নানা নাটকীয়তা ও আসন ভাগাভাগি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশেষে জাতীয় পার্টির সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করেছে। এ ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন ভাগাভাগি আরো আগেই চূড়ান্ত হয়। আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরীকদের প্রথমে ৭টি আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও গতকাল ১টি আসন কমিয়ে ৬টি আসন ছাড়ের কথা দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছে ৩২টি আসনে। এসব আসন ভাগাভাগির পর আওয়ামী লীগ ২৬৩টি সংসদীয় আসনে নৌকা প্রতীকে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি (জাপা) ২৮৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল হয়েছিল দুই হাজার ৭১৬টি। যাচাই-বাছাই শেষে ১৯৮৫ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ ও ৭৩১ জনের অবৈধ বলে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি করা হয় ৫ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল গতকাল। আজ ১৮ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রতীক বরাদ্দ করবেন। এরপর নির্বাচনী প্রচারনা শুরু হবে এবং চলবে আগামী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর ভোটগ্রহণ হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি।
গতকাল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) কমিশন সচিব জাহাংগীর আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া জানান, ২৯৮ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন দলীয় প্রার্থীরা। যাচাই-বাছাইয়ে ৫টি বাতিল হয়। এর ফলে দলের বৈধ প্রার্থী হন ২৯৩ জন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্ররা জোট হয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ কারণে ৬টি আসন ১৪ দলকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এই ছয় আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির জন্য ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসব আসন থেকেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে বিপ্লব বড়ুয়া জানান। গত ২৬ নভেম্বর ২৯৮ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। সেদিন নারায়ণগঞ্জ-৫ এবং কুষ্টিয়া-২ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেনি ক্ষমতাসীনরা।

এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার পর ২৮৩টি আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গতকাল বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক বিফ্রিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। চ্ন্নুু বলেন, আমরা খেলে যাবো, লড়াই করে যাবো। সব প্রার্থীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ২৮৩টি আসনে নির্বাচন করবে জাপা। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের নেয়া পদক্ষেপেরও প্রশংসা করেন মুজিবুর হক চুন্ন। তিনি বলেন, জাপা আস্থাশীল, সরকার নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করছে। নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দেবে বলে আমরা আশা করি।

জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬ আসনে ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব আসন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার পর যে ২৬ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে এবং এসব আসনে জাপার প্রার্থী যারা তারা হলেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), রানা মোহাম্মদ সোহেল (নীলফামারী-৩), আহসান আদেলুর রহমান (নীলফামারী-৪), হোসেন মকবুল শাহরিয়ার (রংপুর-১), জি এম কাদের (রংপুর-৩), এ কে এম মুস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১), পনির উদ্দিন আহমেদ (কুড়িগ্রাম-২), শামীম হায়দার পাটোয়ারী (গাইবান্ধা-১), মো. আব্দুর রশীদ সরকার (গাইবান্ধা-২), শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ (বগুড়া-২), নুরুল ইসলাম তালুকদার (বগুড়া-৩), মো. আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), রুহুল আমিন হাওলাদার (পটুয়াখালী-১), গোলাম কিবরিয়া টিপু (বরিশাল-৩), মো. মাশরেকুল আজম রবি (পিরোজপুর-৩), সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ মুক্তি (ময়মনসিংহ-৫), ফখরুল ইমাম (ময়মনসিংহ-৮), মুজিবুল হক চুন্নু (কিশোরগঞ্জ-৩), জহিরুল আলম রুবেল (মানিকগঞ্জ-১), শেরীফা কাদের (ঢাকা-১৮), মো. আব্দুল মুনিম চৌধুরী হবিগঞ্জ-১, আব্দুল হামিদ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২), মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৫), সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), এবং সোলায়মান আলম শেঠ (চট্টগ্রাম-৮)।

১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনের শর্ত রেখে ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। যে ৬টি আসনে ১৪ দলের শরিকরা নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন তারা হলেন, জাসদের এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন (বগুড়া-৪), ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা (রাজশাহী-২), জাসদের হাসানুল হক ইনু (কুষ্টিয়া-২), ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন (বরিশাল-২), জাতীয় পার্টি জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (ফিরোজপুর-২) এবং জাসদের মোশারফ হোসেন (লক্ষীপুর-৪)।

তবে ১৪ দলের শরিকরা এ আসন ভাগাভাগিতে খুশি নন। আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে ৭টি আসন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও অবশেষে ১টি আসন কমিয়ে দেওয়াকে তারা নীতি বহির্ভূত বলে উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা সন্তুষ্ট নই। এটা অপ্রত্যাশিত। শেষ সময়ে এসে একজনকে বাদ দেয়া খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এটা রাজনীতির নীতিবহির্ভূত কাজ।
১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসনে ছাড় দিলেও বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে নৌকা প্রতীক দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। এ আসনে তার ভাতিজা বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির চেয়ারম্যান শাহাজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদকে নৌকা প্রতীক দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার প্রতি অন্যায়, অবিচার করা হয়েছে।

এদিকে এ নির্বাচনকে ভাগাভাগির নির্বাচন আখ্যা দিয়ে জাকের পার্টি তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। জাকের পার্টির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যানের প্রেসসচিব কাজী মো. রাশেদুল হাসান বলেছেন, আমরা ভেবেছিলাম জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের সাথে জাকের পার্টির একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গতকাল পর্যন্ত দেখা গেল নির্বাচন ভাগাভাগি হয়ে গেছে। তাই হাইকমান্ডের নির্দেশে আমরা আমাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করলাম। আমাদের অধিকাংশ প্রার্থী ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।