সাড়ে চার মাসে ৩০ রোহিঙ্গা খুন

রোহিঙ্গা ক্যাম্প অশান্ত করার নেপথ্যে কারা?

Daily Inqilab বিশেষ সংবাদদাতা কক্সবাজার থেকে

০৮ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৩ পিএম | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:১৯ পিএম

উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় প্রতিদিন খুনখারাবি, অপহরণ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। কারা এই অপকর্মের পেছনে জড়িত বা কারা রোহিঙ্গা শিবির অশান্ত করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়? এই প্রশ্ন অনেকের। পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে যাওয়ায় শরণার্থীদের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আশ্রয়শিবিরে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা শিবিরের বাইরেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে আছেন স্থানীয় লোকজন।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্য মতে, গত সাড়ে চার মাসে আশ্রয় শিবিরে ২৫টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ৩০ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ১৫ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ৭ জন আরসা সন্ত্রাসী ও অন্যান্য সাধারণ রোহিঙ্গা। গত রোববার দুপুরে উখিয়ার বালুখালীর ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দুই হাজার শেডের দেড় হাজার রেহিঙ্গা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আহত হয় শত শত নারী ও শিশু। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুতুপালং শান্তি সলিম আশ্রয় শিবিরে (ক্যাম্প-৫) আরসা ও আরএসওর মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) সলিম উল্লাহ। একই দিন দুপুরে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৮ এ আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। উম্মে হাফসা নামের ১১ বছর বয়সী শিশুর কোমরে এবং আট বছর বয়সী আবুল ফয়েজের ডান পায়ে গুলি লাগে। তাদের চিকিৎসা চলছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশ্রয় শিবিরে মাদক, অস্ত্র, সোনার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী ও মাস্টার মুন্না বাহিনীর মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি কিছু এনজিও কর্মীর বিতর্কিত ভূমিকা যেন ওই অপকর্মকারীদের উস্কানী দিয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাতের বেলায় আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গারা ঘুমাতে পারছেন না। দিনদুপুরে খুনখারাবির ঘটনাও ঘটছে। সেখানে কাজ করতে যাওয়া এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরাও উদ্বিগ্ন। তাদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

গত এক সপ্তাহে আশ্রয় শিবিরের ১৫ জনের বেশি রোহিঙ্গা নেতা, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনধি এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশ্রয় শিবিরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে সেখানে মাদক, নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালান রোধ এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে দ্রুত যৌথ অভিযান চালানো জরুরি। আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আশ্রয় শিবিরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা হয়েছে। শিবিরগুলোকে মাদক, অস্ত্র ও সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে খুব শিগগিরি যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
তিনি জানান, শিবিরের চারদিকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়ার কাজ শেষ করা, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ক্রম বৃদ্ধি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। ৫২টি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সমন্বিত মোর্চা কক্সবাজার সিএসও এনজিও নামের (সিসিএএফ) কো-চেয়ারম্যান আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। অপহরণ, ধর্ষণ, খুনি বেড়ে চলেছে। সেখানে কর্মরত এনজিও আইএনজিওর কর্মীরা উদ্বিগ্ন। নিরাপত্তার কারণে বিকেল চারটার পরপর সবাইকে আশ্রয় শিবির ত্যাগ করতে হচ্ছে। যৌথ অভিযানের মধ্যমে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নির্মূল করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ বলেন, মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং আটটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা শান্তিতে থাকতে পারছে না। দিনের বেলায় এপিবিএন ক্যাম্পে টহল দিলেও সন্ধ্যার পর আশ্রয়শিবির অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন সন্ত্রাসীদের রাজত্ব শুরু হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে গোলাগুলি-সংঘর্ষ, অপহরণ ও খুনোখুনির ঘটনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আশ্রয়শিবিরে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। তার বাহিনীর কয়েকশ সদস্য ইয়াবা, আইস ও সোনার কারবার নিয়ন্ত্রণ করে। শুরুর দিকে আরসার সঙ্গে মিলেমিশে মাদক চোরাচালান করতেন। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরসা থেকে বেরিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ শুরু করে নবী হোসেন। দল ভারি করতে নবী হোসেন কাছে টানেন আরএসওকে। এখন আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনী মিলে আশ্রয়শিবির থেকে আরসাকে উৎখাত করতে মরিয়া।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে। আশ্রয় শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের ২ হাজার ৩০০ সদস্য। উখিয়ার ২৬টি আশ্রয়শিবিরের মধ্যে ৫টির নিরাপত্তা দিচ্ছে ১৪ এপিবিএনের সাত শতাধিক সদস্য। রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। অন্যদিকে ১১টি শিবিরে নিরাপত্তা দিচ্ছে ৮ এপিবিএনের সমসংখ্যক সদস্য। ১১ শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন আরও তিন লাখের বেশি। শিবিরগুলোতে এপিবিএনের সদস্যরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টহল ও চৌকিতে তল্লাশি চালান। মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালান। কিন্তু সন্ধ্যার পর নিরাপত্তার অভাবে আশ্রয়শিবিরের দুর্গম পাহাড়ের সরু অলিগলিতে টহল পরিচালনা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ তথ্য উপদেষ্টার
করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা করার দাবি
শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলামের ১৬৩ ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকা অবরুদ্ধের নির্দেশ
যুক্তরাজ্য থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানিসহ ক্রয় কমিটিতে ৭ প্রস্তাব অনুমোদন
মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের মন্তব্যে তীব্র নিন্দা বাংলাদেশের
আরও
X

আরও পড়ুন

ঢাকাস্থ ফেনী ফোরাম এর উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল

ঢাকাস্থ ফেনী ফোরাম এর উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল

মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য অনন্য সেরা মাস মাহে রমজান

মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য অনন্য সেরা মাস মাহে রমজান

মধ্য রাতে নিরাপত্তা কর্মীদের মাঝে সাহরি বিতরণ করলো ইবি ছাত্রদল

মধ্য রাতে নিরাপত্তা কর্মীদের মাঝে সাহরি বিতরণ করলো ইবি ছাত্রদল

স্পেনের প্রথম ফুটবলার হিসেবে রোজা রেখে খেলবেন ইয়ামাল

স্পেনের প্রথম ফুটবলার হিসেবে রোজা রেখে খেলবেন ইয়ামাল

হুতিদের আক্রমণ ইরানের হামলা হিসেবে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র: ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

হুতিদের আক্রমণ ইরানের হামলা হিসেবে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র: ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

খিলক্ষেতে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোরকে ছিনিয়ে জনতার হামলা, আহত ছয় পুলিশ

খিলক্ষেতে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোরকে ছিনিয়ে জনতার হামলা, আহত ছয় পুলিশ

গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় হামাস সরকারের শীর্ষ নেতা নিহত

গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় হামাস সরকারের শীর্ষ নেতা নিহত

গণঅধিকার পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কমিটি গঠন

গণঅধিকার পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কমিটি গঠন

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ তথ্য উপদেষ্টার

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ তথ্য উপদেষ্টার

করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা করার দাবি

করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা করার দাবি

শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলামের ১৬৩ ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকা অবরুদ্ধের নির্দেশ

শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলামের ১৬৩ ব্যাংক হিসাবে ৬ কোটি টাকা অবরুদ্ধের নির্দেশ

যুক্তরাজ্য থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানিসহ ক্রয় কমিটিতে ৭ প্রস্তাব অনুমোদন

যুক্তরাজ্য থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানিসহ ক্রয় কমিটিতে ৭ প্রস্তাব অনুমোদন

আদালত চলতো হাসিনার নির্দেশে, মামলার রায় আসতো গণভবন থেকে: নুর

আদালত চলতো হাসিনার নির্দেশে, মামলার রায় আসতো গণভবন থেকে: নুর

সার্টিফিকেট ইস্যু না করায় রিট জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য রিমান্ড’

সার্টিফিকেট ইস্যু না করায় রিট জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য রিমান্ড’

দোহারের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা: আসামি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুদণ্ড

দোহারের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা: আসামি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুদণ্ড

কক্সবাজার শহরে উচ্ছেদের মুখে আতঙ্কগ্রস্থ হাজারো নারী-পুরুষ ঘরবাড়ি ও জমি রক্ষায় মানববন্ধন

কক্সবাজার শহরে উচ্ছেদের মুখে আতঙ্কগ্রস্থ হাজারো নারী-পুরুষ ঘরবাড়ি ও জমি রক্ষায় মানববন্ধন

কর্পোরেট জবাবদিহিতা ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার

কর্পোরেট জবাবদিহিতা ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের মন্তব্যে তীব্র নিন্দা বাংলাদেশের

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের মন্তব্যে তীব্র নিন্দা বাংলাদেশের

বাংলাদেশে ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ

বাংলাদেশে ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪১৩

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪১৩