হয়রানিতে মনোযোগ
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
২০২৩ সালে অনুসন্ধান-তদন্তের নামে নিরীহদের হয়রানিতে মনযোগ বেশি থাকার ধারা অব্যাহত রাখে দুদক। নোবেল বিজীয় বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করে মামলা। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ঘটনায় ঢেঁউ তুলতে পারেনি দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সংস্থাটি। আলোচিত বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠন মামলায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে চার্জশিটভুক্ত আসামি করে। তবে দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে সংস্থাটিতে লক্ষ্য করা গেছে নির্লিপ্ততা। প্রতিরোধ কার্যক্রমে রুটিন কাজ পরিচালনার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয় পুরো বছর। দায়ের করে খুচরা কিছু মামলা। ঋণের নামে ব্যাংক লুট, আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থপাচারের বেশ কিছু ঘটনা উদঘাটিত হলেও এসব বিষয়ে দুদককে স্বপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। আলোচিত এস আলম গ্রুপের অস্বাভাবিক ঋণ গ্রহণ এবং অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে আদালতের নির্দেশে। ‘নোমান গ্রুপ’র বিরুদ্ধে একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকে বন্ধ রেখে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এড়িয়ে যায় দুদক। আলোচিত পিকে হালদারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ৩৭টি মামলা করা হলেও চার্জশিট দাখিল করেছে কয়েকটি মামলায়। ২০২৩ সালে দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরার মতো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এ বছর দুদককের কার্যক্রমে লক্ষনীয় হয়ে ওঠে আদালত নির্ভরতা। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সরকার দলীয় অনেক রাঘব বোয়াল তাদের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধির অবিশ্বাস্য তথ্য উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও দুদক বিষয়টি এড়িয়ে যায়। পক্ষান্তরে বিরোধী রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা নিষ্পত্তিতে ছিল বিশেষভাবে সক্রিয়। যা স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্ট ধারণাকেই প্রতিষ্ঠা করে। সংস্থাটির এ ধরনের কার্যক্রম সম্পর্কে উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করে।
কার্যক্রমের বার্ষিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে কমিশন যাচাই-বাছাই শেষে ৩ শতাধিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয় ২ শতাধিক। অভিযোগ অনুসন্ধানযোগ্য নয় বিবেচনায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নথিভুক্ত করে ৫৫৯টি অভিযোগ। নথিভুক্তির এই সংখ্যা ২০২১-২০২২ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ মামলা রুজুর তুলনায় বেড়ে যায় নথিভুক্তি কিংবা অব্যাহতির হার। অনুসন্ধান-তদন্তের নামে নিরীহ, নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি, প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের দায়মুক্তির অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভের কোনো চেষ্টাই দুদকের মাঝে লক্ষ্য করা যায়নি গতবছরও। বহু সমালোচনা থাকলেও ২০২৩ সালের জুন মাসে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে ৫৮টি মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে বাচ্চুসহ ১৪৭ জনকে আসামি করা হয়।
বেসিক ব্যাংক লোপাটের পর ২০১৫ সালে দায়েরকৃত মামলার কোনোটিতেই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। এ কারণে দুদককে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। বর্তমান কমিশন সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুক এবং কোম্পানি সচিব শাহ আলম ভুইয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশিট প্রদানের মাধ্যমে। দাখিলকৃত চার্জশিটে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ৪৬ জন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহকসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন। যেখানে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয় ৪৮টি মামলায়। ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফজলুস সোবহানকে ৪৭টি মামলায়, কনক কুমার পুরকায়স্থকে ২৩টি, ডিএমডি মো. সেলিমকে ৮টি মামলায় এবং ডিএমডি এ মোনায়েম খানকে ৩৫টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় মামলা দায়েরের ৮ বছর পর চার্জশিট দাখিল করতে পারাকে বর্তমান কমিশন নিজেদের ‘সাফল্য’ বলে দাবি করে আসছে। যদিও চার্জশিট দাখিলের পর আলোচিত বাচ্চুকে একদিনের জন্যও কারাভোগ করতে হয়নি।
গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে গত ৩০ মে মামলা করে দুদক। এ মামলায় গত ৪ অক্টোবর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। যদিও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক বলে মন্তব্য করেন ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আইনজীবী। এ মামলায় তিনি ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো: শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো: কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলামকেও আসামি করা হয়।
আলোচিত মামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় চার্জশিট দাখিল। পিপলস লিজিং, আরো ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে গত এক দশকে ১১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিন্তু পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়। এসব মামলায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
সরকার সমর্থিত ১৪ দলীয় জোটের অংশীদার তরিকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী তার দুই পুত্র, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ও আফরোজা আব্বাসসহ বেশ ক’জন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করে বিদায়ি বছরে।
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড’র কর্মকর্তাসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মামলা করে দুদক। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
‘ডলি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন ও তার স্ত্রী ডলি আক্তারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ৪শ’ ৪৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫০৪ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে। এ মামলায় ব্যাংকের ৫ কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়।
‘ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড’র তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিক উদ্দিন এবং বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানির সাবেক বোর্ড মেম্বার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোতালেবসহ তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত ৩১ দায়ের হওয়া মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৩৬ কোটি ৩৭ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৩৬ কোটি ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগে এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আনিস আহমেদ গোর্কীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
মিসরীয় বিমান লিজ আনার ক্ষেত্রে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা গচ্চা যায়। এ ঘটনায় বিমানের তৎকালীন ফ্লাইট (অপারেশন) ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। আপন জুয়েলার্সের মালিক গুলজার আহমেদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলাটি ছিল বিদায়ি বছরের উল্লেখযোগ্য মামলা।
২০২৩ সালে বছরজুড়ে অর্থপাচার রোধ সংক্রান্ত অভিযোগের তীর ছিল দুদকের দিকে। দেশের উচ্চ আদালত থেকে অর্থপাচার এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ‘দুদক ঘুমিয়ে আছে’ মর্মে মন্তব্য এসেছে। এ কারণে অর্থপাচার সংক্রান্ত সকল অপরাধের তদন্তের ক্ষমতা পুনরায় ফিরে পেতে আইন ও বিধি সংশোধনে সচেষ্ট হয় কমিশন। তফসিলসহ দুদক বিধি মামলার সংশোধনী চেয়ে এ বছর ২৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে প্রস্তাবনা পাঠালেও দুদকের প্রত্যাশিত বিধিমালার সংশোধন আলোর মুখ দেখেনি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অর্থপাচারের পরিমাণ বাড়ছে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার)। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) গত ২৩ ডিসেম্বর জানিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তবে বর্তমান কমিশন বরাবারই বলে আসছে, বিদ্যমান আইনে আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থপাচারের অভিযোগ দুদক তদন্ত করতে পারছে না।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের
গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা
রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি
বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার
লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭
প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু
কী আছে তৌফিকার লকারে?
ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা
অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা
শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা
৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি
৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ