অল্প পরিশ্রমে অধিক আয়ের লোভ কক্সবাজার থেকে একটি ট্রিপ নিয়ে আসলে বাস চালক পান ৩ হাজার টাকা, আর একটা ইয়াবার চালান নিয়ে আসলে পান ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা

মাদক পাচারে বাসচালক-হেলপার

Daily Inqilab সাখাওয়াত হোসেন

০৪ জুন ২০২৩, ১০:৫২ পিএম | আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। নানাভাবে নানা উপায়ে ভয়ংকর সব মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এসব মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে দেশের তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হয়ে উঠছে। যেমন মাদক সেবনকারীদের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি সহজে অর্থলাভের আশায় মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থ আয়ের লোভে এক শ্রেণির বাসচালক ও হেলপার মাদক পাচারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মাদক পাচারে তাদের প্রবণতা দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাস চালকদের সম্পৃক্ততায় মাদক পরিবহন ঠেকানো জরুরি হয়ে পড়েছে। লোভে পড়ে চালক-হেলপার ও শ্রমিকরা মাদক পরিবহনে জড়াচ্ছেন। সেখান থেকে তাদের ফেরাতে পরিবহন মালিক, চালক, সহকারী, শ্রমিক, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাবে বাসে মাদক পরিবহন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য বলছে, চলতি বছরে শুধু মার্চ মাসেই বিভিন্ন বাস থেকে তারা প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে। এছাড়া ২০২২ সালের ড্রাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জব্দ হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ৬৬ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট।

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা থেকে কক্সবাজার রোডে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের বাসচালক ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছে। ইদানিং বাসচালকরা মাদক পরিবহনের সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে জড়িয়ে পড়ছেন বলে ডিএনসির কাছে তথ্য রয়েছে। এ বিষয়ে ডিএনসির নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষ করে সৌদিয়া পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি পরিবহনের চালকদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এমন কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক পাচারে মোটা অঙ্কের টাকা পান পাচারকারীরা। টাকার লোভ সামলানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অনেকে মাদক পরিবহনে যুক্ত হয়ে পড়ছেন।

দেখা গেছে, কক্সবাজার থেকে একজন গাড়িচালক একটি ট্রিপ নিয়ে ঢাকায় আসলে যে পরিমাণ টাকা পান, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা তারা পান ঢাকায় একটি ইয়াবার চালান নিয়ে আসলে। এই লোভে পড়ে দিনদিন মাদক পরিবহনে যুক্ত হওয়া বাসচালকদের সংখ্যা বাড়ছে। এটি কাজে লাগিয়ে মাদককারবারিরা চালকদের নিজেদের পাতা জালে ফেলছেন।

ঢাকা-কক্সবাজারে চলাচলকারী একটি পরিবহনের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, আগে শোনা যেত হাতে গোনা কয়েকজন মাদকাসক্ত বাসচালক কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে আসত। এখন দেখা যায় যারা কোনো দিন মাদক কিংবা সিগারেট পান করেনি, এমন চালকরাও ইয়াবাসহ ধরা পড়ছে। আসলে কক্সবাজারের ইয়াবাকারবারিরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চালকদের লোভে ফেলছে। দেখা যায়, কক্সবাজার থেকে একটি ট্রিপ নিয়ে আসলে যদি তিনি তিন হাজার টাকা পান, একটা ইয়াবার চালান নিয়ে আসলে পান ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই লোভে পড়ে অনেক চালক বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার কিংবা টেকনাফ থেকে সড়কে পথে ইয়াবার চালান ঢাকায় আসা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে কক্সবাজার থেকে যাত্রীবাহী বাসে বিশেষ করে রাজধানীতে মাদকের চোরাচালান বেড়ে গেছে। অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থ আয়ের লোভে এক শ্রেণির বাসচালক ও হেলপার মাদক পাচারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মাদক পাচারে তাদের প্রবণতা দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঢাকা-কক্সবাজারে চলাচলকারী একটি পরিবহনের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা এ রুটে চলাচলকারী গাড়ির চালকদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে, কোনো চালকের বিষয়ে সন্দেহ হলে দ্রুত আমরা তাদের জানাব।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভিাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল ইনকিলাবকে বলেন, ইদানিং বিভিন্ন পরিবহনের বাস চালকরা মাদকদ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা কক্সবাজারগামী বিভিন্ন পরিবহনের বেশ কয়েকজন বাস চালককে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে বাসও জব্দ করা হয়েছে। মাদকের চালান বহনের ক্ষেত্রে বাস চালকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। অভিযান চালিয়ে মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে সৌদিয়া পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের চালককে, জব্দ হয়েছে বাসও। তিনি আরো বলেন, বাসে মাদক পরিবহন ঠেকাতে বাসমালিক, চালক, সুপারভাইজার, সহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা প্রয়োজন। ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা না থাকায় বাসে করে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মাদক চোরাচালান চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গত ১৯ মে শুক্রবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি দল রাজধানীর ভাটারা ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মারসা পরিবহন থেকে ২১ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় বাসের চালক মাহমুদুল করিম (৪৩), মাদক ব্যবসায়ী রুমা আক্তার (৪২), নকিবুল ইসলাম (২১) ও মো. মোস্তফা কামাল ওরফে কামাল।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা উত্তরের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, ইয়াবার একটি চালান কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসছে এবং এগুলো ঢাকায় দুই-তিন স্থানে সরবরাহ করবে এমন তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযান চালানো হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা বড়ি সংগ্রহ করে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে আসছিলেন। চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এর আগে গত ১৩ মে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার দক্ষিণ পাশ থেকে চট্র মেট্রো-ব-১১-১০৪২ নম্বরের সৌদিয়া বাসের চালক দুলাল সরকারকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৭ হাজার ৩শ পিস ইয়াবা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সাংবাদিকদের বলেন, কোনো মালিকই চান না তার পরিবহনের মাদক বহন করা হোক, বিষয়টি ঠেকাতে মালিকরাও সচেষ্ট থাকে বলে দাবি করেছেন । তিনি বলেন, পরিবহন সংশ্লিষ্ট কেউ মাদক ব্যবসা বা বহনের সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমরা চাই, আইন শৃঙ্খলবাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিক। কেননা, কোনো মালিকই চাইবে না, তার গাড়িতে মাদক বহন করা হউক। সংশ্লিষ্ট সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় মাদক বহনে চালকসহ অন্যদের জড়িত হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারকে গতিশীল করতে হবে-  উপদেষ্টা শারমীন

ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারকে গতিশীল করতে হবে- উপদেষ্টা শারমীন

এইচএমপিভি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৭ নির্দেশনা

এইচএমপিভি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৭ নির্দেশনা

পাংশায় মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে  মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে

পাংশায় মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে  মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে

শফিক রেহমান-রহমান মুরুব্বী এক্সপোজড

শফিক রেহমান-রহমান মুরুব্বী এক্সপোজড

রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া রুটে বাস চলাচল বন্ধ, চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা

রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া রুটে বাস চলাচল বন্ধ, চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা

মেহেরপুর জেলা বিএনপির নেতাদের বাগোয়ান বাসীর সংবর্ধনা

মেহেরপুর জেলা বিএনপির নেতাদের বাগোয়ান বাসীর সংবর্ধনা

জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন

জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন

কৃষির সাথে যেমন কৃষকের সম্পর্ক তেমনি দেশের জনগনের সাথে বিএনপির সম্পর্ক :  শামীম তালুকদার

কৃষির সাথে যেমন কৃষকের সম্পর্ক তেমনি দেশের জনগনের সাথে বিএনপির সম্পর্ক : শামীম তালুকদার

৪২ চার ও ১৬ ছক্কায় অপরাজিত ৩৪৬!

৪২ চার ও ১৬ ছক্কায় অপরাজিত ৩৪৬!

কুমারখালীতে টিসিবির পণ্য বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে বিক্ষোভ

কুমারখালীতে টিসিবির পণ্য বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে বিক্ষোভ

দেশের ৬০ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কৃষকের স্বার্থে কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি'

দেশের ৬০ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কৃষকের স্বার্থে কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি'

নিজের বিয়ে নিয়ে কি বললেন পড়শী

নিজের বিয়ে নিয়ে কি বললেন পড়শী

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যায় ব্যবহৃত চাকুসহ আরো এক আসামী  গ্রেফতার

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যায় ব্যবহৃত চাকুসহ আরো এক আসামী গ্রেফতার

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরও ৬০ দিন বাড়লো

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরও ৬০ দিন বাড়লো

৪২ মিনিটেই নেইমারের আয় ১০১ মিলিয়ন ইউরো

৪২ মিনিটেই নেইমারের আয় ১০১ মিলিয়ন ইউরো

ফেব্রুয়ারিতে পার্স-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে ইরান

ফেব্রুয়ারিতে পার্স-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে ইরান

মাগুরায় পিলখানা হত্যাকান্ডে হত্যাকারী ও পরকল্পনাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

মাগুরায় পিলখানা হত্যাকান্ডে হত্যাকারী ও পরকল্পনাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

কসাই থেকে নদীখেকো জাফর

কসাই থেকে নদীখেকো জাফর

পাঁচ দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের পাঁচ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

পাঁচ দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের পাঁচ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

ফ্যাসিবাদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সক্রিয় ছিল ইবি ছাত্রদল

ফ্যাসিবাদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সক্রিয় ছিল ইবি ছাত্রদল