সমাজে বাড়ছে নৃশংসতা
১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও হাতের কব্জি এবং পায়ের গোড়ালি কেটে ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের নৃশংসতার জানান দিয়ে উল্লাস করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একদল সন্ত্রাসী। গত সেপ্টেম্বর শুরুতে এমন ঘটনার পর কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। সম্পত্তির বিরোধে চট্টগ্রামের হালিশহরে বৃদ্ধ মো. হাসানকে (৬১) হত্যা করে স্ত্রী ও দুই ছেলে। হত্যার পর বৃদ্ধের লাশ ১০ টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুম করার চেষ্টা করে তারা। গ্রেফতারের পর নিহতের স্ত্রী হোসনে আরা, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ও পুত্রবধূ আনারকলির জবানিতে উঠে আসে হত্যাকা-ের নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র। লাশের টুকরাগুলো কয়েকটি লাগেজ ও ব্যাগে ভর্তি করে তারা। খ-িত লাশের টুকরোগুলো পাশে রেখেই একত্রে খাওয়া-দাওয়া করে। তারপর সবাই মিলে লাশ গুমের জন্য বিভিন্ন স্থানে ফেলে আসে।
নৃশংসতাই যেন এখন শেষ কথা। ঘরে-বাইরে সর্বত্র। প্রতিপক্ষ কিংবা স্বজন; কেউই এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরাতন সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসমতা, দ্বন্দ্ব, লোভ ও হতাশা থেকেই মানুষ দিন দিন নৃশংস হয়ে উঠছে। যার সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়নের বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভিডিওচিত্র ও নৃশংসতার খবর পড়েও অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৬ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে মাত্র ১১ বছর বয়সী আকাশ নামের এক শিশুকে চুরির অভিযোগ এনে বাঁশের মধ্যে ঝুলিয়ে লাঠি, লোহার রড ও ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুটিকে নির্যাতনের ভিডিও করেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। শিশু আকাশ মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসংলগ্ন হাজী চিনু মিয়া স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব ৫ জনকে গ্রেফতার করে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯১ জন নারী। এরমধ্যে ২৩৫ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৯৪ জন নারী। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬২ জন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার ১১৪ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ছয় জন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন। যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। পরিবারের বাইরে প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিতজনদের হাতেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেক নারী। বিগত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৬৭ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩২ নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন তিন জন। এছাড়া ১০৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে।
নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিগত নয় মাসে ১ হাজার ১৫৭ শিশু নানাভাবে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৩১৭ শিশু। ধর্ষণের শিকার ৪৩ ছেলে শিশু। দুই ছেলে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একজন ছেলে শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ছয় শিশুকে। এছাড়া আত্মহত্যা করেছে ৬৪ শিশু। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ১১৮ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে পাঁচ শিশুর। এছাড়া অপহরণের পর হত্যা করা হয় ১৫ শিশুকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, সভ্যতা একদিকে যেমন আমাদের ভালো কাজের উদাহরণ দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, লোভ, ধর্ষণ, ড্রাগ বেড়ে যাওয়া, সামাজিক অসমতা, অস্ত্রের ব্যবহার এর বিপরীত চিত্র। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বেও এটা রোগের মতো ছড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর আগে রিলেটিভলি দ্বন্দ্বের উৎস কম ছিল। সমস্যা হলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে নিতো। সভ্যতার বিকাশে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন যখন হয়েছে, তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এরমধ্যে সম্পত্তি একটা বড় কারণ হয়ে উঠছে। আগের তুলনায় জমির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ফলে পরিবারের মধ্যেই পিতা, মাতা, ভাই-বোন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে। জমির জন্য মাকে-বাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাই ভাইকে ও বোনকে হত্যা করছে।’
তিনি আরো বলেন, নানা কারণে মানবিক গুণাবলি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। যতই আধুনিক সমাজের দিকে আমরা এগুচ্ছি, ততই সেটা প্রকট আকার ধারণ করছে। সিরিয়াল কিলিং বা সিরিয়াল কিলার তো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। সেটা হয়েছে উন্নত দেশে। যত বেশি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যাবেন, তত বেশি সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার বা মানসিক অস্থিরতা বাড়বে। ড্রাগ, গ্যাং কালচার আধুনিকায়নেরই বাই প্রডাক্ট। যে কারণে যত বিভৎস কার্যকলাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য মোহা. শফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমরা যে হিংস্র হয়ে উঠছি, নিষ্ঠুর হয়ে উঠছি, এর পেছনে বড় কারন পরিবার। পরিবার থেকে যথাযথ শিক্ষা না পাওয়ায় হতাশাটা বাড়ে। কিশোর বা অল্প বয়সে পরিবার থেকে সুশিক্ষা পেলে মানুষের মধ্যে অপরাধ বা নৃশংসতার প্রবনতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোহা. শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, একটা অপরাধ আরেকটা অপরাধকে উস্কে দেয়। একটা অপরাধ করে ফেলেছে, তখন এটা থেকে বাঁচার জন্য আরও অপরাধ করতে থাকে মানুষ। তখন চক্রবৃদ্ধি হারে অপরাধ ঘটে। এখন তারা কতটুকু নির্মম, নিষ্ঠুর, পাষ- সেটা আমাদের জানা নেই। কিন্তু হিংস্র নির্মম পাষ-রাই এ ধরনের কাজ করতে পারে। যেটা আমরা চিন্তাই করতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে যে হিংস্রতার চিত্র দেখানো হয়, এভাবে খুন হতে পারে, ওভাবে গুম করা যেতে পারে। সেটা থেকেও একটা কুশিক্ষা আসতে পারে। তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে তো ভালো কিছু আছে। সেটা না নিয়ে খারাপটা কেন আমরা নেবো।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা থাকে না, সেখানে সমাজ বলেন আর পরিবার বলেন, সব ক্ষেত্রেই হতাশা দানা বাঁধে। সবার মনেই অস্থিরতা তৈরি হয়। সেই হতাশা আর অস্থিরতা থেকেই সমাজ ও পরিবারে সহিংসতা ও নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা