একটি গোলাপের দাম একশ’ টাকা! ভাবা যায়? বাস্তবতা হলো এটাই সঠিক। আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ উপলক্ষে প্রতিপিছ গোলাপ বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে ৫০ থেকে একশ’ টাকা পর্যন্ত। তথাকথিত এই ‘ভেলেনটাইন ডে’ নামের বেলেল্লাপনা, শয়তানি, অসভ্যতা, অপসংস্কৃতি দেশের তরুণ তরুণীদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে বইমেলা, শহর-বন্দরে, স্কুল-কলেজ ও পার্কের আঙ্গিনায় ভালবাসা দিবসের নামে অসভ্যতা ও পশুত্ব দেশের নতুন প্রজন্মকে কি শিক্ষা দিচ্ছে?

দেশের কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল শিক্ষিত মানুষ বিশ্ব ভালবাসা দিবস নামে বেহায়াপনাকে লেখালেখির মাধ্যমে সুকৌশলে উস্কে দিয়ে সমাজকে ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতির নামে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের মগজ ধোলাই করায় একটি গোলাপ একশ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
মানবপ্রেম সবচেয়ে বড় প্রেম। প্রেম ছাড়া সমাজ চলে না, মানুষ বাঁচে না। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের প্রেম, ভাইবোনের প্রেম, স্বীয় স্বামী ও সন্তানের প্রেম, দাদা-দাদি-নানা-নানির সঙ্গে নাতি-নাতনির প্রেম মানবতার এসব প্রেমই পবিত্র এবং মানব সৃষ্টির পর থেকে চলে আসছে। এছাড়া অন্য নর-নারী, যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রীর বিবাহ পূর্ব প্রেম ইসলাম ধর্ম সমর্থন না করলেও এ নিয়ে কারো বিরোধ নেই। কিন্তু ভালবাসা দিবসের নামে বেলেল্লাপনা, অপসংস্কৃতির হাট-বাজার! এ ধরনের অপসংস্কৃতি চর্চার খেলায় মেতে উঠে আমাদের সভ্যতার ভিত ক্রমান্বয়ে ধসে যাচ্ছে। মানুষের সমাজ পশুর সমাজে পরিণত হয়েছে। মানবিকতা, সভ্যতা-ভব্যতা ছেলেমেয়েরা ভুলে যেতে বসেছে।

এবার পশ্চিমা অপসংস্কৃতির তথাকথিত ‘ভালবাসা দিবস’ আইডল হয়ে গেছে খন্দকার মুশতাক আহমদ ও সিনসিয়া ইসলাম তিসা। ১৮ বছর বয়সী তিসাকে ৬৫ বছর বয়সী মুশতাক টাকার লোভে ফেলে প্রেম এবং বিয়ে করেছে। তারা সমাজ বিবর্জিত নিজেদের অপকীর্তি সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বই নামের আবর্জনা লিখে একুশের বইমেলায় হাজির হয়েছে। এর পরিণতি কি হয়েছে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। তাদের গণপিটুনি থেকে বাঁচাতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা প্রহরা দিয়ে বই মেলা থেকে বের করে দিচ্ছে। মুশতাক আহমদের লেখা ‘তিসার ভালবাসা’ এবং ‘তিসা অ্যান্ড মুশতাক’ নামের দু’টি বই প্রকাশ করেছে মিজান পাবলিশার্স। গত শুক্রবার ও গতকাল সোমবার মুশতাক ও তিসা বই মেলায় গিয়ে চরমভাবে অপমানিত হন।

এই যে ৪২ বছর বয়সের ব্যবধানে মুশতাক-তিসার অসম প্রেম এর দায় ওই তথাকথিত ‘ভ্যালেনটাই ডে’র বেলেল্লাপনা। ওই ভালবাসা দিবসে উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা-দাদার বয়সী মুশতাকের সঙ্গে কিশোরী তিসা ঘর বেঁধেছে। প্রশ্ন হচ্ছে ‘ভালবাসা দিবস’ কি কোনো দেশিয় সংস্কৃতি! মোটেও না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী চিকিৎসক ছিলেন। অনেকের সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগে তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দি করেন। বন্দি অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়ের চিকিৎসা করেন এবং অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস ওই অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন দিবস’ ঘোষণা করেন। খ্রিষ্টান জগতে পাদ্রীদের এই ঘটনাকে সম্মান জানাতে খ্রিষ্টধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে খ্রিষ্টানদের এই দিবস মুসলমানদের পালন করতে হবে কেন?

অপ্রিয় হলেও সত্য বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকার মাধ্যমে দেশে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ আমদানি করেন। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে তিনি চালাকি করে দিবসটিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে নাম বদলে দিয়ে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ হিসেবে প্রচার করেন। এতে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের কাছে দিবসটি প্রিয় হয়ে উঠে। দিবসটি যদিও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ, মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তবুও আমাদের তথাকথিত মিডিয়াগুলো তরুণ প্রজন্মকে মুসলিম ও বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, ঢাকার সাভার, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় গোলাপ ফুলের দাম হুহু করে বেড়ে গেছে। তথাকথিত ভালবাসা দিবস উপলক্ষে প্রতিপিস গোলাপ প্রকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ১৪ ফেব্রুয়ারি গোলাপের দাম আরো বেড়ে যাবে। এটা ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য খুশির খবর হলে জাতির জন্য অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে যাওয়ার নামান্তর।
ইসলাম বিদ্বেষী এবং বেলেল্লাপনার তথাকথিত এই ‘ভালোবাসা দিবস’ এর সুযোগ নিচ্ছে দেশের কিছু ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট হাউজ। তারা দেশের ছেলেমেয়েদের ভালবাসা দিবস উদযাপনে উস্কে দিয়ে ফুলের দোকান, ফ্যাশন হাউজ, উপহার-এর দোকান, বেকারি ও ফাস্ট ফুড দোকানগুলোয় বিশেষ কিছু অফার চালু করেছে। তাছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে ‘ভালোবাসা দিবসের গান’, ‘ভালোবাসা দিবসের নাটক’ ইত্যাদির আয়োজন করেছে। গত কয়েক দিন থেকে ১৪ তারিখের তথাকথিত ভালবাসা দিবসকে ঘিরে নানা রকম প্রচারণা চলছে। বিভিন্ন কোম্পানি এ দিবস উপলক্ষে নানা অফার দিয়ে তরুণ-তরুণীদেরকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। বড় বড় হোটেলগুলোর হলরুমে তারুণ্যের মিলন মেলার আয়োজন হয়েছে। সভ্যতা-শালীনতা সব হারিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে দেশে তথাকথিক ‘ভালবাসা দিবস’র নামে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘিরে যা হয়, তা দেখে শয়তানও লজ্জিত হয়। সভ্যতার নামে, সংস্কৃতির নামে দেশের মুসলমান ছেলেমেয়েদের চরিত্রহীন করা, যুবসমাজকে বিপথগামী করার জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা ধরনের আয়োজন করা হয়। আশার কথা হলো কিছু তরুণ-তরুণী বেলেল্লাপনার স্রোতে গা ভাসালেও কিছু ছেলেমেয়ে স্রোতে ভাসেননি। মুশতাক ও তিসা যখন বইমেলায় গেছে তখন দেশের বইপ্রেমি তরুণ তরুণীরা তাদের ‘সুইট ডেডি’ বলে তিরস্কার করেছে। তারা এই অসম বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকাকে (বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী) তাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের প্রেম নিয়ে ফালতু বই সমাজ ধ্বংসের ‘আবর্জনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ফলে দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা এখনো তথাকথিত ‘ভালবাসা দিবস’ নামের বেলেল্লাপনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। ফলে নতুন এই অপসংস্কৃতি আমদানি নিরুৎসাহিত করে দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব ও মানব সমাজকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে বেহায়াপনা ও প্রেম বাণিজ্য বন্ধের। না হালে দেশে মুশতাক-তিসাদের মতো অসম প্রেমের উপাখ্যান তৈরি হতেই থাকবে।