ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১
টানা ছুটিতে বহুরূপী সৌন্দর্যে ভরপুর স্পটগুলোতে পর্যটকের ঢল # সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারণার অভাবে পর্যটন শিল্পে বংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে -ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া # বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের উদারনীতি অবলম্বন করতে হবে -মো. মাহবুব আলী

পর্যটন অর্থনীতি সমৃদ্ধির সুযোগ

Daily Inqilab হাসান সোহেল

০৫ মে ২০২৩, ১১:১৭ পিএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

বৌদ্ধ ধর্র্মাবলম্বীদের অন্যতম উৎসব ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’র ছুটি ছিল গত বৃহষ্পতিবার। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার। সব মিলিয়ে তিন দিনের টানা ছুটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে। দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে ঘুরতে গেছেন কয়েক লাখ মানুষ। আর ডলার সঙ্কট ও আকাশচুম্বি বিমান ভাড়া হওয়ায় ভ্রমণ পিপাসুরা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত ও নেপালকে বাদ দিয়ে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভ্রমন পিপাসা মিটাতে দেশীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আগ্রহী হচ্ছেন। আবার অনেকেরই পরিবার নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সক্ষমতা না থাকায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তাই দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠেছে। সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে বাড়তি এক-দুই দিনের ছুটি পেলে এখন অনেকেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ছেন। আবার একদল তরুণ আছেন, নতুন দর্শনীয় স্থান আবিষ্কারের নেশায় সারা বছরই দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান। পাশাপাশি দেশের জনসংখ্যা বেশি হওয়ায়ও মানুষের এই ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা কাজে লাগিয়ে দেশীয় পর্যটনশিল্প এখন ক্রমেই বাড়ছে। তবে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের অনেক পর্যটনকেন্দ্রেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। আবার যেখানে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, সেখানে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ হচ্ছে না। অপরিকল্পিত অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কক্সবাজার। অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও হুমকির মুখে। একই অবস্থা তৈরি হয়েছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সিলেটের রাতারগুল, জলারবনসহ বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রে। আবার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র পর্যন্ত যাওয়ার যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো নয়। যদিও সরকারিভাবে দেশে পর্যটনশিল্পের প্রসারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড কাজ করছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পর্যটনকেন্দ্র এবং এগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে ১৭টি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সালে তৈরি জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় এ বিষয়ে সমন্বয়ের কথা বলা হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরে আছে কক্সবাজার। পরের অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পছন্দের তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট। হজরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত ছাড়াও সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত জায়গাগুলোতে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। বেড়ানোর তালিকায় আরও আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়পুর প্রভৃতি। ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকার খুব কাছে গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্টও এখন বেশ জনপ্রিয়।

পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) এবং সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি, ২০২৩ সালে তা আড়াই কোটিরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার।

সমুদ্র ও পাহাড় একসঙ্গে দেখার সুযোগ থাকায় কক্সবাজার দেশীয় পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আগে শীতের মৌসুমে বেশি ভিড় থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনায় মূখর থাকে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধার জন্য কক্সবাজারজুড়ে এখন ৫০০ হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে পাঁচতারকা মানের হোটেল যেমন রয়েছে, তেমনই আছে কম খরচে থাকার ব্যবস্থা। যদিও বিদেশি পর্যটক বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের জন্য এখনও সম্ভব হয়নি পৃথক জোন তৈরি। একই অবস্থা সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য স্পটগুলোতেও। তাই অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও উল্টো অবস্থা বিদেশি পর্যটক আগমনে। এমনকি দেশে এখন বছরে বিদেশ থেকে কত পর্যটক আসেন, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) হিসেবেও দেখা গেছে, দেশে বিদেশি পর্যটক কমেছে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৭ সালে বিদেশি নাগরিক আগমন করেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন। এছাড়া ২০১৮ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। ২০১৯ সালে বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে এসেছেন ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সাল নাগাদ বিদেশি এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন। আর ২০২১ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন শুধু ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন।

পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত বিদেশি নাগরিকরা পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তবে মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড বলছে, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি পর্যটক আসছেন তাদের মধ্যে ভ্রমণের উদ্দেশে আসছেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাকিরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, উন্নয়ন প্রকল্প ও এনজিওর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজে এসে থাকেন।

সূত্র মতে, প্রকৃতির বহুরূপী সৌন্দর্যে ভরপুর এ দেশে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা-কুয়াকাটা, দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি- আচার-অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পর্যটন শিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মডেল হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে দেশের ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি হবে পর্যটন খাত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সব আকর্ষণীয় উপাদান থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে ভ্রমণ পিপাসু বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। পর্যটকদের মানসম্মত সেবা ও নিরাপত্তার মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারছে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে যেমন নেই পর্যাপ্ত প্রচারণা, তেমনি সরকারি উদ্যোগেও পর্যটন খাতকে তুলে ধরতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। দেশের বাইরে দূতাবাসগুলো থেকেও পর্যটনবিষয়ক তথ্য পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, তথ্য নেই সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতেও। পিএটিএ প্রকাশিত তথ্য ছকে আমাদের আশপাশের সব দেশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাংলাদেশের কোনো তথ্য সেখানে নেই। সরকার নানা পরিকল্পনা নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন আধুনিক মানের হোটেল, দক্ষ ও মানসম্মত সেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিনোদন, নিরাপত্তা ও পর্যটনে সুষ্ঠু পরিবেশ বিকাশ করতে না পারাকেই দায়ি করছেন পর্যটনসংশ্লিষ্টরা। এদিকে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর না থাকায় বিদেশি পর্যটকদের অনীহার অন্যতম কারণ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক থাকায় পর্যটকদের আগ্রহ দেখা যায় না।

পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট ১ হাজার ৫১টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আকর্ষণীয় পর্যটন খাতে যেসব উপাদান থাকা দরকার যেমন-সমুদ্র, নদী, বন, পাহাড়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঋতুবৈচিত্র্য সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা রয়েছে ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট। এরপরও সাড়া মিলছে না বিদেশি পর্যটকদের। দিন দিন কমছে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা। বিদেশি পর্যটক মাত্র তিন থেকে পাঁচ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান শুধু ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ১০ শতাংশের উপরে অবদান রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১১০ কোটি পর্যটক প্রতি বছর ভ্রমণ করে থাকেন। সামনে এ পর্যটকের সংখ্যা দেড়শ কোটি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১৪০০ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ বিস্তৃত পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ঘাটতি থাকায় বিদেশি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, দেশের পর্যটনের সড়কগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। সমুদ্র সৈকতে ময়লা ও আবর্জনা সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। বিষয়গুলো সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে ব্র্যান্ডিং করতে পারলে বিদেশি পর্যটকদের সহজে আকৃষ্ট করতে পারবে বলে মনে করেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পকে তাদের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে রূপান্তর করলেও বংলাদেশ সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারণার অভাব এই সম্ভাবনার খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ওয়েবসাইটগুলোকে এখনো পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারিনি। এসব ওয়েবসাইটকে আরও তথ্যবহুল করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে একটি স্থান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রয়োজনীয় সবরকম তথ্য পেতে পারেন। ফেসবুক, টুইটারসহ গণমাধ্যমে প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিশাল সেবা খাত কাজে লাগাতে পারলে পর্যটনে বাংলাদেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার সমকক্ষ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের ইনকিলাবকে বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যদি তাদের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটনকে সম্পৃক্ত করে, তাহলেই এ খাতের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্য ট্যুরিজম বোর্ড চেষ্টা করে যাচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীর দুই পারে আলাদা পর্যটনকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় পদ্মাসহ টাঙ্গুয়ার হাওর, সুন্দরবনের স্মরণখোলার উন্নয়ন, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের চারপাশ উন্নয়ন এবং নিঝুম দ্বীপের উন্নয়ন এই ৫টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে ট্যুরিজম বোর্ড।

বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেছেন, জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুধু কক্সবাজারেই সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়া এই তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। পার্ক তিনটির কাজ সমাপ্তির পর প্রতি বছরে এতে বাড়তি ২শ’ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। কক্সবাজারের খুরুশকুলে শেখ হাসিনা টাওয়ার ও এথনিক ভিলেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের সহজ ও আরামদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিতে দেশের সব বিমান বন্দর উন্নয়নসহ কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে রেললাইন। দেশের পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নে পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে এই শিল্পের গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মো. মাহবুব আলী বলেন, আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের যে চাহিদা তা পূরণ করার মতো মন-মানসিকতা আমাদের নেই। সেই পরিবেশ বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তাই বিদেশি পর্যটক কম আসেন। আমাদের উদারনীতি অবলম্বন করতে হবে। অন্যান্য দেশে বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপারে খুব উদার। তবে আমাদের দেশে-বিদেশি পর্যটকদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা আরও বাড়াতে হবে।

এদিকে বিনোদনকেন্দ্রেগুলোয় শুক্রবারের দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় নিয়ে ব্যুরো ও সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-কক্সবাজার : ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’র ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটিতে টানা তিন দিনের অবকাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নেমেছে মানুষের ঢল। তাদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হোটেল, মোটেল ও রেস্তোঁরাগুলো। এ ছাড়া সৈকতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরাপত্তা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফগার্ড কর্মীদের। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্য মতে, টানা ছুটিতে প্রায় ৩ লাখ পর্যটক এসেছেন। কক্সবাজারের ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস-কটেজের কক্ষ আগ থেকেই বুকিং হয়ে আছে। একাধিক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজ-কটেজগুলোর ধারণক্ষমতা ২ লাখের মতো। টানা ছুটিতে বেশি পর্যটক ভিড় করায় তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

সাজেক ভ্যালিতে পর্যটকের ভিড় : মেঘ-পাহাড়ের মিতালির দেশ সাজেক ভ্যালিতে পর্যটকরা হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে ঠাঁই না পেয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় রাত কাটাচ্ছে। এ ছাড়াও একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ থাকায় মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালিতেও উপছে পড়া ভিড়। অনেক পর্যটককে গেস্ট হাউস বা রিসোর্টে রুম না পেয়ে বিকল্পভাবে থাকতে হচ্ছে। আর এই ছুটির কারণে সব পর্যটক একসঙ্গে জড়ো হওয়ায় রিসোর্টগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। যারা অগ্রিম বুকিং করে রেখেছেন সাজেকের রিসোর্টগুলো, তারা আছেন খোশমেজাজে।

সুন্দরবনে পর্যটকদের ভিড় : টানা তিন দিনের ছুটিতে সুন্দরবনের করমজলে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। গত বুধবার থেকেই এ ভিড় শুরু হতে থাকে। আগত পর্যটকরা ট্রলার ও লঞ্চযোগে বনের নানা জায়গায় ছুটে বেরিয়ে উপভোগ করছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এদিকে শুক্রবার পর্যটকদের ভিড় সামলাতে বনরক্ষীদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। এর ওপর আবার ভিআইপিদেরও সামলাতে হচ্ছে তাদের। আজ শনিবার এই চাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন করমজল পর্যটন স্পটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। ঢাকা থেকে করমজলে আসা স্কুল শিক্ষিকা তানিয়া আক্তার জানান, পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় আসা যায় বলে সপরিবারে আমরা সুন্দরবন ভ্রমণে ছুটে এসেছি। আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন এখানে।

পর্যটকে পরিপূর্ণ কুয়াকাটা : টানা ছুটিতে ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড়ে সাগরকন্যা কুয়াকাটায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বুধবার বিকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের আগমন ঘটে কুয়াকাটায়। আগতদের অনেকে গঙ্গামতি, লাল কাঁকড়ার চর, ঝাউ বাগান, জিরো পয়েন্ট, লেম্বুর চর, শুঁটকিপল্লি, ঝিনুক মার্কেট, রাখাইন মার্কেট, শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার, রাখাইন পল্লি, ইলিশ পার্ক, সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন, সীমা বৌদ্ধ বিহারসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্পটে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে সৈকতে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়িতে চড়ছেন, অনেকে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নাচে-গানে মেতে উঠেছেন, কেউ বা খেলা করছেন সৈকতের বালু নিয়ে, কেউ প্রিয় জনকে সঙ্গে নিয়ে সৈকতের বেঞ্চিতে বসে উপভোগ করছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ দৃশ্য, কেউ বা সমুদ্র স্নানের মজা নিচ্ছেন। অনেকে আবার ফাতরার বন ও চর বিজয়ে গিয়ে ম্যানগ্রোভ বন, বন্যপ্রাণী ও অতিথি পাখির ওড়া-উড়ির দৃশ্য দেখে মোহিত হচ্ছেন। দিনভর ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় সৈকতে আড্ডা ও গানের পাশাপাশি অনেকেই ভিড় করছেন ফিশ ফ্রাই ও চটপটির দোকানে। নিচ্ছেন চটপটি, ফুসকা, ঝালমুড়ি অথবা বিভিন্ন ধরনের মাছ বারবিকিউ ও কাঁকড়া ফ্রাইয়ের স্বাদ। এদিকে ব্যস্ত সময় পার করছেন হোটেল-মোটেল, রেস্তোঁরা, মার্কেটসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ী। পর্যটকের এমন ভিড়ে বুকিং রয়েছে কুয়াকাটার শতভাগ হোটেল ও রিসোর্ট। প্রাণচাঞ্চল্য হয়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। হাসি ফুটেছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের মুখে। কুয়াকাটা সৈকতসংলগ্ন ঝিনুক ও বাজার ব্যবসায়ী শিমুল জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। তবে গতকাল শুক্রবার পর্যটকে পরিপূর্ণ ছিল কুয়াকাটা সৈকত। আমাদের বিক্রি আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। তবে আগত পর্যটকদের কাছে খাবারমূল্য ও হোটেল ভাড়া বেশি রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে অতিরিক্ত যানবাহন বাড়া, হকার ও ভিক্ষুকের উৎপাত।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স