প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরসূরী রাখছেন না

Daily Inqilab দ্য ইকোনোমিস্ট

২৫ মে ২০২৩, ১১:২৩ পিএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১১:২৩ পিএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকা নারী সরকার প্রধান এবং বর্তমানে বিশে^র উল্লেখযোগ্য শাসকদের অন্যতম। দুই দশকের সময় ক্ষমতায় থেকে তিনি তার ১৭ কোটি মানুষের দেশে উল্লেখযোগ্য দারিদ্র্য বিমোচনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা সেই সময়ের বেশিরভাগ সময়ে ৭ শতাংশ গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির দ্বারা উজ্জীবিত। ৭৫ বছর বয়সী এই নেতা তার দল আওয়ামী লীগকে টানা ৩টি সহ মোট ৪টি নির্বাচনে জয়ী করেছেন, যা ইন্দিরা গান্ধী বা মার্গারেট থ্যাচারের চেয়ে একটি বেশি।
আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনেও তিনি জিতবেন বলে ধারনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ভার্জিনিয়ায় দ্য ইকোনমিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তার উচ্চাকাক্সক্ষার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‹আমি এই দেশটিকে একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ করতে চাই।› তারপরে হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‹আপনি কি ভাবতে পারেন যে,  তারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওরা আমার ভাই, আমার মা, মাত্র ১০ বছরের আরেক ভাইকে হত্যা করেছে! আমার দুই ভাবি, আমার একমাত্র চাচা, একজন প্রতিবন্ধীকেও।’ এখন, বাংলাদেশিদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই নেত্রীর ক্ষোভ এবং বংশীয় অধিকার তার রাজনৈতিক উত্তরসূরী এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে কিনা। কোনো রাজনীতিবিদই সমালোচনা পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার সামান্যতম সমালোচনাতেও ক্ষব্ধ হয়ে পড়েন এবং প্রতিক্রিস্বরূপ তার নিজের ব্যতীত প্রায় প্রতিটি বাংলাদেশী সরকারেরই একচেটিয়া সমালোচনায় নিয়োজিত হন। তাকে দুর্নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত সামরিক সরকারকে দায়ী করেন, তার সরকারের সদস্যদের জড়িত থাকার একটি সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিতে বিশ্বব্যাংককে অভিযোগে উদ্ভাবনের জন্য অভিযুক্ত করেন, তারপর দাবি করেন যে বর্তমানে সমস্যাটির কোনও অস্তিত্ব নেই। তার সরকারের দুর্নিতীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হয়তো নিম্ন স্তরে রয়েছে, কিন্তু আজকাল তাও তেমন একটা নয়। তারা এটা করার স্পর্ধা করলে, আমি ব্যবস্থা নেব।’
তালেবান শাসনের আগপর্যন্ত আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হত। সরকারের কিছু দুর্নীতি বাস্তবে একটি একদলীয় রাষ্ট্রের লক্ষণ দেখিয়েছে, যা শেখ হাসিনা তার পিতার উচ্চাকাক্সক্ষা প‚রণ করতে তৈরি করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি পুন:নির্বাচিত হওয়ার আগে, আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বারবার ক্ষমতার হাত বদল ঘটেছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও গণমাধ্যম, পুলিশ এবং আদালত সহ দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলি কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছিল। এখন বেগম জিয়া যখন-তখন গৃহবন্দী থাকছেন, তার দলের কর্মী-সমর্থকরা হামলার শিকার হচ্ছেন, গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এবং পুলিশ ও আদালত শেখ হাসিনার আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হয়েছে।
আগামী নির্বাচন বিএনপিকে ক্ষমতায় ফেরার পথ দেখাবে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে একটি অবাধ ভোটের জন্য প্রতিশ্রæতিবদ্ধ বলে দাবি করেন, তিনি বলেছেন যে, শুধুমাত্র একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার অনুমতি দেওয়া উচিত এবং তার বিরোধীরা মানদÐের সাথে খাপ খায় না। বিএনপিকে তিনি অর্ধশতাব্দী আগে সেনা শাসনের মধ্য দিয়ে একজন সামরিক শাসকের অবৈধভাবে গঠিত সংগঠন বলে অভিযোগ করেন। তিনি এও অভিযোগ করেন যে, দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল পাকিস্তানের সাবেক মিত্র এবং তাদের প্রায় সবাই যুদ্ধাপরাধী। তার মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশে এমন কোনো দল নেই (আওয়ামী লীগ ছাড়া) যারা সত্যিকার অর্থে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারে। বাংলাদেশের বিভেদপূর্ণ জনগণের অনেকাংশ এখন তার কট্টরতার বিরোধিতা করছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি বলছে যে, নির্বাচন সহিংস হতে পারে। 
কোনো না কোনোভাবে, বাংলাদেশ সম্ভবত তার লৌহ কব্জা থেকে উপকৃত হয়েছে। তবে এটি স্পষ্টতই দেশের প্রবৃদ্ধির হারকে বাড়িয়ে তোলেনি, যা তার প্রশাসনের বর্ধিত সময়ের আগেই শীর্ষে পৌছেছিল। এবং এটি ম‚লত দেশের পোশাক শিল্প এবং অভিজাত এনজিওগুলি প্রদত্ত পরিষেবাগুলির মতো প‚র্ব-বিদ্যমান কারণগুলির একটি ফলাফল। তবুও তিনি নীতিমালা তৈরি করেছেন, যার মধ্যে অবকাঠামো বিনিয়োগও প্রবুদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে, যা কোনও দুর্বল সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু স্বৈরশাসনে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। তাই পোশাকের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশকে নতুন রপ্তানি বিকাশ করতে হবে। এই বাস্তবতাটি সরকার খুব কমই মোকাবেলা করছে। শেখ হাসিনা বলেছেন যে, তার সরকার হস্তশিল্প এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বিকাশের দিকে নজর দিচ্ছে, যা একটি অপর্যাপ্ত সমাধান।
যুক্তরাষ্ট্র একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে বলেছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শ্বাস নিতে দিতে। এখন এটি প্রধানত উদ্বিগ্ন যে, তার চীনকে স্থান দেওয়া উচিত নয়, যা তার সরকার বিনিয়োগের জন্য প্রশ্রয় দিচ্ছে। ভারত, যেখানে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, একই দৃষ্টিভঙ্গি রাখে। শেখ হাসিনা এই ৩টি পক্ষকেই সামলাতে পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‹যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক তাদের নিজস্ব বিষয়। আমি কেন সেখানে নাক গলাব?’ তারওপর, একসময় বেগম জিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার জন্য তিনি মার্কিন প্রশাসনকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘তারা বলে তারা গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু আমাদের দেশে তারা সেই অনুশীলন করে না। কেন তারা আমাকে সমর্থন করে না?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এবং ক্ষমতার নির্মম ব্যবহারের ইতিহাসের মধ্যে কিছু নীতিগত সাফল্য এবং প্রবৃদ্ধির মহাকাব্য শুনিয়ে থাকেন, যা তার নেই, কিন্তু দাবি করেন। এই কাহিনীর শেষ কীভাবে হবে, তা অনুমাণ করা কঠিন। তিনি ক্রমবর্ধমানভাবে স্বৈরাচারী ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছেন এবং তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, অবসর নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা তার নেই। কারণ তার সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনার শিরোনাম হল ‘ভিশন ২০৪১’। তিনি এটি দেখতে পাবেন না, তিনি স্বীকার করেছেন। তারপরেও, ক্ষমতায় তৃতীয় দশক পার করার পরেও উত্তরসূরী নির্বাচনের পরিকল্পনা তার নেই। কারণ তিনি বলেছেন, ‹আমি যদি তখন না থাকি। কে ক্ষমতায় আসবে জানি না।’


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
আজ জামায়াতের ইফতার, বিএনপির ইফতারে নেতাদের ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য
মার্কিন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বৈঠক
এবার বেশি দামেই খেতে হবে আলু
প্রাথমিকের শেষ ধাপের পরীক্ষা আজ
আরও

আরও পড়ুন

'দুর্নীতির টাকায় কেনা', মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

'দুর্নীতির টাকায় কেনা', মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

লোহাগড়ায় আওয়ামীলীগ নেতাকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসাতে যেয়ে জিয়া চৌধুরী নামে এক যুবক গ্রেফতার

লোহাগড়ায় আওয়ামীলীগ নেতাকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসাতে যেয়ে জিয়া চৌধুরী নামে এক যুবক গ্রেফতার

বেনাপোলে পায়ূপথে মিলল ৬টি স্বর্ণেরবার, পাচারকারী আটক

বেনাপোলে পায়ূপথে মিলল ৬টি স্বর্ণেরবার, পাচারকারী আটক

গাজীপুরে ককটেল ফাটিয়ে স্বর্ণালংকার ও টাকা লুটের চেষ্টা

গাজীপুরে ককটেল ফাটিয়ে স্বর্ণালংকার ও টাকা লুটের চেষ্টা

বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের

বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের

আজ জামায়াতের ইফতার, বিএনপির ইফতারে নেতাদের ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য

আজ জামায়াতের ইফতার, বিএনপির ইফতারে নেতাদের ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য

নোয়াখালীতে ইফতার মাহফিলে যাবার পথে সড়কে ট্রাকচাপায় মৃত্যু প্রবাসীর

নোয়াখালীতে ইফতার মাহফিলে যাবার পথে সড়কে ট্রাকচাপায় মৃত্যু প্রবাসীর

ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধে ১৩০ ব্রিটিশ এমপির চিঠি

ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধে ১৩০ ব্রিটিশ এমপির চিঠি

মিরজাফরের পাশে ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র! পূর্বপুরুষের ‘বেঈমানি’ নিয়ে বিপাকে বিজেপি প্রার্থী

মিরজাফরের পাশে ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র! পূর্বপুরুষের ‘বেঈমানি’ নিয়ে বিপাকে বিজেপি প্রার্থী

কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ইফতার পার্টিতে মমতা

কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ইফতার পার্টিতে মমতা

মেঘনায় লঞ্চের ধাক্কায় ট্রলার ডুবে চালকের মৃত্যু

মেঘনায় লঞ্চের ধাক্কায় ট্রলার ডুবে চালকের মৃত্যু

গাজীপুরে প্যাকেজিং কারখানায় আগুন

গাজীপুরে প্যাকেজিং কারখানায় আগুন

বিএনপির সাবেক এমপি নজির হোসেন মারা গেছেন

বিএনপির সাবেক এমপি নজির হোসেন মারা গেছেন

মাগুরায় চোরাই মোটরসাইকেল ও চোরাই মালামাল উদ্ধার, ৩ চোর আটক

মাগুরায় চোরাই মোটরসাইকেল ও চোরাই মালামাল উদ্ধার, ৩ চোর আটক

মার্কিন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বৈঠক

মার্কিন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বৈঠক

গরুচোর সন্দেহে গাজীপুরে গণপিটুনিতে দুই যুবক নিহত

গরুচোর সন্দেহে গাজীপুরে গণপিটুনিতে দুই যুবক নিহত

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বিগ্ন চীন

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বিগ্ন চীন

এবার বেশি দামেই খেতে হবে আলু

এবার বেশি দামেই খেতে হবে আলু

এশিয়ার সবচেয়ে ধনী নারীর কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান

এশিয়ার সবচেয়ে ধনী নারীর কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান

সিরিয়াতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩৩ সেনা নিহত

সিরিয়াতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩৩ সেনা নিহত