, বৌদ্ধ রাজা-রানীদের কাহিনী ইত্যাদি। গল্প গীতি প্রিয় মগরা অবকাশ মৌসুমে রাত ভর গল্প শোনে, বাদ্য সহ নাচ গান করে এবং বাংলা যাত্রা গানের মতো “পা ওয়ে” নামক এক ধরণের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে। কোন কোন গল্প আবার তাদের বর্মী অক্ষরে লিখিত। ৬। মণিপুরী ভাষা: মণিপুরী ভাষা মোঙ্গলীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি-বর্মিশাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীভূক্ত প্রায় ৩,৫০০ বছরের প্রাচীন ভাষা। মৈতৈ জাতির নামানুসারে উনিশ শতকের পূর্বাধ পর্যন্ত এ ভাষার নাম ছিল মৈতৈ। পরবর্তীতে মণিপুরী নামে অভিহিত হয়। মূল মৈতৈ বর্ণমালায় বর্ণ ছিল ১৮টি পরে আরও বর্ণমালা    সংযোজিত হয়। বর্মি-আরাকাণি বর্ণমালার মতো মৈতৈ বর্ণমালা মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উচ্চারিত হয়। এর বর্ণগুলি তিব্বতি বর্ণমালার অনুরূপ।
মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব যুগের প্রথম নিদর্শন গীতি কবিতা “ঔগ্রী”। তৎপূর্বে বিচিত্র প্রেম, গীত, প্রবাদ-প্রবচন, পালাগান, ছড়া ইত্যাদির প্রচলন ছিল। প্রেম গীত গুলি বেশ চিত্তাকযর্ক। এগুলি যুবক-যুবতীরা বাদ্যনৃত্য সহযোগে দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করে। মণিপুরী ভাষায় প্রচুর সামরিক সঙ্গীত এবং কতিপয় নাটক,  উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্য, এমনকি মহাকাব্যও রচিত হয়েছে। এ ভাষায় বাংলা ও পাশ্চাত্যের বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ এবং রামায়ন, মহাভারতও অনূদিত হয়েছে। ভারতের মণিপুরে এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা এবং অন্যতম ভারতীয় জাতীয় ভাষা রূপে স্বীকৃত।
মণিপুরী একটি সংকর ভাষা। বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও ব্রহ্মদেশে প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক লোক এ ভাষায় কথা বলে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটে মণিপুরী ভাষীর সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষ।
৭। মুন্ডা ভাষা: মুন্ডা ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এ ভাষা উড়িয়া, অসমিয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়। অসংখ্য মুন্ডা শব্দ বাংলা ভাষায় বিশেষত আঞ্চলিক ভাষায় বিদ্যমান। কৃষি, গৃহস্থালী, বসতি, গণনা, আত্মীয়তা, ওজন, ভূমি, পশু-পাখি, গাছ-গাছড়া ইত্যাদি সংক্রান্ত শব্দ মু-া তথা অস্ট্রো এশীয় ভাষা থেকে আগত।
মু-া ভাষা ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে চালু ছিল বলে এর আঞ্চলিক রূপ ও ছিল। দক্ষিণ বিহার ও উড়িষ্যার সংলগ্ন অঞ্চলে, মধ্য প্রদেশ ও পশ্চিম বঙ্গে প্রায় এক কোটি লোক মু-া ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ হাজার। অনার্য মুন্ডা ভাষার সঙ্গে বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও পদ ক্রমের ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। মুন্ডা ভাষায় শব্দ দ্বৈতের বাহুল্য আছে। স্ত্রী-পুরুষ বাচক শব্দ বসিয়ে লিঙ্গান্তর করা হয়। মুন্ডা ও বাংলায় কারক বিভক্তির ব্যবহার অনেকটা অনুরূপ। মুন্ডা ও বাংলায় ১০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলির বুৎপত্তি এক। “হালি” এবং “কুড়ি” বাংলার মতো মুন্ডায়ও গণনার একক। খ্রিষ্টান মিশনারিদের প্রকাশিত গঁহফধৎর-ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু-র মাধ্যমে মুন্ডা ভাষার ব্যাপক পরিচয় পাওয়া যায়।
৮। সাঁওতালি ভাষা: সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রো এশীয় ভাষা গোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্ভূক্ত। প্রায় দশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ব্রহ্মদেশ ও আসামের ভেতর দিয়ে অস্ট্রো এশীয় জনগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিহারের সাঁওতাল পরগনায় সাঁওতালভাষী জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। পশ্চিম বঙ্গের বিহার সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এবং বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে দিনাজপুর, রাজশাহী ও রংপুরে বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় দেড় লক্ষ সাঁওতাল ভাষী লোকের বাস আছে। তারা বাংলায় সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারে এবং নিজেদের ভাষায়ও বহু বাংলা শব্দ ব্যবহার করে। সাঁওতাল ভাষায় দুটি উপভাষা আছে “নাইলি” ও “করকু”। এটি অনক্ষর ভাষা। ভারতে এখনও সাঁওতালি ভাষা দেব নাগরী অক্ষরে লিখিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কোন সাঁওতালি বই-পুস্তক নেই। খ্রিষ্টান মিশনারিরা দু’একটি সাঁওতাল বিদ্যালয় স্থাপন করে ইংরেজি বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে। 
সাঁওতালি ভাষার প্রায় সব ধ্বনিই বাংলায় রয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ব্যাকরণিক মিলও আছে। মুল সাঁওতালি ভাষায় শব্দান্তে প্রত্যয় যোগের কোন প্রক্রিয়া নেই। সাঁওতালিতে প্রাণী ও অপ্রাণী বাচক সর্বনাম ভিন্ন ভিন্ন। সাঁওতালি, কোল, মুন্ডা ইত্যাদি ভাষা বাংলা থেকে তো বটেই ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। বাংলায় ও আঞ্চলিক উপভাষায় বহু সাঁওতালি শব্দ রূপান্তরিত অবস্থায় আজও বিদ্যমান। ৯। খুমি ভাষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে খুমিদের বাস। ২০০৬ সালের বেসরকারি জরিপে খুমিদের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজারে উঠে এসেছে। খুমিরা টিবেটান-বার্মিজ-কুকিচীন দলভূক্ত। এই ভাষার স্বর যুক্ত বর্ণমালার সংখ্যা ২৫ টি। খুমি থেকে ইংরেজি ভাষায় একটি অভিধান প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
১০। কোচ ভাষাঃ কোচ ভাষা সাইনো-টিবেটান পরিবারের এই ভাষাটিতে প্রচুর বাংলা, উড়িয়া, হিন্দি, অহমিয়া ও ছোট নাগপুরী ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। কোচদের নিজস্ব ভাষা আছে, বর্র্ণমালা নেই। কোচ জনসংখ্যা এখন ছয় হাজারেরও বেশি। কোচ ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। কেবল প্রাচীন লোকেরাই কোচ ভাষায় ভাব বিনিময় করতে পারে।
১১। হাজং ভাষাঃ জমিদারদের বিরুদ্ধে টংক আন্দোলন খ্যাত হাজং পরিবারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। বর্তমানে হাজং এর সংখ্যা বারো হাজারের মত। হাজংদের নিজস্ব ভাষায় বর্তমানে বহু বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে।
১২। চাক ভাষাঃ বাংলাদেশে চাক জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। উখিয়া, আরাকান, রামু, নাইক্ষ্যং ছড়ি, লামায় চাকদের বাসস্থান। চাকদের ভাষা আছে বর্ণমালা নেই। তবে মংমং চাক ধ্বনি অনুসরণ করে এগারোটি স্বরবর্ণ ও চৌত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ তৈরি করা হয়েছে। ১৩। খাড়িয়া ভাষাঃ বাংলাদেশে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে প্রায় ৬ হাজার খাড়িয়া রয়েছে। অস্ট্রো- এশিয়াটিক পরিবারভূক্ত খাড়িয়া ভাষা রোমান হরফে লিখিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে বাংলা ও দেব নাগরী হরফে ও লেখা খাড়িয়া ভাষার চর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশে কেবল প্রবীণ খাড়িয়ারাই তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করতে জানে।
১৪। খিয়াং ভাষাঃ ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী রাঙামাটি ও বান্দরবানে এক হাজার নয়’শ জন উল্লেখ করা হলেও খিয়াংদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা আনুমানিক তিন হাজার পাঁচ’শ জন। খিয়াং সিনো-টিবেটান ভাষা পরিবারভূক্ত। খিয়াংদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। কিন্তু কথ্য ঐতিহ্যে অনেক ছড়া, কবিতা ও গান রয়েছে। খিয়াং ভাষাটি মিয়ানমারেও প্রচলিত। ১৫। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ঃ তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী মোট বাংলাদেশে একান্ন হাজার পাঁচশ’র কিছু বেশি। জার্মান ভাষা বিজ্ঞানী গিয়ার্সনের সমীক্ষায় ১৯০৩ সালেই স্পষ্ট করে বলা হয় তঞ্চঙ্গ্যা একটি পৃথক ভাষা, যা ইঙ্গো ইউরোপীয় পরিবার ভূক্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে এবং এ ভাষাটির সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। 
উপজাতীয়  ভাষা সমূহ অস্ট্রো-এশীয়, ইন্দোচীন, চীন-তিব্বতি, তিব্বতি-বর্মণ, ইঙ্গো-ইউরোপীয় ও দ্রাবিড়ীয় ভাষা পরিবারের কোন-না-কোনটির অন্তর্ভূক্ত। বাংলাভাষা গঠনের যুগে উপজাতীয় ভাষা সমূহের অবদান অপরিহার্য।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বইমেলায় আহমেদ বায়েজীদের ‘মহাকাশে দুঃস্বপ্ন’
কবিতা
বাংলিশম্যান
২১ ফেব্রুয়ারি যেভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো
কবিতা
আরও
X

আরও পড়ুন

ময়মনসিংহে ১৩ তলা ভবন নির্মাণে ডেভেলপারের দায়িত্বহীনতায় বৃদ্ধার মৃত্যু

ময়মনসিংহে ১৩ তলা ভবন নির্মাণে ডেভেলপারের দায়িত্বহীনতায় বৃদ্ধার মৃত্যু

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে  তুমুল বাকবিতন্ড পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন কাল

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতন্ড পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন কাল

আশুলিয়ায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ২

আশুলিয়ায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ২

নাস্তিক রাখাল রাহারকে  সমুচিত  বিচার নিশ্চিত করতে হবে : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ

নাস্তিক রাখাল রাহারকে সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে হবে : জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ

সংস্কারের গল্প আমাদের বলার দরকার নেই : আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

সংস্কারের গল্প আমাদের বলার দরকার নেই : আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

এমসি ছাত্রাবাসে তালামীয কর্মীর উপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল : জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি

এমসি ছাত্রাবাসে তালামীয কর্মীর উপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল : জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি

চব্বিশের বিপ্লব এক উন্নত বাংলাদেশ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে : পররাষ্ট্রসচিব

চব্বিশের বিপ্লব এক উন্নত বাংলাদেশ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে : পররাষ্ট্রসচিব

গত ১৭ বছর আওয়ামীলিগ একটা জিকির করত জামাত শিবির, লাভ হয়নি সব হারিয়েছে  ঃ মাসুদ সাঈদী

গত ১৭ বছর আওয়ামীলিগ একটা জিকির করত জামাত শিবির, লাভ হয়নি সব হারিয়েছে  ঃ মাসুদ সাঈদী

চাঁদপুরে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

চাঁদপুরে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

সেই ৬৪ এসপিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে: আসিফ মাহমুদ

সেই ৬৪ এসপিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে: আসিফ মাহমুদ

বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়া মেয়ের সঙ্গে বিয়ের আগেই স্ত্রীর মতো আচরণ করা প্রসঙ্গে।

বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়া মেয়ের সঙ্গে বিয়ের আগেই স্ত্রীর মতো আচরণ করা প্রসঙ্গে।

কাপ্তাই উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে মাতৃভাষা দিবসে সভা

কাপ্তাই উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আয়োজনে মাতৃভাষা দিবসে সভা

মীরসরাই উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ভাষা শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা

মীরসরাই উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ভাষা শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা

দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন

দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন

নিউজিল্যান্ডে ইন্দিরার হত্যাকারীর ভাগ্নের ২২ বছরের কারাদণ্ড

নিউজিল্যান্ডে ইন্দিরার হত্যাকারীর ভাগ্নের ২২ বছরের কারাদণ্ড

মানবিক সমাজ  গঠনে দেশের সকল মানুষের সহযোগিতা চাই ঃ ডা.শফিকুর রহমান

মানবিক সমাজ  গঠনে দেশের সকল মানুষের সহযোগিতা চাই ঃ ডা.শফিকুর রহমান

গুজরাটে বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষ, নিহত অন্তত ৭

গুজরাটে বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষ, নিহত অন্তত ৭

এক কোটির মাদক-সহ অবশেষে পুলিশের জালে দিল্লির ‘লেডি ডন’

এক কোটির মাদক-সহ অবশেষে পুলিশের জালে দিল্লির ‘লেডি ডন’

মালয়েশিয়ায় লরির ধাক্কায় বাংলাদেশি নিহত

মালয়েশিয়ায় লরির ধাক্কায় বাংলাদেশি নিহত

ধামরাইয়ে আবাসন কোম্পানির পক্ষ নেওয়ায় সাবেক ইউপি সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা

ধামরাইয়ে আবাসন কোম্পানির পক্ষ নেওয়ায় সাবেক ইউপি সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা