কারা হচ্ছে বিরোধী দল?
০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৬ এএম
কোন্ রাজনৈতিক দল হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ‘বিরোধী দল’ ? কে বসছেন সংসদের ‘বিরোধী দলীয় নেতা’র আসনে ? দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্নের পর এ প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে আসছে বিশ্লেষকদের সামনে। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলের একটি দায়িত্ব থাকে। সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা বিরোধী দলের কাজ। যদিও একাদশ জাতীয় সংসদে ‘প্রধান বিরোধী দল’র আসনে বসা জাতীয় পার্টিকে এমন ভূমিকায় দেখা যায় নি।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই কোন দল সরকার গঠন করছে সেটি নিশ্চিত ছিলো। অনিশ্চিত ছিলো শুধু ‘বিরোধী দল’ নির্বাচনের বিষয়টি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‹বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন› হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‹২৬ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাদের ১৩টি দলের নামও কেউ বলতে পারবে না। আসন ভাগাভাগির পর সরকারি দলের ২৪০ আসন নিশ্চিত।› এমন সমালোচনা হজম করেই শেষ অবধি অনুষ্ঠিত ভোট। কিন্তু এই ভোটের মাধ্যমে কি ‘বিরোধী দল’ খুুঁজে পাওয়া গেলো ? ৩শ’ সংসদীয় আসনের মধ্যে গতকাল সোমবার (৮ জানুয়ারি) ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সে অনুযায়ী ক্ষমতাসীন ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ’ পেয়েছে ২২২টি আসন। জাতীয় পার্টি-১১, জাসদ-১, ওয়ার্কার্স পার্টি-১, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি-১ এবং ৬২টিতে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। পরবর্তী করণীয় হিসেবে নির্বাচিতদের বিষয়ে শিঘ্রই গেজেট প্রকাশ হবে। নব নির্বাচিত এমপিগণ শপথ নেবেন। স্পীকার নির্বাচিত হবেন। দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদও গঠিত হবে। কিন্তু ‘বিরোধী দল’ এ কোন দল হচ্ছে- সেটির প্রশ্নে রয়ে গেছে শূন্যতা। সরকারি দল ২২২টি আসন জিতে নিলেও বিরোধী দলের জন্য তেমন আসন অবশিষ্ট রাখেনি। তাই আওয়ামীলীগের বাইরে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, সেসব দলকে আইনত: ‘বিরোধী দল’ সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না।
আইন,বিচার ও জাতীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘জাতীয় সংসদ সচিবালয় আইন,১৯৯৪’ এর ৪(২) উপ-ধারা (১) এর (জ), (ঙ) এবং (চ) তে ‘বিরোধী দল’র কার্যাবলীর কথা উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, চীফ হুইপ, বিরোধী দলের নেতা, সংসদ উপ-নেতা, বিরোধী দলের উপ-নেতা, হুইপগণ ও সংসদ-সদস্যগণকে দেয় পারিশ্রমিক ও ভাতাদি সম্পর্কিত কার্যাবলী :’
আইনটির সংজ্ঞা (ঙ) তে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের উপ-নেতা’ অর্থ বিরোধী দলের নেতা কর্তৃক সংসদে বিরোধী দলের উপ-নেতারূপে মনোনীত কোনো সংসদ সদস্য।
সংজ্ঞার (চ) তে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা’ অর্থ স্পীকারের বিবেচনামতে যে সংসদ-সদস্য সাময়িকভাবে সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’
এসব সংজ্ঞা এবং ধারা-উপধারা থেকে এমন একটি নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, জাতীয় সংসদ পরিচালিত হয় আইনত: স্পীকারের রুলিং অনুযায়ী। স্পীকারই সাব্যস্ত করেন ‘বিরোধী দল’ এবং ‘বিরোধী দলীয় নেতা’। তবে স্পীকারের ‘রুলিং’এরও রয়েছে বিধি-বিধান। তার নির্দেশনাও হতে হবে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথা অনুযায়ী। সংসদীয় আইনে ‘বিরোধী দল’র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো মানদণ্ড দেয়া নেই। ফলে ‘বিরোধী দল’ গঠনের বিষয়ে বড়ধরণের অস্পষ্টতা রয়েছে।
রেকর্ড ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ জন এমপি’র সমন্বয়ে বিরোধী দল গঠনের কথা বলেছেন। তবে কমপক্ষে ১০ জন এমপি থাকলে এটিকে ‘সংসদীয় অধিসংঘ’ বলা যাবে। ন্যূনতম কতজন এমপি হলে ‘বিরোধী দল’ বলা যাবে-এমন কোনো রুলিং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কোনো স্পীকার রুলিং দেননি। সে সময় আতাউর রহমান খান ‘বিরোধী দলীয় নেতা’র স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। সংরক্ষিত ১৫ নারী আসনসহ সেই সংসদে আওয়ামীলীগের মোট আসন ছিলো ৩০৭টি। কিন্তু কোনো ‘বিরোধী দল’ ছিলো না।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষে বঙ্গববন্ধু একটি ভাষণ দেন। তাতে ‘বিরোধী দল’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, বিরোধী দলের নাম শুনতে পাই। দেশে এ রকম কোনো পার্টি আছে কি না জানি না। নির্বাচনের আগে এরকম কোনো পার্টি ছিল না। অনেকেই ভোট না পেয়ে পশ্চাদপসরণ করেছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে যদি তারা ভোট না পায় সে দোষ আমাদের হবে না। ভোট পেয়ে পরিষদে এসে বলুন, আমরা বিরোধী দল। যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ভোট পায়নি তারা বলে ‘আমরা বিরোধী দল’। ভবিষ্যতে ভোট নিয়ে এসে তারপর বলুক আমরা বিরোধী দল। তা হলে বলুক, এই এই আমাদের দাবি।
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা থাকলেও এটি অন্তত: বোঝা যায়, ‘দল বিহীন’ কোনো বিরোধী দল হতে পারে না। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত ৬২ এমপি’রও কোনো দল নেই। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মর্মার্থ অনুসারে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপিদের ‘বিরোধী দল’ বনে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যাচ্ছে। তবে জাতীয় সংসদের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করে জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ একজোট হয়ে একজনকে ‘নেতা’ নির্বাচন করলে তিনি হতে পারেন বিরোধী দলের নেতা।
জাতীয় সংসদের কর্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট)- তে উল্লেখ আছে, ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে হবে, এটা সংবিধানে বলা আছে। যে দল রাষ্ট্রপতির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের নেতাকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। আর সংবিধানে অনাস্থা ভোটের বিষয়ে বলা হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলা হয়নি। প্রথা হচ্ছে, সরকারি দলের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দলই বিরোধী দল হবে । সেই দলের নেতা বিরোধী দলের নেতা হবেন। সেখানে তাদের কতটি আসন থাকতে হবে, এরকম কোনো বিষয় নেই। ভারতের লোকসভার দৃষ্টান্তও টানেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
ভারতের লোকসভা ৫৪৫ টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। তাতে কমপক্ষে এক-দশমাংশ আসন পেলে ‘সংসদীয় দল’র মর্যাদা পায়। ৩০ জনের কম হলে সংসদীয় গ্রুপের স্বীকৃতিও মেলে না। তবে ‘সংসদীয় গ্রুপ’ কখনো ‘বিরোধী দল’র মর্যাদা পায় না। ১৯৬৯ পর্যন্ত পরপর ৩টি লোকসভা মেয়াদ পূর্ণ করে কোনো ধরণের ‘বিরোধী দল’ ছাড়াই। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘বিরোধী দল’ হওয়ার মধ্যে শর্তের তেমন বালাই নেই। সংখ্যা যা-ই হোক তাদেরকে ‘সরকারের বিরোধিতাকারী দল’ বলা হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন পেয়েছে। তাতে এ দলটিকে ‘সংসদীয় অধিসংঘ’র সংজ্ঞায় ফেলা যায়। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আওয়ামীলীগের পরই সবচেয়ে বেশি আসনে ( ৬২টি) জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাদেরকে ‘বিরোধী দল’র স্বীকৃতি দিতে হলে ‘বিরোধী দল’র নতুন সংজ্ঞা প্রণয়ন করতে হবে। কারণ, বিরোধী দল হওয়ার মতো কোনো শর্তই স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ পূরণ করেন না। প্রথমত: তারা স্বতন্ত্র। কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব তারা করতে পারেন না। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামীলীগের সঙ্গে আছেন। সংবিধানের বহুল বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কথা বললে তার এমপি পদ চলে যাবে। এমনকি দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করলে দল থেকে বহিষ্কার করা হতো। কিন্তু এবার বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বরং উৎসাহ দেয়া হয়েছে। একই রকম গোজামিল দিয়ে জাতীয় সংসদে স্পীকারের রুলিংয়ের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়েই ‘বিরোধী দল’ সৃষ্টি করা হবে ? এমন প্রশ্ন রাজনীতি বিশ্লেষকদের মনে।
এ বিষয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে ফোন করা হলে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি এখন ট্রেনে আছি। ঢাকায় এসে কথা বলবো।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা