প্যারাগন গ্রুপের মালিকসহ আট জনের বিচার শুরু
২৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৫ এএম
সরকারের ৫শ’ কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতের মামলায় প্যারাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: মশিউর রহমানসহ ৮ জনের বিচার শুরু করেছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দায়েরকৃত মামলায় আজ (২৪ মার্চ) সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য্য রয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে মামলাটির আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।
এর আগে গত ৪ মার্চ ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো: ইকবাল হোসেনের আদালত মামলাটির চার্জ গঠন করেন। আজকের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
আদালত এবং দুদক সূত্র জানায়, ৫শ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মামলায় ৩ বছরের বেশি সময় আগে মশিউর রহমানসহ অন্য ৮ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। চার্জশিট দাখিলের পর দুদক তর্কিত সম্পত্তি ক্রোকের জন্য পারমিশন মামলা করে। মামলায় আদালত ক্রোকের নির্দেশ দিলেও আসামিপক্ষ উচ্চ আদালত থেকে ক্রোকাদেশের ওপর স্থিতাদেশ নেন। এর ফলে মামলাটির স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। সম্প্রতি স্থিতাদেশ ভ্যাকেট হলে চার্জশিটটি আমলে নেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য্য করেন ২৪ মার্চ।
চার্জশিটের তথ্য মতে, রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৮৩ নম্বর রোডে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের দায়ে ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি মামলা করে দুদক। সংস্থার উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আসামিরা হলেন, প্যারাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: মশিউর রহমান, আমির হোসেন দেওয়ান, এ কে এম সহিউজ্জামান, সহিউজ্জামানের স্ত্রী কামরুন নেছা, মো: মোশাররফ হোসেন ও মো: জাকারিয়া চৌধুরী। তারা রাজউকের কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাপ্ত প্লটের বেনিফিশিয়ারি ও ভোগদখলকার। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম ও তৎকালীন উপ-পরিচালক (এস্টেট) আব্দুর রহমান ভুইয়া (এ.আর.ভুইয়া)।
এফআইআর এর তথ্য মতে, রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৮৩ নম্বর রোডে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশের প্লটটির মালিক ছিল প্রিন্স করিম আগা খানের মালিকানাধীন খুলনার খালিশপুরের পিপলস জুট মিল। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট অর্ডারে সম্পত্তিটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। এতে সম্পত্তিটির মালিকানা ফিরে আসে রাজউক তথা সরকারের হাতে। ১৯৯২ সালে এখানে নতুন চারটি প্লট তৈরি করা হয়। যে সবের হাল্ডিং নম্বর: ২৮, ২৮(এ), ২৮(বি) ও ২৮(সি)। প্লটগুলো অবৈধভাবে মো: মশিউর রহমান, আমির হোসেন দেওয়ান, মোশাররফ হোসেন ও জাকারিয়া চৌধুরীকে বরাদ্দ দেয়া হয়। মো: মশিউর রহমান ও জাকারিয়া চৌধুরী বর্তমানে প্লটের দখলে রয়েছেন। অপর দুটি হাতবদল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে সেখানে গুলশান মডেল টাউনের অধীনে পৃথক আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে রাজউক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়ার প্রমাণ মেলে। অনুসন্ধান পর্যায়ে পদে পদে সৃষ্টি করা হয় বাধা। রাজউকের রেকর্ড রুম থেকে বরাদ্দের মূল নথি গায়েব করে দেয়া হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে মামলা হয়। চার বছর ধরে তদন্ত চলে মামলাটির। এর মধ্যে মামলা সংশ্লিষ্ট সরকারি সম্পত্তি যাতে দখলদাররা বিক্রি করতে না পারে সেই লক্ষ্যে তদন্ত কর্মকর্তা সেলিনা আখতার ২০১৮ সালের ১০ জুলাই পারমিশন মামলা করে রাখেন। বিচারিক ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এবং সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভুঁইয়া পারমিশন মামলার রায় দেন। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেন, কোনোপক্ষ তার প্রতারণার ফসল নিজে ভোগ করতে পারবেন না। প্রসিকিউশন (দুদক) মোকদ্দমা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। রায়ে বলা হয়, “পারমিশন মোকদ্দমাটি ৪-৮ নং প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিপক্ষগণের বিরুদ্ধে দোতরফাসূত্রে এবং অন্যান্য প্রতিপক্ষগণের বিরুদ্ধে একতরফা সূত্রে মঞ্জুর করা হলো। এতদ্বারা তফসিল বর্ণিত সম্পত্তি ‘দ্য ক্রিমিনাল ল’ এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৪৮ সনের ৪ ধারা মতে ক্রোকাবদ্ধ করার আদেশ হলো।” তবে আদালতের এই আদেশটি রহস্যজনক কারণে ইকবাল মাহমুদ কমিশন কার্যকর করতে ছিলো অনাগ্রহী। আদালতের আদেশ সত্ত্বেও ক্রোক করতে বিরত থাকে। আসামিপক্ষকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ করে দেয়। কয়েকজন আসামি পারমিশন মামলার রায়ের ওপর হাইকোর্ট থেকে স্থিতাদেশ নেন। সেইসঙ্গে মূল মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আনবেন-মর্মে বিচারিক আদালতে কালক্ষেপণের কৌশল নেন। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সম্প্রতি আসামির পক্ষে দেয়া স্থিতাদেশ রদ করেন। এতে মামলার চার্জ গঠন শুনানির আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। শুনানি শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন।
তদন্তকালে দেখা যায় যে, পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিষয়ে সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৫৪ নম্বর আদেশের ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকার গেজেট প্রকাশ করে। ওই গেজেটটি পরে ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গেজেট দ্বারা বাতিল করে সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করে। এই গেজেটে ‘খ’ নং তালিকায় ৮ নম্বর ক্রমিকে এনইজি-৬ নম্বর বাড়িটিকে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’র তালিকাভুক্ত করা হয়। এখনো বাড়িটি সরকারের (গৃহায়ণ গণপূর্ত অধিদফতর) ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’র তালিকায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির নামে অবমুক্ত বা সংশোধন করা হয়নি। ফলে এই সম্পত্তি কারও কাছে হস্তান্তর কিংবা বরাদ্দ দেয়ার অধিকার রাজউকের নেই। অথচ রাষ্ট্রপতির আদেশে পরিত্যক্ত সম্পত্তিটি রাজউকের তৎকালীন উপ-পরিচালক (রাজউকের স্মারক নং-রাউজ/এস্টেট/৫৮৮, তারিখ : ১৮/০৩/১৯৯২ খৃ: মূলে) আব্দুর রহমান ভুইয়া ‘পিপলস জুটি মিলস’র পরিবর্তে ‘এমএস জুট মিলস খালিশপুর খুলনা’র ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার প্লটটির বরাদ্দ বাতিলের চিঠি দেন। বরাদ্দ বাতিলের কারণ হিসেবে চিঠিতে ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইমারত নির্মাণ না করা’ উল্লেখ করেন। যদিও ‘এমএস জুটমিলস খালিশপুর, খুলনা’ নামে আদৌ কোনো জুট মিলের অস্তিত্ব ছিলো না। এছাড়া রাজউক এবং পিপলস জুট মিলের মধ্যে ১৯৬৮ সালের ৩ জুলাই সম্পাদিত লিজ দলিলের ৪ নম্বর শর্তে চার বছরের মধ্যে বাড়ি না করলে লিজ বাতিলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গুলশানের এনইজি-৬ প্লটের লিজ দলিল সম্পাদিত হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষে প্লটটি অবাঙ্গালি প্রিন্স আগা খানের মালিকানাধীন পিপলস জুট মিলের নামে থাকায় এটি ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। তাই ৪ বছরের মধ্যে বাড়ি করতে না পারার অজুহাতে রাজউক পিপলস জুট মিলসের নামের লিজ বরাদ্দ বাতিলের কোনো সুযোগ নেই। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ এখতিয়ার বহির্ভুতভাবে মূল নথির সমুদয় তথ্য গোপন করে মিথ্যা অজুহাতে সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দেয়। অথচ রাজউকের ডিমান্ড অ্যান্ড কালেকশন রেজিস্টারে এখনো এনইজি-৬ প্লটের মালিকানান পিপলস জুট মিলসের নামই রয়েছে। নথি সংরক্ষণের নিয়ম অনুসারে এনইজি-৬ নম্বর প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত মূল নথির নোটশিটের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী কার্যক্রম অর্থাৎ নতুন প্লট ২৮, ২৮/এ,২৮/বি, ২৮/সি’র উল্লেখ করে নোটশীট চলমান থাকার কথা হলেও রাজউক কর্তৃপক্ষ মূল নথি গায়েব করে নুতন নোটশীটের পাতা খোলে। মূল নথিটি কোথায় আছে, সে বিষয়ে রাজউক কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।
অবশেষে ৫শ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ মামলার চার্জশিট আমলে নিয়েছে আদালত। চার্জশিট দাখিলের ২ বছর পর আদালত এটি আমলে নিলো। এর আগে আত্মসাতকৃত সম্পত্তি ক্রোকাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট থেকে স্টেটাসকো আনেন আসামিপক্ষ। মূল মামলার বিচার প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ আনবেনÑ মর্মে আশ্বাস দিয়েও মামলাটির স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। দুই বছরেও কোনো স্থগিতাদেশ আনতে না পারায় গত ৪ মার্চ ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো: ইকবাল হোসেন চার্জ গঠন করেন। এ হিসেবে আজ সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য্য রয়েছে।
প্রসঙ্গত, পুরাণ ঢাকার মুদ্রণ ব্যবসায়ী মো: মশিউর রহমানসহ অন্যান্যরা ১৯৯২ সালে এনইজি-৬ প্লটের ৪৮.৬০ শতাংশ প্লট ভাগাভাগি করে নেন। নিজ ভাগে বরাদ্দ পাওয়া সম্পত্তি বন্ধক রেখে পোল্ট্রি ব্যবসার জন্য ব্যাংক ঋণ নেন বলে জানা গেছে। ভাগবাটোয়ারার অন্যতম অংশীদার মো: মশিউর রহমান বর্তমানে প্যারাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গ্রুপভুক্ত ১৪টি প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ২০ প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। রয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:-সহ ১২টি প্রতিষ্ঠানের বোর্ড মেম্বার। পাঁচশ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ মামলায় এতোদিন সব আসামিই জামিনে ছিলেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা