ডেঙ্গুর হানা বছরভর
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
পুরো ২০২৩ জুড়েই ছিল ডেঙ্গুর হানা। এ বছরের গড়ে প্রতিদিনই আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এ রোগে। মৃত্যুও হয়েছে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের। ফলে পুরো বছরজুড়েই ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত ছিল দেশের মানুষ। আলোচনায় ছিল দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ডেঙ্গুতে নাজেহাল ছিল স্বাস্থ্যখাত। এডিস মশাবাহিত জ্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৬৯৮ জনের মৃত্যু হলো। এছাড়া গত একদিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৯ জন। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭০ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট এক হাজার ৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৩৩০ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে এখন পর্যন্ত তিন লাখ ২০ হাজার ৫৪৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ৯ হাজার ৮৩৬ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১০ হাজার ৭১৩ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিন লাখ ১৭ হাজার ৮৪৮ জন। ঢাকায় এক লাখ আট হাজার ৫২৮ এবং ঢাকার বাইরে দুই লাখ নয় হাজার ৩২০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এ বছর জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে। তবে ডিসেম্বর মাসে এসেও ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ অব্যাহত আছে। চলতি বছর ডেঙ্গু অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর আগে, ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন।
দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে, প্রথমবারের মতো এর ব্যাপকতা দেখা দেয় ২০১৯ সালে। শনাক্ত হয় সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী। ওই বছর রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২১ সালে রোগী ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১০৫ জনের।
একটা সময় ডেঙ্গুর সংক্রমণকে শহরের রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এবছর সেটি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম এলাকাগুলোতেও। রাজধানীর চেয়ে তিনগুণের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে গ্রামে। চলতি বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়াদের মধ্যে ঢাকায় এক লাখ নয় হাজার ৭৪৩ জন। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১০ হাজার ৪১৫ জন।
একসময় বর্ষার সিজন এলেই দেশে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া যেত। তবে, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া, বৃষ্টির বাইরে বছরব্যাপী চলা নানা উন্নয়নমূলক কাজসহ বিভিন্ন কারণে জš§ নিচ্ছে এডিস মশা। এ কারণে বিপদ এড়াতে দেশজুড়ে সারা বছর মশক নিধন কার্যক্রম চালানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
দেশের ইতিহাসে রেকর্ড ডেঙ্গু সংক্রমণের বছরে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে রোগীদের। হাসপাতালগুলোতে নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে। এদিকে, রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধতা থাকায় চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের। বছরব্যাপী ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় রোগীদের জন্য ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এছাড়া ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র সেবা দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে।
বছরের শেষের দিকে ডেঙ্গু বেড়ে গেলে দেশে স্যালাইন নিয়ে হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বাজারে স্যালাইনের সঙ্কট দেখা দেয়। ফলে নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি হয়। এতে বিপাকে পড়েন দরিদ্র রোগী ও তাদের স্বজনরা। ওই সময় কিছু ফার্মেসিতে পাওয়া গেলেও ৯০ টাকার স্যালাইন তখন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়। ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতালগুলো যখন কানায় কানায় পূর্ণ, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে ডাব, মাল্টার দাম বাড়িয়ে ডেঙ্গু রোগীদের ‘জিম্মি’ করার নানা খবর। সরেজমিনে তখন দেখা যায়, ডেঙ্গুর সুযোগে হাসপাতালের গেট ও আশপাশের ফুটপাথে মানুষের পকেট কাটছেন ডাবসহ বিভিন্ন ফল বিক্রেতারা। তারা দ্বিগুণেরও বেশি দাম নিচ্ছেন। সবমিলিয়ে গরীব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীরা খুবই অসহায় বোধ করেছেন।
চলমান ডেঙ্গু সংক্রমণ ও নতুন বছরে করণীয় প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবার দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একসময় ডেঙ্গু শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, ২০২৩ সাল যেমনই হোক, নতুন বছরে আমরা কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করব, সেটাই বড় ভাবনা।
সিনিয়র জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরই চলবে। ফলে বছর শেষে ডেঙ্গুতে বহু মানুষের মৃত্যু হবে। বর্তমানে দেশের আবহাওয়ার যে অবস্থা, ভালো করে শীতও নেই, আবার গরমও নেই। অল্প একটু ঠাণ্ডা লাগে সকালে আর শেষ রাতে। আবহাওয়ার এমন আচরণের মধ্যে মশার প্রজনন কিন্তু ঠিকই চলতে থাকবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু ইতোমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। একটা সময় ছিল ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যেত। এখন প্রায় সমান হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের আউটব্রেকে আমরা দেখছি, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতে ডেঙ্গু রোগী। মোট রোগীর ৩৫ শতাংশ ঢাকা এবং ৪৪ শতাংশ ঢাকার বাইরের। এমনকি ৮৬ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে হাসপাতালের চারপাশের দুই কিলোমিটারের মধ্যে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের
গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা
রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি
বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার
লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭
প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু
কী আছে তৌফিকার লকারে?
ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা
অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা
শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা
৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি
৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ