নৃশংসতার সকল ইতিহাসকে পেছনে ফেলে অভিশপ্ত ইসরাইল হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, গির্জা এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের মতো সেবাযানে হামলা চালাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের জারজ দেশটির এসব নৃশংসতাকে শুধু সহ্যই করছে না বরং নিরীহ ফিলিস্তিনি মুসলিমদের সমূলে উৎপাটন করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ও একই সঙ্গে আধুনিক সব ধরনের মারণাস্ত্র ইসরাইলকে সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নরপিশাচরা।
গতকাল ইসরাইলি বিমান এমন একটি স্কুলে বিমান হামলা চালিয়েছে যেখানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার যুদ্ধ থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিল। হামলায় অন্তত ২০ ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছে যাদের মধ্যে ছিল নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষ। গাজা উপত্যকার উত্তরে জাবালিয়ার আল-ফাখৌরা স্কুলে যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। এর আগে ইসরাইল এক মাস আগে তার আগ্রাসনের শুরু থেকে গাজা উপত্যকা জুড়ে শত শত মানুষকে গণহারে হত্যা করেছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, গির্জা এবং ভবন লক্ষ্য করে পরিচালিত এসব হামলায় সাড়ে ৯ হাজার ৩শ’র মতো মানুষ শহীদ হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু এবং মহিলা। আহত হয়েছে ২৩ হাজার জনেরও বেশি।

এদিকে গত শুক্রবার গাজা ও পশ্চিম তীরে হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সকে টার্গেট করে বোমা হামলা চালায় ইহুদিবাদী ইসরাইল।
এ হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, শুক্রবারের এ হামলার ঘটনায় তিনি স্তম্ভিত। আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। গাজার আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অ্যাম্বুলেন্সে হামলার ঘটনায় ১৫ জন নিহত হন। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে দেয়া বিবৃতিতে গুতেরেস বলেন, ‘আল–শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অ্যাম্বুলেন্সে হামলা হওয়ার যে খবর পেয়েছি, তাতে আমি স্তম্ভিত। হাসপাতালের বাইরের সড়কের ওপর পড়ে থাকা লাশের ছবিগুলো খুবই মর্মান্তিক।’ জাতিসংঘের মহাসচিব আরো বলেন, অবশ্যই এর সমাপ্তি টানতে হবে।

গাজায় মানবিক পরিস্থিতিও খুব ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন গুতেরেস। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘মর্গগুলো লাশে ভরে গেছে। দোকানগুলো খালি হয়ে আছে। স্যানিটেশনের অবস্থা ভয়াবহ। আমরা দেখছি রোগ ও শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে তা বেড়েছে। পুরো জনগোষ্ঠী আতঙ্কিত। কোনো জায়গা নিরাপদ নেই।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা এক এএফপি প্রতিনিধি বলেন, হাসপাতালের বাইরে থাকা অ্যাম্বুলেন্সটিতে হামলার পর এর ভেতর কয়েকজনের লাশ দেখা গেছে।
শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলার ব্যাখ্যা দাবি আমেরিকার : গাজায় সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির জাবালিয়াসহ অ্যাম্বুলেন্সের বহরে ও আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হওয়া স্কুলে সাম্প্রতিক হামলার বিষয়ে ইসরাইলকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে আমেরিকা। পাশাপাশি মার্কিন কর্মকর্তারা বেসামরিক লোকদের ক্ষতি এড়াতে ইসরাইলকে হামাসের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে ‘নির্ভুল হামলা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরাইলের স্থলবাহিনী গাজার বৃহত্তম শহর ঘেরাও করে রেখেছে। তারা ৭ অক্টোবরের ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামলায় ১৪০০ জন নিহতের ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে হামাসকে পরাস্ত করার চেষ্টা করছে। ইসরাইলি বাহিনী সম্প্রতি একটি শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রে বোমা হামলা করে, যাতে ১৯৫ জন নিহতের তথ্য নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিন সরকার। সর্বশেষ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের একটি হাসপাতালের কাছে অ্যাম্বুলেন্সের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে অন্তত ১৫ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

অ্যাম্বুলেন্স টিমগুলো ইসরাইলি হামলায় ধ্বংসস্তূপ ও আবর্জনায় পরিণত হওয়া ভবনগুলোতে আহতদের সাহায্য করতে ও লাশগুলো সরাতে ছুটে গিয়েছিল।
ইসরাইল দাবি করেছে, তাদের হামলায় গাজার সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির জাবালিয়ায় হামাসের দুই সশস্ত্র নেতা নিহত হয়েছে। ইসরাইলের দাবি, হামলাস্থলে বেসামরিক ভবনের নীচে ও আশপাশে হামাসের কমান্ড সেন্টার ও অন্যান্য ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ছিল। সংগঠনটি গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ইচ্ছাকৃতভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার ইসরাইলকে শরণার্থী শিবিরে বিমান হামলার পেছনের যুক্তি ব্যাখ্যা করতে বলেছে।

বাইডেন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা পলিটিকোকে বলেছেন, ‘আমেরিকা জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে প্রথম আক্রমণের ব্যাখ্যা চেয়েছিল।’ বেসামরিক হতাহতের ঘটনা এড়াতে ইসরাইলকে আরো চেষ্টার জন্য বলা প্রসঙ্গে এ আলাপ হয়।
‘ইসরাইলের গণহত্যায় আমাদের নীরবতা ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না’ : হামাস-ইসরাইল সংঘাত ইস্যুতে প্রথম দিকেই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে পাকিস্তান। এবার দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ নিয়ে মন্তব্য করলেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের গণহত্যায় আমাদের নীরবতা ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না।’

পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ বলছে, সংঘাত ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটারের নতুন নাম) শাহবাজ লেখেন, ‘ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরাইলের বর্বরতা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। গাজায় কেউ নিরাপদ নয়- না শিশু, না রোগী; না হাসপাতাল, না অ্যাম্বুলেন্স। ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে। ইতিহাস আমাদের নীরবতাকে ক্ষমা করবে না, আমাদের নিষ্ক্রিয়তাকে ক্ষমা করবে না।’
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) এ হামলার দায় স্বীকার করে বলেছে, তারা একটি অ্যাম্বুলেন্সকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।

গাজায় জিম্মি সনাক্তে মার্কিন নিরস্ত্র পেন্টাগন সম্পদ ব্যবহার করে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকায় হামাসের হাতে জিম্মিদের খুঁজে বের করতে প্রতিরক্ষা বিভাগের নিরস্ত্র সম্পদ ব্যবহার করছে। এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেছেন। কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা কিছু আমেরিকান জিম্মি সনাক্ত করতে সাহায্য করার জন্য নিরস্ত্র উড়ন্ত সম্পদ ব্যবহার করছি। গাজা থেকে সমস্ত জাতীয়তার সমস্ত জিম্মি যাতে বেরিয়ে আসে তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সম্ভাব্য সবকিছু করতে যাচ্ছি।’
‘এখানে একাধিক লাইনের প্রচেষ্টাসহ একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া চলছে’ -কর্মকর্তা অব্যাহত রেখেছিলেন। ‘আশা করি ভবিষ্যতের কলে আমাদের কাছে কিছু ভাল খবর থাকতে পারে তবে এটি অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন, জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।’

কর্মকর্তা আরো বলেন, দুই আমেরিকান যে কয়েক সপ্তাহ আগে গাজা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল তা প্রমাণ করেছে যে, এটি সম্ভব।
৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে হামাস জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের পর মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়, যার সাথে সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি বসতিগুলির বাসিন্দাদের গণহত্যা এবং শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধ সহ ২০০ জনেরও বেশি জিম্মি করা হয়। হামাস এই হামলাকে জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্টে আল-আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করে। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করেছে এবং সেই এলাকা এবং লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশে হামলা শুরু করেছে। পশ্চিম তীরেও সংঘর্ষ চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দ্রুত যুদ্ধের সমাপ্তি -আরব আমিরাত : সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা বলেছেন, গাজায় সর্বশেষ যুদ্ধ দেখায় যে, ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ নীতি ব্যর্থ হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাতের দ্রুত অবসান এবং একটি নতুন কৌশলের জন্য চাপ দিতে হবে, অন্যথায় অঞ্চলটি অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে।
আনোয়ার গারগাশ আবুধাবিতে একটি নীতি সম্মেলনে বলেছেন, ‘যদি এই সঙ্কট চলতে থাকে, বিশেষ করে মানবিক দিকটি, এবং এই সংকট যদি আমাদেরকে ৭ অক্টোবরের আগের পুরানো নিয়ন্ত্রণ নীতিতে পূর্ণ বৃত্ত ফিরিয়ে আনে, আমি মনে করি এখানে আমেরিকান ভূমিকা, ভুল বা ভুল ভুলে যান, তবে এটিকে কার্যকর হিসাবে দেখা হবে না।’

আরব নেতাদের এক কণ্ঠে কথা বলার আহ্বান জর্ডানের বাদশাহর : জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বেশ কয়েকজন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পেয়েছেন এবং তাদের গাজা সম্পর্কে এক কণ্ঠে কথা বলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একথা বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, অবরুদ্ধ ছিটমহলে যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করা আরব দেশগুলোর দায়িত্ব। বাদশাহ গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে বেসামরিক লোকদের হত্যার নিন্দা করেছেন। সূত্র : আল-জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি ও তাস।