ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১
হ্রদের তলদেশে পলিথিনের স্তর হুমকিতে কৃষি-মৎস্য উৎপাদন ও ওই এলাকার জীবন-জীবিকা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কাপ্তাই হ্রদ যেন পয়োঃনিষ্কাশনের ভাগার

দূষণে বিপর্যস্ত কাপ্তাই হ্রদ

Daily Inqilab সৈয়দ মাহাবুব আহামদ, রাঙামাটি থেকে

০৬ জুন ২০২৩, ১০:৪৯ পিএম | আপডেট: ০৭ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশের এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই নানা দূষণে এখন বিপর্যস্ত। দূষণের ফলে মিঠা পানির মাছের ভান্ডার হিসাবে খ্যাত এই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের পরিমাণ দিন দিনই কমে যাচ্ছে। এক সময় এ হ্রদে রুই বা কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৮১ শতাংশ। বর্তমানে তা ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। এক সময় লেকের পানি প্রচন্ড রকমের স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কাপ্তাই লেকের পানির সেই অতি স্বচ্ছতায় কিছুটা মলিনতা এসেছে। দখল ও দূষণে এ হ্রদ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য় হারাচ্ছে। আর তাতে পর্যটকদের আকর্ষণও কমে যাচ্ছে।
এ হ্রদের আয়তন ৬৮৮০০ হেক্টর এবং জলায়তন ৫৮,০০০ হেক্টর যা আভ্যন্তরিণ জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ লেকটি মূলত তৈরি হলেও মৎস্য উৎপাদন, কৃষিজ উৎপাদন, জলপথে যাতায়াত, ফলজ ও বনজ দ্রব্য দুর্গম পথে পরিবহন, জেলে, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে মৎস্য সেক্টরে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।

এ হ্রদকে ঘিরেই পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। রাঙামাটির অন্যতম ব্যবসা মাছ ও কাঠ ব্যবসা। যা কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্ভরশীল। কাপ্তাই হ্রদের মাছ রাঙামাটির চাহিদা মিঠিয়ে জেলার বাইরে বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা মেটায়। এ ছাড়া পার্বত্য রাঙামাটি জেলার সবগুলো উপজেলার সাথে এখনো সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেনি। এখনো অধিকাংশ উপজেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। এ নৌপথ গড়ে উঠেছে কাপ্তাই হ্রদের উপর। কাপ্তাই হ্রদ বা লেকের কারণেই রাঙামাটির পর্যটন শিল্প পেয়েছে অন্যরকম প্রাণ শক্তি। লেক ভ্রমণ ও জেলার বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান পরিদর্শনে সারা বছরই এখানে পর্যটকের ভিড় থাকে।

পার্বত্য অঞ্চলের জন্য এ হ্রদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হ্রদ বাঁচলে রাঙামাটির মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা ঠিক থাকবে। লেকের পরিবেশ ঠিক থাকলে মাছ বাঁচবে। মাছ বাঁচলে জেলেরা বাঁচবে। হ্রদের পানির পরিবেশ ভাল থাকলেই এই হ্রদ পর্যটক আকৃষ্ট করবে।

অথচ দিনের পর দিন হ্রদের পরিবেশ যে হারে নষ্ট হচ্ছে তা পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জন্য হুমকি স্বরূপ। কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেষে যেসব বসত-বাড়ি গড়ে উঠেছে তার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত নির্মাণ। বেশিরভাগ বাড়ির খুটিগুলো বর্ষায় লেকের পানি বাড়লে পানিতে ডুবন্ত থাকে। হ্রদ বা লেকের ধারে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির টয়লেটের টাংকি থাকে ঘরের নিচে। বর্ষার সময় হ্রদে পানি বাড়লে তা ডুবে যায়। এছাড়া খোঁজ করলে এমন কিছু বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে যেসব বাড়িতে মানুষের বর্জ্যের কোন টাংকিই নেই। মানুষের বর্জ্য সরাসরি পড়ছে হ্রদের পানিতে। হ্রদের তীর ঘেষে গড়ে উঠা বস্তিতে বসবাসকারী লোকজনের ময়লা, আবর্জনা, বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত কাপ্তাই লেকের পানি। এতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কাপ্তাই হ্রদ এখন পয়ো নিষ্কাশনের ভাগারে পরিণত হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকরা হ্রদে যে হারে বিভিন্ন প্রকার প্লাষ্টিক দ্রব্য ফেলছে তাতে আশংকা করা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ প্লাস্টিক বা পলিথিনের কয়েক ফুট স্তর পড়েছে। এসব প্লাষ্টিক এক সময়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ক্ষুদ্র প্লাষ্টিক কণাতে রূপান্তরিত হবে। এ ক্ষুদ্র প্লাষ্টিক কনা গুলো ছোট মাছেরা খায়, আর এ ছোট মাছ গুলো বড় মাছেরা খায়। পরে এই বড় মাছগুলো মানুষে খাচ্ছে। এতে ফুড চেইন বা খাদ্য শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ছে। বিগত সময়ে একটি গবেষনা সুত্রে জানা গেছে, মানুষের শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রো প্লাষ্টিক কণা প্রথমে রক্তে এবং পরে ফুসফুসেও পাওয়া গেছে। অপরদিকে, এখানে হ্রদে আসা ঢলের পানি এখন আগের মতো সহজে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হচ্ছে না।

এই জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা হ্রদের জলরেখা ধরে কাপ্তাই, সুভলং, বরকল কিংবা লংগদু ঘুরে বেড়ানো। বিশাল নীল জলরাশি, চারপাশে বিস্তৃত বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়-সবকিছু মিলে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এই হ্রদ ঘিরে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরলয়ে বদলে যাচ্ছে হ্রদের চিত্র। হ্রদের পাড় ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে বহুতল অট্টালিকা, বাড়িঘর, হোটেল, মোটেল প্রভৃতি। এসবের বর্জ্যও নির্বিবাদে পড়ছে হ্রদে। এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ প্রতিরোধও দেখা যায় না।

এছাড়া লেকের প্রধান বাহন যান্ত্রিক বোট ও লঞ্চ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তৈলের বেচা কেনায় লেকের বুকে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভাসমান তৈলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পানিতে তৈল জাতীয় পদার্থ পড়লে তা পানির দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। তাছাড়া যান্ত্রিক সেসব বাহনের তৈল তো পড়ছেই। লেকের পানি কমলে বিভিন্ন জায়গায় চরের সৃষ্টি হয়। যেখানে কৃষকরা বিভিন্ন শস্য ফলান। আর সেসব শস্যের বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার। যা বর্ষায় লেকের পানিতে মিশে লেকের পানিকে দূষিত করছে।

রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ললিত সি চাকমা বলেন, কাপ্তাই লেকের দূষণ রোধে সবাইকে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে হ্রদ ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত আছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যেসব বিভাগ ও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হ্রদের উপকারভোগী তাদেরও নিজ কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না এই হ্রদ জেলাবাসীর খাবার, ব্যবহার্য পানির যেমন প্রধান উৎস, তেমনি নৌ যোগাযোগেরও একমাত্র মাধ্যম। এই লেক বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, সেই সাথে বাঁচবে এ অঞ্চলের মানুষ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো