ঢাকা   রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৭ আশ্বিন ১৪৩১

ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজে ভর্তির শর্ত বাতিল নিয়ে বিতর্ক

Daily Inqilab বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম

আগামী ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে বিদ্যমান শর্ত (দাখিল/আলিম/এইচএসসি পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা/আরবি থাকা) বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

গত ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির এক সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এতে নোট অফ ডিসেন্টে কথা বলেন বিভাগের ৫ জন শিক্ষক। অ্যাকাডেমিক কমিটির সভায় উপস্থিত অন্যান্য ১৫ জন শিক্ষক এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দেন।

ভিন্নমত পোষণকারী শিক্ষকের মতে উক্ত বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শর্ত বহাল রাখা অত্যাবশ্যক। কেননা এটি অ্যাকাডেমিক কমিটির একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল। তাদের দাবি- ইসলামিক স্টাডিজের মৌলিক বিষয়াদি অধ্যয়নের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা অথবা আরবি না থাকলে শিক্ষার্থীরা বিভাগের কারিকুলামের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয় না। এর ফলে তারা বিভাগীয় পাঠ্যক্রম অধ্যয়নে হতাশাগ্রস্ত হয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয় না।

একাডেমিক কমিটির এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অফ ডিসেন্টে কথা বলা শিক্ষকদের মাঝে অন্যতম প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ ইবনে হোছাইন ইনকিলাবকে বলেন, ইসলামিক স্টাডিজ একটি ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়। আমাদের বিভাগে যে মূল সোর্স; কোরআন, হাদিস, ফিকহ- এগুলো সম্পর্কে যদি কারো পূর্ববর্তী জ্ঞান না থাকে তবে সে তো এগুলো ধারণ করতে পারবে না। আমাদের এখানে কোরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের কিতাব আছে, অ্যারাবিক টেক্সট আছে, সুতরাং এসব বিষয়ে পূর্ববর্তী জ্ঞান ছাড়া কেউ এটা ধারণ করতে পারবে না।

প্রফেসর ইউসুফ বলেন, অর্থনীতি বিভাগে পড়ার জন্য যেমন উচ্চমাধ্যমিকে অর্থনীতি থাকা শর্ত তেমনি একই কারণে আমরাও কয়েকবছর আগে এই শর্তটি যুক্ত করি। অ্যাকাডেমিক কমিটির অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন আবার কী কারণে এটা উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। এমন না যে আমরা বিভাগে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেক শিক্ষার্থী এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছে এবং তাদের অনেকের পছন্দ থাকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এছাড়া এটি কোনো ধর্ম শিক্ষার জায়গা নয়, বরং এটি একটি উচ্চশিক্ষার মাধ্যম। সুতরাং কেউ যদি ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাহলে তাকে অবশ্যই শুরু থেকে শিখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নয়।

অ্যাকাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকা এক শিক্ষক বলেন, আমাদের বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শর্তটি উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে গত বছরই আমাদেরকে ডিনের মাধ্যম ভিসি স্যার একটা মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তখন আমরা বছরের শেষের দিকে ছিলাম, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আপাতত যেভাবে আছে সেভাবে থাকুক। এবারও আমাদেরকে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষক বলেন, আমরা চেয়েছিলাম শর্তটি থাকুক। যাদের এই ডিপার্টমেন্টে পড়ার আগ্রহ আছে কেবল তারাই আসুক। অন্য কোন সাবজেক্ট না পেয়ে জোরের উপর এই বিভাগে ভর্তি হওয়ায় পরে দেখা যায় তারা পড়াশোনায় একেবারেই দুর্বল। এর আগে ভিন্ন ধর্মের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আমরা দেখেছি যারা কোনরকমে টেনেটুনে পাশ করে গেছে। এসব কারণে কয়েক বছর আগে আমাদের এই শর্তটি যুক্ত করা হয়।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝেও ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মাকসুদুল হাসান (ছদ্মনাম) নামে বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের বিভাগে কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ডের অধিকাংশই কোনমতে পড়ে কেবল পাশ করে যেতে চায়; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। তাই এখানে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের যারা তাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

তাহমিদ (ছদ্মনাম) নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, যেভাবে কৌশলে পরিকল্পিত উপায়ে অ্যাকাডেমিক্যালি ইসলাম শিক্ষাকে অবনমন করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রিতে ডেকে-কয়ে ভর্তি করাতে চাইলেও এই ডিপার্টমেন্টে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। তাই শর্ত শিথিল করা ছাড়া আপাতত তাদের কাছে আর কোনো উপায়ও নাই। এখন তো তাও ১০০জন নেওয়া হচ্ছে, ক্রমাগত অবনতি যদি চলতে থাকে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী খরার কারণে এই আসন সংখ্যা আরও অনেক কমে আসবে। ডিপার্টমেন্ট থাকবে, শিক্ষকও থাকবেন, আগ্রহী শিক্ষার্থীর অনুপাতটাই দেখার বিষয়।

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শর্ত উঠিয়ে দিলে তখন অনেকে ভাববে ইসলামিক স্টাডিজ আর ইসলামিক হিস্ট্রি এন্ড কালচার তো একই। এতে করে আরো বেশি কলেজ ব্যাকরাউন্ডের শিক্ষার্থীরা এতে ভর্তি হবে এবং পরবর্তীতে আফসোস করবে যখন দেখবে এই বিভাগের কারিকুলামের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না।

জানা যায়, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগটি আরবি বিভাগের সাথে একত্রে ছিল। কয়েকবছর পর তা ইসলামিক স্টাডিজ নামে যাত্রা করে। তবে শুরু থেকেই এই বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো শর্ত ছিল না। কলেজ কিংবা মাদরাসা থেকে আসা যেকেউ এই বিভাগে ভর্তি হতে পারতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভাগে ভর্তির ক্ষেত্রে নতুন এই শর্তটি (দাখিল/আলিম/উচ্চমাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষা/আরবি থাকা) যুক্ত করা হয়। ফলে কেবল মাদরাসা থেকে আসা ও উচ্চমাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষা/আরবি বিষয় পড়া শিক্ষার্থীরাই এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিষয়টিকে সংবিধানপরিপন্থী বলে মনে করেন বিভাগের কতিপয় শিক্ষক।

বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ভর্তির ক্ষেত্রে এমন শর্ত থাকলে তাতে সমতা নিশ্চিত হয় না। এছাড়া দুই-তিন বছর পূর্বে অ্যাকাডেমিক কমিটির একটি সভায় এই শর্ত যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখনও এতে প্রায় অর্ধেক শিক্ষক ভিন্নমত পোষণ করেছিল।

তিনি বলেন, এই শর্তটি যুক্ত করার ফলে আমরা এখন মেধাতালিকার প্রথমদিকের শিক্ষার্থীদের পাচ্ছি না। ফলে শেষদিকের তুলনামূলক দুর্বল শিক্ষার্থীদের দ্বারাই বিভাগের পাঠদান কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। যা আমাদের বিভাগের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। বিষয়টি উপলব্ধি করেই বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক এখন শর্ত উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন।

বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. সানাউল্লাহ বলেন, অ্যাকাডেমিক কমিটির অধিকাংশ শিক্ষকের মতামতের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক এর বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন, আমরা সেটাও ডিন’স কমিটিতে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের বিভাগে পিউর কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ডের একাধিক শিক্ষক রয়েছেন। আমাদের এখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন কোনো নীতিমালা নেই। সুতরাং বিভাগের কিসে ভালো হবে তা বিভাগের শিক্ষকরাই ভালো বুঝেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, আমরা এই বিষয়ে উক্ত বিভাগকে কোনো নির্দেশনা দেইনি। আমরা প্রতিটি বিভাগের কাছেই চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছি ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের আসন সংখ্যা ও ভর্তি সংক্রান্ত শর্তাবলির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা পূর্বের নিয়ম বহাল থাকবে কি না। উক্ত বিভাগকেও এমন চিঠি পাঠিয়েছি। ওনারা চিঠির জবাবে যে চিঠি পাঠিয়েছে সেখানে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো শর্তের কথা উল্লেখ নেই। ###


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তামিমকে টপকে শীর্ষে মুশফিক

তামিমকে টপকে শীর্ষে মুশফিক

শেষ মিনিটের গোলে পয়েন্ট হারাল মায়ামি

শেষ মিনিটের গোলে পয়েন্ট হারাল মায়ামি

ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়

ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়

ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট

ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব

এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়

দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

দেশে সংস্কার  ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু