মূল চ্যালেঞ্জ আর্থিক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা
২৭ মার্চ ২০২৩, ১১:৪৩ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ পিএম
আর্থিকখাতের দুর্বলতা মোকাবিলাই আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। গতকাল সোমবার সিপিডির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ : সিপিডির সুপারিশমালা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন। সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এক বছর আগেও অর্থনীতির সমস্যা বলতে আমরা সামষ্টিক বা ব্যষ্টিক পর্যায়ের ঝুঁকির কথা বলেছি। এটি এখন ব্যক্তি পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে এই বাড়তি ঝুকি এ সময়ের বড় সমস্যা। এটা আরও বিস্তৃত ও গভীর হয়েছে। এটা উত্তরোত্তর বাড়বে এবং শুধু সামষ্টিক বা ব্যস্টিক পর্যায়ে থাকবে না, ব্যক্তি পর্যায়ে বিস্তৃত হবে। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বাজার হিসাবে যে ভূমিকা পালন করার দরকার তার প্রক্রিয়া দ্রুত দুর্বল হচ্ছে। কোনো মেকানিজমই কাজ করছে না। যেটা জটিল হচ্ছে, বড়রা ছোট্টদের খেয়ে ফেলছে। বাজারে ক্রমশই ছোটরা আরও ছোট্ট হচ্ছে। বড়দের প্রভাব এখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়ছে।
সরকার আইএমএফ’র শর্তাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাচ্ছে উল্লেখ করে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই শর্ত ও সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য যথেষ্ট হবে না। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ’র শর্তের বাইরে গিয়েও বিভিন্ন রকম কার্যক্রম নেয়ার প্রয়োজন। বড় বড় খাতগুলোতে শ্রমিক ও কর্মচারীদের বিশেষ ইনক্রিমেন্টের সুপারিশ করে উল্লেখ করে সিপিডি’র এই গবেষক বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এক বছরের ব্যবধানে ২৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। এতে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার কষ্ট বেড়েছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলন, ভর্তুকির যে সমন্বয়, তা সঠিক পদক্ষেপ নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বলানি খাতে যে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে এবং এই ক্যাপাসিটির জন্য যে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, তার দায় ভোক্তার ঘাড়ে চাপানো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এই বাড়তি ক্যাপাসিটির জন্য যে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, তার কারণে সরকারকে ভর্তুকির দায় মেটাতে হচ্ছে। এই ক্যাপাসিটি চার্জের মতো কার্যক্রম থেকে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে। আগামীতে নতুন প্রকল্প নেয়া ও পুরাতন প্রকল্প নবায়নের ক্ষেত্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ ধরনের একটি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তোহলে ভর্তুকির দায় থেকে বিদ্যুৎ খাত বের হয়ে আসতে পারবে উল্লেখ করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
জ্বালানি খাতে যে উচ্চমূল্য আছে, তা বাজার নির্ভর হলে এই মুহূর্তে মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের হিসাবে বলছে, এই মুহূর্তে বিপিসি লাভের ভেতরে রয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ আমরা ভোক্তাকে দিতে পারছি না। সেই জায়গা থেকে বাজারভিত্তিক মূল্য কাঠামোতে যাওয়া এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে অদক্ষতা, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, দুর্নীতির সংশ্লেষের কথা বলা হচ্ছে—এগুলোর বিরুদ্ধে আগামীতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এটা না করে ভোক্তার ওপর বাড়তি খরচের দায় চাপিয়ে দেওয়া অবস্থা থেকে সরে আসার প্রয়োজন আছে।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, গরুর গোশত, চিনি, সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে অনেকে বেশি। সবসময় যে বিশ্ববাজারকে দোষারোপ করবো সেটি নয়। কর কিছুটা কমিয়ে এনে স্বস্তি দেয়া যেতে পারে। বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। যেকোনো সঙ্কট হলে, তার সুযোগ নিয়ে বাজারে যে সীমিত প্লেয়ার (আমদানিকারক) আছে, সীমিত সংখ্যক আমদানিকারক যারা এক একটি পণ্য আমদানি করে, তারাই কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-গোশত বাদ (কম্প্রোমাইজ) দিয়ে হিসাব করলে ঢাকায় চারজনের পরিবারে খাদ্যের পিছনে ব্যয় হবে ৭ হাজার ১৩১ টাকা। ফাহমিদা খাতুন বলেন, সেখানে মাছ-গোশত যুক্ত হলে ব্যয় তিনগুণ বেড়ে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকায় দাঁড়াবে। একজন শ্রমিকের মিনিমাম আয় এর চেয়ে অনেক কম। একই সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি, যা সরকারের প্রকাশিত গড় মূল্যস্ফীতির তথ্য দিয়ে বোঝা যায় না। আর তাই মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে সীমিত আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারি-বেসরকারিখাতে চাকরিরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জরুরিভিত্তিতে একটি ‘বিশেষ ইনক্রিমেন্ট’ দেয়া জরুরি বলে মনে করছে সিপিডি।
বাজেট প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এমন একটি সময়ে বাজেট প্রণীত হচ্ছে যখন বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ব্যাংক খাতের তারল্যে ব্যাপক নি¤œগামী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তারল্য ৬৬ হাজার ৫৮১ টাকা কমে গেছে। কারেন্সি সার্কুলেশন ব্যাংকগুলোর বাইরে বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সঞ্চয় করার প্রবণতাও কমছে। বাজারে অনিশ্চয়তা দেখছি। আর্থিক খাতে সুশাসনের কথা বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সেটা বলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম নি¤œমুখী হলেও স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। আমদানি ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে উল্লম্ফন দেখতে পারছি না, এক ধরনের অবনমন দেখা যাচ্ছে। পোশাক খাতের রফতানি বাড়ছে, তবে পোশাকবহির্ভূত রফতানি কমছে। নেট ফরেন এইড ১২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। যদিও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৪ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। ট্রেড ক্রেডিটে নেতিবাচক প্রভাব দেখছি।
দেশের অর্থনৈতিক দুঃসময়ের কারণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধকে আর অজুহাত করার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধকে সবসময় একটা কারণ হিসেবে বলে এসেছি। সেটা আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়া কিংবা অর্থনীতির ওপর বিভিন্ন চাপের ক্ষেত্রে বলেছি। সেটা আর একমাত্র অজুহাত বললে হবে না। অর্থনীতির ভেতরে যে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের ফলাফল কিছুটা থাকলেও বাকিটা দেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তার ওপরে নির্ভর করছে। কীভাবে সঙ্কটময় সময় পার করেছে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ নীতিমালা, সুশাসন, প্রয়োজনীয় সংস্কার না করার কারণে যে দুর্লতা সৃষ্টি হয়েছে। সেটাই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের প্রতিঘাত এখন বড় বিবেচ্য বিষয়, কিন্তু মূল নিয়ামক নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে সেটা করতে গেলে সরকারকে বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের আগের বছর সেটা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আহরণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে। আমরা গত ডিসেম্বরে বলেছি, এর পরিমাণটা ৬৪ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। চলতি ও আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ানো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখে আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো, পোশাকখাত বাদে অন্য রফতানি খাতে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া, সিগারেট-কোমল পানীয়তে কর বাড়ানো প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।#
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ছ’মাসেই পুরো বদল! মহারাষ্ট্রে ঝড় বিজেপির
আগে স্থানীয় নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ
জুলাই বিপ্লবে ছাত্র আন্দোলনে গুলি করা সেই তৌহিদ গ্রেপ্তার
রমজানে বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে : বাণিজ্য উপদেষ্টা
গণ-আন্দোলনে শহীদ পরিবারের অন্তত একজনের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে : সারজিস আলম
অনুমোদিত ৩৫০% নগদ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের বিতরন করল ওয়ালটন
আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২
শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার
ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার
শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা
ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো - বিটিভি মহা পরিচালক
নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ
প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার
৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!
২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল
মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন
বড় দরপতনের পর সোনার দামে আবার বড় লাফ
রাজবাড়ীতে ছাত্রদল নেতা অপহরণ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট
মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ