ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১

কক্সবাজারে দস্যুদের অস্ত্রের কাছে অসহায় জেলেরা

Daily Inqilab কক্সবাজার জেলা সংবাদদাতা

০৪ মে ২০২৩, ১০:২০ পিএম | আপডেট: ০৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

 উপক‚লে দস্যু সিন্ডিকেটের ভয়ে ট্রলার মালিকরা দ্বারস্থ হন না প্রশাসনের
নজরদারির অভাবে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলসীমা। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে গুম, খুন, লুট, অপহরণসহ নিমর্ম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ট্রলার মালিক ও জেলেদের অভিযোগ, সাগরে কে জেলে, কে দস্যু, চিনতে না পারা, প্রশাসনের দায়হীনভাব ও উপক‚লে দস্যু সিন্ডিকেটের ভয়ে সবকিছু আড়ালে রয়ে যায়। নিরীহ জেলেদের সুরক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা জোরদারের দাবি উঠেছে।

বাঁকখালী নদীতে নোঙর করা ট্রলার খাজা আজমিরে অবস্থান করছেন জেলে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দীর্ঘ ১৭ বছরের জেলে জীবনে ৪ বারের বেশি সাগরে দস্যুদের হামলায় শিকার হয়েছেন। কিন্তু সাগরে দস্যুদের অস্ত্রের কাছে অসহায়ত্ব ও ভয়ের কারণ বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে ডাকাতি করছে বাঁশখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়ার দস্যুরা। কিছুদিন আগেও মাছ নিয়ে কক্সবাজার উপক‚লে ঢুকতে ছোট ট্রলার নিয়ে দস্যুরা ধাওয়া করেছে। আমরা দস্যুদের অস্ত্রের কাছে কিছু না। এসব বিষয় বোট মালিক সমিতিকে জানালোও কিছু হয় না। কারণ ট্রলার মালিকও ঐক্যবদ্ধ নয়। তারা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তাও করে না।’ শুধু জাহাঙ্গীর নন; একই অবস্থা কক্সবাজার উপক‚লের অন্যান্য জেলেদের। জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে সাগরে মৎস্য আহরণ। তাতে কেউ প্রাণ হারায়, কেউবা ভাগ্যের জোরে ফিরে আসেন। কিন্তু সাগরে গিয়ে জীবন বাঁচাতে দস্যুদের কাছে কিভাবে অসহায় হয়ে পড়েন তারও বর্ণনা দেন জেলেরা।

মহেশখালীর মোক্তার আহমদের মালিকানাধীন এফবি আল্লাহ দান ট্রলারের জেলে শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করি। এখানে মাছ শিকারের সময় দেখি সব জালে ট্রলার। দস্যুদের ট্রলার চেনার কোন উপায়ও নেই। দস্যু যারা রয়েছে তারা হঠাৎ করে সন্ধ্যা বা রাতে আক্রমণ করে বসে যা কোনোভাবেই বুঝার উপায় থাকে না।

এদিকে জেলেদের পাশাপাশি দস্যুদের কাছে জিম্মি ট্রলার মালিকরাও। ট্রলারের সবকিছু হারিয়ে উপক‚লে দস্যু সিন্ডিকেটের ভয়ে দ্বারস্থ হন না প্রশাসনের। আবার অনেকে প্রশাসনের কাছে গেলেও পান না সহযোগিতা এমন অভিযোগ করেছেন। ট্রলার মালিক মোহাম্মদ আবু বলেন, সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে আমার ট্রলারে জলদস্যুরা হানা দিয়ে ২২টি জাল নিয়ে মাঝিমাল্লাদের মারধর করে। এরপর ইঞ্জিনটি বিকল করে দিয়ে জলদস্যুরা চলে যায়। তারপরও আমরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেনি, কারণ জলদুস্যদের অনেক সিন্ডিকেট উপক‚লে রয়েছে। যারা দস্যুদের মাছ ও জাল বিক্রি করে। ওই সিন্ডিকেট প্রশাসনকে আমরা অভিযোগ করেছি এসব তথ্য দ্রæত দস্যু দিয়ে দিবে। ফের আমার ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে গেলে অপহরণ, হত্যা কিংবা মারধর করবে এই ভয়ে প্রশাসনকে জানায়নি।

মো. আবু আরও বলেন, প্রশাসন যদি এগুলো নিয়ে তদন্ত করে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। জলদসুদের মাছ কারা বিক্রি করে, ডাকাতির মালামাল কারা সামাল দেয় সবকিছু বের হয়ে আসবে। ফিশারিঘাটস্থ আড়তদার সমিতির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আজাদ বলেন, দস্যুদের নিরাপদ স্থান সাগর। কারণ দস্যুরা যখন সাগরে দস্যুতা করে, তখন জেলেরা বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করে। কিন্তু পুলিশ কিংবা কোস্টগার্ড সাগরে ঘটনাস্থলে যেতে যেতে দস্যুরা লুটপাট চালিয়ে চলে যায়। আর সাগরে যেখানে মাছ বেশি ধরা পড়ে সেখানে জলদস্যুদের দৌরাত্ম বেশি থাকে।

আরেক ট্রলার মালিক শফি উল্লাহ বলেন, সাগরে মাছ শিকারের সময় জলদস্যুরা ট্রলার ও মাঝিমাল্লা নিয়ে গেছে। এরপর মোবাইলে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। এসব বিষয় প্রশাসনকে জানালে পাত্তায় দেয় না তারা। কারণ সাগরে ঘটনা ঘটেছে। তারা একবার বলে সোনাদিয়ায় যাও, আবার বলে মহেশখালী যাও; পাতুয়ারটেক কিংবা উখিয়া যাও। এভাবে চলে যায় কিন্তু আমরা কোন সুরাহা পায় না। তবে নিরীহ জেলেদের সুরক্ষায় সাগরে নিরাপত্তা জোরদারের বিকল্প নেই মনে করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য।

কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, সাগরে মৎস্য সম্পদের ভাÐারে স্বভাব বশে হোক অথবা যেকোন ভাবেই বিচ্ছিন্ন কিছু জলদস্যুতার বিষয় আমাদের কানে আসে। সেই বিষয়গুলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী জিরো ট্রলারেন্স নীতি অবলম্বন করবে। সেখানে পুলিশ, নৌপুলিশ, র‌্যাব, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। প্রশাসন বলছে, সাগরে তাদের সীমাবদ্ধতা থাকা স্বত্তেও বহুমুখী তৎপরতায় কমেছে জলদস্যুতা। এব্যাপারে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু গভীর সাগরে পুলিশের তো সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট গÐির বাইরে গিয়ে টহল দেয়া যায় না। তারপরও যারা জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত বা সাগরে যারা অপরাধ করে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ কাজ করছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজার উপক‚লে ২০০১ সালে হিমঘরে বন্দি করে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ জেলেকে। এরপর ২০০৯ ও ১০ সালে কক্সবাজারের খুরুশকুলের ১৭ ও পেকুয়ার ১৪ জেলের লাশ উদ্ধার হয়েছিল। তারপর ২০১৩ সালে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ৩টি ট্রলারের ৩৪ জেলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। গত ২৩ এপ্রিল ট্রলারের হিমঘর উদ্ধার হয় ১০ জনের লাশ। এর বাইরে গত ৫ বছরের সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে কক্সবাজারের কমপক্ষে ২০ জেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন কয়েক শত। লুট হয়েছে কয়েক হাজার ট্রলার।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স