আল্লাহর রহমতের বিশালতা

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

০১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৭ পিএম

মহাসাগরের একটি ঘটনা। এক মাছের আত্মোপলব্ধি হলো। স্বগোত্রীয়দের ঝাঁকে গিয়ে সে আবেগি ভাষণ দিল, ভাইয়েরা বন্ধুরা! জীবনভর শুনে আসছি পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচে না আমাদের জীবন। পানির সান্নিধ্য পেলেই সার্থক হবে জীবন ও মরণ। কিন্তু সেই পানির দেখা পেলাম না কোথাও। মাছেরা সমস্বরে বলে উঠল, তাই তো। ছোটবেলা থেকে আমরাও শুনে আসছি । কিন্তু কোনোদিন পানির পরিচয় পাইনি, জানতে পারিনি তার ঠিকানা। পরস্পর পরামর্শে একটি তথ্য উঠে এল। অমুক সাগরে একটি বৃদ্ধ গুণিমাছ আছে, তত্ত্বজ্ঞানী, জীবন জগতের রহস্য তার জানা। তার দীক্ষা পেলে হয়ত আমাদের জীবন সার্থক হবে, পানির সন্ধান তিনি দিতে পারবেন। দল বেঁধে মাছেরা রওনা দিল আরেক মহাসাগরে বৃদ্ধ মাছের উদ্দেশ্যে। পথে বিপদ আপদে শত্রুর আক্রমণে অনেকের মৃত্যু হল। শেষ পর্যন্ত মাছের চৌকস দলটি তত্ত্বজ্ঞানী মাছের সম্মুখে উপনীত হল। দূরের সফরের ভোগান্তির সরুণ বর্ণনা দিয়ে তারা গুরুর কাছে বলল, জীবনভর শুনে আসছি পানি নামের কেউ আছে। তার সাথে আমাদের জীবন মরণ জড়িত। তার সাক্ষাত পেলে জীবন সার্থক হবে। কিন্তু জীবনে পানির সাক্ষাত পেলাম না। তার সন্ধান পেতে আমরা আপনার খেদমতে হাজির হয়েছি।

তত্ত্বজ্ঞানী মাছ বলল, তোমরা পানির খোঁজে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এতদূর এসেছ। আগে আমাকে বল তো, সাগর মহাসাগরে যার মধ্যে তোমাদের বসবাস তার নাম কি। বল তো তোমাদের জীবনকে ঘিরে পানি ছাড়া আর আছে কি। বৃদ্ধ মাছের একটি কথায় সবার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। হ্যাঁ, সত্যিই তো। আমরা তো পানির মধ্্েযই বসবাস করছি। আমাদের অস্তিত্ব ঘিরে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।

হ্যাঁ, আমরা মানুষের অবস্থাও তা-ই। অস্তিত্বের মহাসাগরে আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কি আছে? যার উপর আমাদের জীবন ভাসছে, জগত চলছে তা তো আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছু নয়। পবিত্র কুরআনে ফেরেশতাদের জবানীতে বলা হয়েছে :

‘ওহে আমাদের প্রভু! তুমি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিবেষ্ঠন করে আছ।’ (সূরা গাফির, আয়াত-৭)
‘আমার রহমত পরিব্যপ্ত সবকিছুতে।’ (সূরা ‘আরাফ, আয়াত-১৫৬)

আমরা আল্লাহর রহমতের সাগরে ডুবে আছি শুধু কী তা-ই। সৃষ্টিজগতের এতো আয়োজন, রহমতের বিশাল শামিয়ানা, ব্যবস্থাপনা সবই তো মানুষের জন্যে, মানুষের সেবায় নিয়োজিত। মানুষের কী সাধ্য আছে এই রহমত দয়া অনুগ্রহের বর্ণনা দেবে। কুরআন মজীদের ভাষায়-

‘আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা জাসিয়া, আয়াত-১৩)

‘তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্রকে আর নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অবশ্যই এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১২)
মহাকবি শেখ সাদী বলেন,

আবর ও বাদ ও মাহ ও খোরশীদ ও ফালাক দরকারান্দ
তাতো নানী বেকাফ আরি ওয়া বে গাফলাত নাখোরী
মেঘ-বায়ু চাঁদ সূর্য আকাশ সদা নিয়োজিত কাজে
তুমি রুটিরুজি জোগাড় কর, উদাসীন না খাও যাতে।
(শেখ সাদীর গুলিস্তানের ভূমিকা)
হে মানুষ! সৃষ্টিলোকের সবকিছু তোমার সেবায় নিয়োজিত। বিনিময়ে তিনি কী চান, তুমি যেন নিজের রুটিরুজির ব্যবস্থা কর আর আল্লাহকে ভুলে ভোগে মত্ত না হও।

একশ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত লোক বলতে চান, আল্লাহর দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। ধর্ম অধর্ম প্রভেদ মোল্লাদের আবিষ্কার। আকাশ চাঁদ সুরুজ বাতাস পানি সমান সেবা দেয় মুসলিম অমুসলিম সবার ঘরে, ক্ষেতে খামারে। সৃষ্টিলোকের অবারিত দয়াদানে তিনি ফারাক করেন না। কাজেই মুসলিম কাফেরে তারতম্যের ধারণা আল্লাহর সর্বজনীন পালনবাদের পরিপন্থী।

সরকার নতুন আবাদী, শহর বা জনপদ গড়ে তোলবে। ঘোষণা দিল বিস্তীর্ণ খাস জমিতে যে কেউ বসবাস করতে পারবে। তবে সরকারে কাছ থেকে বৈধ কাগজপত্র নিতে হবে। নামমাত্র খাজনা দিয়ে সরকারের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে। লোকেরা এই সুযোগে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন করল। একদল সরকারী আদেশ মেনে জমির বৈধ কাগজপত্র জোগাড় করল। আরেকদল এসবের পরওয়া করল না, সময়মত খাজনা দিল না, সরকারের অবাধ্য হল। এখন বলুন, উভয় দলের লোকেরাা কি এক সমান। সরকার যখন জমির মালিকানার তল্লাশি নিবে, অবস্থা কি হবে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের উচ্ছেদ হতে হবে, দুর্গতির সীমা থাকবে না। আর বৈধরা থাকবে আরামে নির্বিঘেœ। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর অনুগত মুসলমান ও অবাধ্য কাফেরদের অবস্থা এর সাথে তুলনীয়। যদিও উভয় শ্রেণী দুনিয়াতে আল্লাহর আলো বাতাস, মেঘ, সুযোগ সুবিধা সমানভাবে ভোগ করেছিল। আলো বাতাস সমান ভোগ করে বলে কি ভালো মন্দ, সৎ-চোর ডাকু একসমান দাবি করতে পারবে কোনো বিবেকবান মানুষ।

মানব জীবনে এই আত্মউপলব্ধির জন্যই দিনে রাতে বছরের পরিক্রমায় ধর্মীয় বিধান পালনের নানা আয়োজন আছে। এ ধরনের একটি আয়োজন পবিত্র মাহে রমযান। নবীজির ভাষায় এই মাসের শুরুর ভাগে অস্তিত্বের সাগরে রহমতের ঢেউ খেলে, মধ্যভাগে থাকে ক্ষমা ও মাগফিরাতের সয়লাব আর শেষভাগ দোযখ থেকে মুক্তির ছাড়পাত্র। এগুলো বিশ^ব্যবস্থায় অনুক্ষণ বিরাজিত আল্লাহর রহমতের একেকটি ঢেউয়ের ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করলেই দেখতে পাব সৃষ্টিলোকের সর্বত্র আল্লাহর রহমতের অথৈ সাগর। হাদিস শরীফের ভাষ্য:‘আল্লাহ তা‘আলার একশটি রহমত আছে। সেই একশ রহমত হতে একটিমাত্র রহমত তিনি সাত আসমান ও সাত তবকা যমীনে প্রেরণ করেছেন : (অতঃপর তা আপন সৃষ্টির মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন)। এই একটি রহমতের বদৌলতে তিনি সৃষ্টিলোককে ক্ষমা করেন। তার কারণে সৃষ্টিলোকের সবাই একে অপরকে ভালোবাসে, পরস্পরে দয়া-অনুগ্রহ দেখায়। বাকী নিরানব্বইটি রহমত তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন তিনি এই একটি রহমতও নিজের কাছে ফিরিয়ে নেবেন। দেখা যাবে, তাতে কোনো অপূর্ণতা হয় নি, ত্রুটির ছোঁয়া লাগেনি। সেটি বাকী নিরানব্বইটির সাথে যোগ করবেন। যাতে একশ পূর্ণ হয়ে যায়। তখন আল্লাহর সঙ্গে শিরিককারীদের মু’মিনদের থেকে আলাদা করা হবে, আর সব রহমত দেয়া হবে মু’মিনদেরকে। (বুখারী ও মুসলিম) মু’মিনরা কাফের মুশরিকসহ এই দুনিয়ায় একশ’র মধ্যে একটি রহমত ভোগ করেছে নিজের অন্তরে, ধর্মীয়ভাবে ও পার্থিব জীবনে। বৈধ কাগজপত্র যাদের নাই তারা কাল কিয়ামতে বাদ পড়বে আর পুরো একশভাগ রহমত লাভ করবে মুমিন মুসলমান রোজাদার নামাজি আল্লহর অনুগতরা।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী
খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান
আরও

আরও পড়ুন

জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে

জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে

হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা

হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা

সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক

সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী

সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী

খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল

খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল

থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই

হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন

সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি

সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি

‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’

‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’

আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক

আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক

বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম

বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম

ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩

ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩

নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ

নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ

হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী

হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী

হাসিনার ফ্যাসিজম নিয়ে সস্তা কথা টিকবে না : শফিকুল আলম

হাসিনার ফ্যাসিজম নিয়ে সস্তা কথা টিকবে না : শফিকুল আলম

চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ ২৮ জন আটক

চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ ২৮ জন আটক

ব্যাট হাতেও উজ্জ্বল অভিষিক্ত বশ,চালকের আসনে দক্ষিণ আফ্রিকা

ব্যাট হাতেও উজ্জ্বল অভিষিক্ত বশ,চালকের আসনে দক্ষিণ আফ্রিকা

১৬ বছরের অভিনেতার অকাল প্রয়াণে হলিউডে শোকের ছায়া

১৬ বছরের অভিনেতার অকাল প্রয়াণে হলিউডে শোকের ছায়া