মানিকের ‘ইতিকথার পরের কথা’ কৃষকের শোষণমুক্তির সংগ্রাম
০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩১ এএম | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩১ এএম
ত্রিশোত্তর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র একদল লেখক ‘রবীন্দ্রবলয়’ থেকে বেরিয়ে এসে ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ভিন্নতর সাহিত্যধারা সৃষ্টি করতে আগ্রহী হন এবং যথারীতি তাঁরা সার্থকতার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি করেন। এ ধারার উল্লেখযোগ্য এবং ‘কল্লোলের কুলবর্ধন’ হিসেবে খ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)। তিনি বাংলা কথাশিল্পে বহির্বাস্তবতা ও অন্তর্বাস্তবতার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে উপন্যাস-সাহিত্যের বিকাশে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ইউরোপীয় ভাবধারা গভীরভাবে আত্মস্থ করে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব ও কার্ল মার্কসের সমাজবীক্ষা কিংবা ধনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার নিপুণ উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়াও আল্বেয়ার ক্যামু, জেমস জয়েস, জ্যঁ পল সাঁর্ত্রে, ভার্জিনিয়া উলফ্, উইলিয়াম ফকনার প্রমুখ সাহিত্যিকের প্রভাবে তিনি উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রাঙ্কনে নিয়ে আসেন অভিনবত্ব। তিনি বাংলা উপন্যাসের গতানুগতিকতাকে পরিহার করে নতুন এক পথ নির্মাণ করেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২) পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে জমিদার ও মহাজনের বিরুদ্ধে কৃষকদের শোষণমুক্তির সংগ্রাম পরিবেশিত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বারতলা গ্রামের জমিদার জগদীশের পুত্র শুভময়। সে বৃটেনে গিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছে; কিন্তু উপনিবেশবাদ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ‘সেখান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের মাধ্যমে রাজনীতির বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করে এসেছে। দেশে ফিরে দেশের মানুষের কল্যাণে যন্ত্রশিল্পের উন্নতি সাধন করতে গিয়ে প্রথমে সে উপলব্ধি করে তার জাতীয়তাবাদী চেতনার সীমাবদ্ধতাকে। অতঃপর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বুঝতে পারে, দেশের মঙ্গল আসলে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের মধ্যেই নিহিত। এই নতুনতর বোধই তাকে শোষক জমিদার-পিতার সঙ্গে বিরোধের দিকে অনিবার্য ঠেলে দেয়।’ (সৈয়দ আজিজুল হক, কথাশিল্পী মানিক, পৃ. ২৮৫)। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেশগড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ায় পিতার সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধে।
শুভময় জমিদারনন্দন হলেও জমিদারের শোষণ-নির্যাতনের বিরোধী। জমিদার ও মহাজনের অত্যাচারে সর্বহারা মানুষের প্রতি সে সহানুভূতিশীল। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত শুভ চায় এদেশের মানুষের জীবনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসুক; কৃষকরা বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ-প্রক্রিয়া রপ্ত করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করুক। সে নন্দ ডাক্তারের বাড়িতে গিয়ে আড়ালে থেকে সংগ্রামী কৃষকসমাজের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতির কথা শোনে, এবং বুঝতে পারে, দিন বদলাতে শুরু করেছে। শুভ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় পাশে দাঁড়াতে চায়। এ বিষয়ে সে পরামর্শ করে তার সহপাঠী নন্দের সঙ্গে। শুভ গ্রামে কামারশালা ও তাঁতশিল্প বানাতে চায়, গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে চায়।। কিন্তু তার ভাবনা পুরোপুরি বুঝতে পারে না।
এরকম একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে সকলকে আস্থায় নিতে হবে. এবং তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে, সচেতন করতে হবে। শুভ তার আশা ও স্বপ্নের কথা বলে যায় : ‘আমি ওরকম আন্দোলনের কথা বলছি? যা করব নিজে করব, নিজের জন্য করবÑ নতুন রকম কিছু। আমার সাক্সেস দেখে দশজনে আমায় ফলো করবে। একেই আমি বলছি ইন্ডাষ্ট্রিতে নতুন একটা আন্দোলন সৃষ্টি করা। এদেশের বিশেষ অবস্থায় যেটা উপযোগী হবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বুঝতে পারছ কথাটা? কোন কাজে আমাকে লাগতে হবেই। বাপের জমিদারি আছে বলে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াতে পারবো না।’ (ইতিকথার পরের কথা, পৃ. ২৮৪)। অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ে লক্ষ্মীর আলোচনা শুনে শুভ অবাক হয়ে যায়। গজেনের বাল-বিধবা স্ত্রী লক্ষ্মী এখন কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। ভবিষ্যেতের কাজ আর দায়িত্ব নিয়ে সেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। লক্ষ্মীর সম্পর্কে লেখক বলেছেন : ‘শহর আর গাঁয়ের নানা আন্দোলনে সে যোগ দেয় প্রাণের তাগিদেই, কিন্তু দো-মনা ভাবটা নাকি তার ঘোচে না। সে বুঝে উঠতে পারে না কীসে আর কীভাবে কী হবে। উৎসাহ তার ঝিমিয়ে আসেÑ মনটা বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়ে। নানা কথা নানা মত শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে যায়। না জেনে না বুঝে অন্ধের মত কাজ করতে পারে কেউ? শুধু বুকের জ্বালা সম্বল করে? আর পাঁচজন লড়ছেÑ শুধু এই উৎসাহ নিয়ে? কেউ যদি সহজ সরল ভাবে তার বোধগম্য করে দিত ঠিক কীভাবে শত রকমের দুর্দশা ঘুচবে মানুষের? (ইতিকথার পরের কথা, পৃ. ২৯৫)
কৈলাশ ও লক্ষ্মী চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভাবে কিন্তু কীসে কী হবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। দুঃখ, দুর্দশা এই গ্রামের লোকদের নিত্যসঙ্গী। তাই তারা নিজেদেরকে দুর্ভাগা মনে করে। ভূষণ ও শ্রীনাথ মাইতি হা-হুতাশ করে তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। অথচ এসব মানুষকে যদি সঠিক পথের দিশা দেওয়া যায় তাহলে দেশেরই মঙ্গল। এদের হতদশাকে অশ্রদ্ধা না করে বরং এদেরকে দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর অদম্য একটা প্রত্যয় শুভকে আন্দোলিত করে।
তাতে শুভ দমে যায়নি। সে চলে যায় কলকাতার হোস্টেলে। সেখানে আত্মীয়-স্বজন অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করে নিয়মিত। তার মনে হয়, সে যেন এক নতুন জগতে বসবাস করছে। এ-পর্যায়ে পিতা জগদীশ হার মানেন পুত্রের কাছে। পুরো জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব শুভর উপর অর্পণ করতে চান তিনি, এমন কি কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করে তিনি অবসরে যেতে চান। কিন্তু শুভ তাতে রাজি হয়নি। কারণ শুভ জানে এতে এ সমস্যার সমাধান হবে না। উপরন্তু সে তার পিতাকে জমিদারি প্রথা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে বলে। শুভর বক্তব্যে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ভগ্নচিত্তে তিনি বাড়ি ফেরেন এবং নতুন করে প্রজাদের ওপর শুরু করেন শোষণ, নির্যাতন। গ্রামবাসীর উপর পিতার অত্যাচারের তীব্রতা শুনে এ-পর্যায়ে শুভ বিমর্ষ হয়ে পড়ে। সে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়, এজন্য পুনরায় গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে। সে অকপটে গজেনকে বলে : ‘আমায় দোষী করছ? তোমরা জান না বাবা আমায় ত্যাগ করেছেন, খেদিয়ে দিয়েছেন? কথাটা বলেই শুভর খেয়াল হয় ইচ্ছে করে না হলেও সে মিথ্যা কথা বলেছে। জগদীশ তো তাকে ত্যাগ করেনি, তাড়িয়ে দেয়নি। সে-ই ত্যাগ করেছে জগদীশকে, তার স্বাধীন স্বতন্ত্র আগামী জীবনের বর্তমান সীমানারও বাইরে।’ (ইতিকথার পরের কথা, ৩৯২) জমিদারতন্ত্র যে প্রকৃতপক্ষে নির্যাতন আর নিষ্ঠুরতার নামান্তর তা বুঝতে পেরেছে বলেই শুভ পিতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল হয়ে যায়। লক্ষ্মী, মায়া আর শ্রমজীবী মানুষের সান্নিধ্যে শুরু হয় তার নতুন জীবন। ইতিহাসের বিচারে দেখা যায়, সদ্য স্বাধীন দেশে গরিব চাষিদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন আসেনি। শোষণ- পীড়নও আগের মতোই রয়ে গেছে। কংগ্রেস সরকার এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনী শোষকদের পক্ষে কাজ করেছে, গরিব চাষিদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, তাদের ধরে জেলে দিয়েছে। গুলির আঘাতে গজেন পঙ্গুত্ববরণ করেছে।
বস্তুত, ইতিকথার পরের কথা উপন্যাসের কাহিনিতে কৈলাশ এবং লক্ষ্মীর কথা প্রাধান্য পেয়েছে। কৈলাশ কালিসাধক ত্রিভুবন দত্তের ছেলে। কৈলাশের সঙ্গে লক্ষ্মীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা। এই কৈলাশ-লক্ষ্মী অধিকাররক্ষায় দৃঢ়সংকল্প কৃষক সমাজের প্রতিনিধি। তারা সোভিয়েত আর চীনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। শুভও এই নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ। গ্রামের জমিদার পিতা জগদীশ সেখানে অবজ্ঞার পাত্র। লেখক শুভ চরিত্রের মধ্য দিয়ে এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও সে হয়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার অনুসারী। দিন বদলাতে শুরু করেছে। আগামির বদলে যাওয়া সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে তরুণ সমাজ; যারা পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা ও কর্মোদ্যোগের মাধ্যমে বদলে দেবে। ইতিকথার পরের কথা উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক দেখাতে চেয়েছেন যে, নতুন সমাজসৃষ্টির জন্য কেবল আত্ম-নিবেদিত হলে হয় না, তাকে বিজ্ঞানমনস্কও হতে হয়। পুরনো ক্ষয়িষ্ণু শোষণক্লিষ্ট ব্যবস্থার মধ্য থেকেই জন্ম নেয় নতুন কালের, নতুন চেতনার মানুষ। শুভ সেই শ্রেণিরই প্রতিনিধি। তার এই নবতর চেতনাই তাকে তার শোষক জমিদার-পিতার সঙ্গে বিরোধের দিকে ঠেলে দিয়েছে অবশ্যম্ভাবীরূপে। আর এই অন্তর্গত উপলব্ধিই ইতিকথার পরের কথার মূল উপজীব্য, যা মানিক অতি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলত, জগদীশ আর শুভর সঙ্গে আদর্শের, ব্যক্তিত্বের যে বিরোধ, শুভর যে শোষিত কৃষকদের দিকে ঝোঁক তৈরি হওয়া, তার মধ্যেই লেখকের একটা বিশেষ রাজনৈতিক ভাবনা রয়েছে। উপন্যাসে শুভর শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ একটি বিশেষ মাত্রা সংযোজন করেছে। সোভিয়েত ধাঁচের পরিকল্পিত অর্থনীতি ছাড়া যে বাঁচার বা উন্নয়নের পথ নেই Ñ মানিকের এ অভিপ্রায় উপন্যাসে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান