ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
হ আলু ক্ষেতে পাতার মড়ক রোগ দেখা দিয়েছে, বালাইনাশকেও কাজ হচ্ছে না হ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোরোর বীজতলা হ বৃষ্টি হলে আলু ও টমেটোর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

শীত ও কুয়াশায় কৃষিখাতে বিরূপ প্রভাব

Daily Inqilab রফিক মুহাম্মদ

১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় কৃষিখাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কয়েকদিন ধরে জেঁকে বসা কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। শীতকালীন বিভিন্ন সবজি আলু, পেঁয়াজ, টমেটো ক্ষেত নিয়ে কৃষকরা উদ্বিগ্ন। আবার অনেক স্থানে আগাম জাতের আমের মুকুলও ঝরে যাচ্ছে। তবে বিশেষ করে আলুতে দেখা দিয়েছে লেটব্লাষ্টইট রোগ। তা ছাড়া হঠাৎ ঘন কুয়াশায় বোরো ধানের বীজতলা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষকরা। তীব্র শীতে কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হচ্ছে বোরোর বীজতলা। অনেক এলাকায় বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারার গোড়া বা পাতা পচা রোগ এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে বীজতলা দুর্বল হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন চাষিরা। সূর্যের আলো ঠিকমতো না পাওয়ায় বোরোর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। আবাহাওয়া অফিস বলছে বৃষ্টি হলে ঘন কুয়াশা কেটে যাবে এবং শীতের তীব্রতাও কমবে। তবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছে এই শীতে বৃষ্টি হলে তা কৃষির জন্য আরও ক্ষতির কারণ হবে। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ রোগের সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে। এতে করে আলু ও টমেটোর অনেক ক্ষতি হবে।
কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে শীতের তীব্রতা ছড়িয়েছে। রংপুর বিভাগের সব জেলা, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে শীত, ঘন কুয়াশার সাথে বইছে হিমেল বাতাস। দেখা মিলছে না রোদ্দুর। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার পাশাপাশি কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। এই অবস্থা আরও দু’তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে তীব্র শীতে জবুথবু প্রাণ-প্রকৃতি। মানুষের পাশপাশি গবাদি পশু আক্রান্ত হচ্ছে শীতজনিত নানা রোগে। ভোগান্তিতে পড়েছেন খামারিসহ প্রান্তিক কৃষক। কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার দাবি কৃষকদের। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে রবিশস্য ও বোরোর আবাদে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে চাষিদের আশঙ্কা। বোরোর চারা রক্ষায় পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখাসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
জানা গেছে, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলায় এবার শীতের প্রকোপ বেশি। তীব্র শীতে এসব জেলার বিভিন্ন স্থানে আলু, টমেটো, সরিষা, বোরোর বীজতলাসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে আলু ক্ষেতে ব্যাপক হারে লেটব্লাষ্টইট বা আলুর মড়ক রোগ দেখা দিয়েছে। এতে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ফলে ওই রোগের কারণে আলুর পাতা ও কালো কালো ফোসকা পড়ে মরে যাচ্ছে তরতাজা সবুজ গাছ। এ রোগ মহামারি আকারে ছড়ালে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করছেন আলু চাষিরা।
কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যখন আলুর গাছগুলো সবুজ রং ধারণ করে সজীব হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েকদিন থেকে ঘন কুয়াশা ও কনকনে তীব্র শীতের সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় আলু ক্ষেতে লেটব্লাষ্টইট বা পাতার মড়ক রোগ দেখা দিয়েছে। ফলে অধিকাংশ কৃষক আলু ক্ষেত রক্ষায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। টানা শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে ঘন কুয়াশার প্রভাবে অধিকাংশ আলু ক্ষেতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে লেটব্লাষ্টইট বা পাতা মোড়ানো রোগাক্রান্ত আলু ক্ষেতে মেটারিল, মেটাটাফ ও ফোরাম বালাইনাশক সমন্বিতভাবে স্প্রে করেছেন কৃষকরা। সাত দিন পর স্প্রে করছেন রিভাস নামের কীটনাশক। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ক্ষেতে বালাইনাশক স্প্রে করেও সুফল পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের কৃষক মো. শফিকুল জানান, প্রচণ্ড ঠান্ডায় আলুর পরিচর্যা করতে কষ্ট হচ্ছে। টমেটোর গাছও মরে যাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে শীতের যে তীব্রতা, তাতে আলুর ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তিনি জানান, সার, বীজ, সেচ ও শ্রমিকের দাম বাড়ছে। কখনো কামলাও পাওয়া যায় না। ধারদেনা করে এবার ৫ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেছি। কিন্তু শীতের তীব্রতায় আলুর পচন রোগ হলে সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। তা ছাড়া বোরোর বীজতলা ক্ষতি মুখে রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, ঘন কুয়াশায় বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসছেন বীজতলা রক্ষার জন্য। আলু ক্ষেতে এখনো কোন সংক্রামক রোগ দেখা দেয়নি। আমরা মাঠ পর্যায়ে এসব বিষয়ে তদারকি করছি।
রাজশাহীর কয়েকটি উপজেলার কয়েকজন কৃষক জানান, শীত ও ঘনকুয়াশায় বোরোর বীজতলার বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন তারা। শীত ও কুয়াশা থেকে রক্ষা পেতে অনেক কৃষক বিকেল থেকেই বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখছেন। তারপরও তীব্র শীত ও ঘনকুয়াশায় বীজতলার চারাগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। এতে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং) মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, বৈরী আবহাওয়া ও কুয়াশা দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রাকৃতিকভাবেই বীজতলার ক্ষতি হবে। মোটামুটি রোদ পেলে বীজতলা ঠিক হয়ে যাবে। চারার বৃদ্ধিতে নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব কমাতে ঘনকুয়াশা ও বেশি শীতে বোরো ধানের বীজতলা সকাল ১০টা থেকে সাদা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে সন্ধ্যার আগে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া সন্ধ্যায় পানি সেচ দিয়ে বীজতলার চারা ডুবিয়ে দিতে হবে এবং সকালে সেই পানি বের করে দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে দড়ি টেনে দিয়ে বীজতলার চারায় জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। এসব পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এ ছাড়া আলু ক্ষেতে কয়েকদিন বালাই নাশক ছিটালে ব্লাষ্ট সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন এবং সরজমিন তদারকিও করছেন।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, কয়েকদিনের প্রচন্ড শীত আর ঘন কুয়াশার কারনে নওগাঁ জেলায় বোরো বীজতলা এবং আলুর মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বীজতলা ক্ষতির কারনে আসন্ন বোরো মওসুমে বোরো ধান রোপনের ক্ষেত্রে ধার্যকৃত লক্ষমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে আলুর মারাত্মক ক্ষতির কারনে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে কৃষকরদের মধ্যে দারুনভাবে হতাশা দেখা দিয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে তেমন কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে জেলায় মোট ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। বিশেষ করে টানা ঘন কুয়াশার কারনে জমিতে আলু মরে যেতে শুরু করেছে। আলুর পাতা, ডাল সবকিছু মরে যাচ্ছে। এমন কি কোন কোন জমিতে আলুর গাছে একটি পাতাও আস্ত নাই। কৃষকরা প্রায় প্রতিদিন কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। তাতে কোন ফল হচ্ছেনা। এমন কি এখন কৃষি বিভাগের কি পরামর্শ তাও তারা পাচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবে এসব জমিতে প্রতিবিঘায় ৬০ থেকে ৮০ মন হারে আলু উৎপাদিত হয়ে থাকে অন্য বছরগুলোতে। চলতি বছর প্রতি বিঘা জমি থেকে ৫ থেকে ৬০ মন আলু উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। অথচ কমপক্ষে বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ হয় ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। উৎপাদন খরচও ঘরে তুলতে পারবেন না কৃষকরা। কাজেই তারা ভীষনভাবে উদ্বিগ্ন।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারন উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ জানান, এখনও আলু বা বোরো চারা এখনও ক্ষতির কারন হয়নি। আবহাওয়া যদি স্বাভাবিক হয়ে যায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘ হয় তখন ক্ষতি হতে পারে। তবে কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে যাতে বিশেষ করে আলু আর বোরো বীজতলা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা