ভয়াবহ রূপ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে

ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা এখন বিলে পরিণত

Daily Inqilab হায়দার আলী, গোদাগাড়ী (রাজশাহী) থেকে

২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০২ এএম

নদীর দেশ বর্তমানে নদীর বেহালদশা। পদ্মা নদীসহ শ শ নদী মরে যাচ্ছে, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় দেশে জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। এখন শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা একটি নদীর নাম পদ্মা। এটা কি নদী? বিশ্বাস করা যায় না। পদ্মার সেই খরস্রোত নেই কেন? এমন সব প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে একালের শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রীসহ কোন আগন্তুককে। বিশাল-বিস্তৃত ধুধু বালুচর আর পানির ক্ষীণ বিল কিংবা লেকের মতো পদ্মার ঐতিহ্য অস্তিত্বকে এতটা বিপন্ন করেছে। ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছে আবহমানকাল ধরে প্রবাহিত গঙ্গা-পদ্মা নদীর ভারতের অংশ ফারাক্কায়। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ফরাক্কা ব্যরেজটি একতরফাভাবে নির্মাণ করে ভারত। কিন্তু ভারত কৌশলগতভাবে ব্যারেজটি তখনই চালু করেনি।

নদী আছে পানি নেই, বালু আছে কিন্তু কোথায় যেন কোন মাটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পদ্মার কোলে জেগে উঠা চরে সবুজ ফসল ফলানো সম্ভাব হচ্ছেনা। প্রতি বছর বালু জমতে জমতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পদ্মার ভয়াবহ রুপ দিনে দিনে হারিয়ে ফেলেছে। বিগত বছরগুলোতে এ নদীর ক্ষীণ স্রোতধারা থাকলেও এ বার তাও নেই। একটা বিলে পরিণত হয়েছে । এখন রেলবাজার ঘাটের সামনে মানুষ সাঁতার দিয়ে নদী পার হতে পারছেন। কয়েক বছর পর নৌকার পরিবর্তে গরুর গাড়ী, বাইক কিংবা সাইকেলে নদী পার হওয়া যাবে বলে সচেতন মহলের ধারণা।

ফারাক্কা ব্যরেজের সব কয়টি গেট বন্ধ করে নদী শাসন করে মেরে ফেলা হয়েছে অসংখ্য নদ নদীকে, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে পরিবেশ জীবন জীবিকায় নেমে এসেছে প্রচন্ড ধ্বস। দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নীচে নেমে যাওযায় উত্তাঞ্চলের বেশির ভাগ নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। দেখা দেয় তীব্র পানির সঙ্কট । উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে এই ফারাক্কা ব্যারেজ; এসব এলাকার মানুষ যাকে মরণ ফাঁদ বলে জানে ।
এ ব্যারেজ চালু হওয়ার সময় বলা হয়েছিল এটি উভয় রাষ্টের কল্যাণের প্রতীক। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিমাতাসুলভ আচারণের কারণে আজ এ ব্যারেজ দেশের মানুষের জন্য অকল্যাণ। একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত তাদের বন্দর, কৃষি, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখলেও এদেশের কৃষি, নৌযোগাযোগ, পরিবেশ, জীবন-জীবিকাকে ঠেলে দিয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে। বিভিন্ন সময়ে পদ্মার পানি বন্টন নিয়ে অনেক আলোচনা মাপজোঁক আর পর্যবেক্ষণ হয়েছে। চুক্তি হয়েছে, চুক্তি নিয়ে সংসদে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়ছে। কিন্ত বাংলাদেশের ভাগ্যে কখনই চুক্তি মোতাবেক পানি জুটেনি।

প্রতিবছরের মত এবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক দফায় হয়েছে। বন্যায় অনিবার্য ছিল নদীভাঙন। বন্যা ও নদীভাঙনে অসংখ্য বাড়ি-ঘর, স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলাদি বিনষ্ট হয়েছে। বন্যা ও নদীভাঙনের কবলে পড়ে লাখ লাখ মানুষ দুঃখ-দুর্ভোগ, বিপদ-বিপন্নতার শিকার হয়েছে।

পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল তিস্তা সেচ প্রকল্পসহ অন্যান্য সেচ প্রকল্প তাদের কমান্ড এরিয়ার সামান্য অংশেই কেবল সেচসুবিধা দিতে পারে। বেশিরভাগ জমি সেচ সুবিধার বাইরে থেকে যায়। জমির মালিকরা তাদের মতো করে আবাদ করতে পারলে করে, না পারলে জমি পতিত থাকে। এভাবে সেচ প্রকল্পাধীন এলাকায় চাষাবাদ প্রতি বছরই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং উৎপাদন সম্ভবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। নদীতীরবর্তী এলাকায় নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহার করার কোনো সুযোগ থাকে না, নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায়। এর বাইরে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরও করে যে সেচব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাও অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়। মাত্রাতিরিক্তি পানি তোলার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আর আগের অবস্থানে নেই, বহু নিচে নেমে গেছে। দিনে দিনে পনির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে। অনেক সময় পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তাও আর্সেনিক বা অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত থাকে, ফসলের জন্য যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। বলা যায়, শুকনো মওসুমে ফসলের আবাদ-উৎপাদন ক্রমেই সঙ্কটাপন্ন ও অসম্ভবপর হয়ে উঠছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারনে, ভূগর্ভস্থ পানিতে যখন টান পড়ে তখন খালবিল, জলাশয়, পুকুর ডোবায়ও কোনো পানি থাকে না। পানির জন্য দেশজুড়েই হাহাকার পড়ে যায়। এতে আবাদ-উৎপাদনই শুধু ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এমনকি পান ও ব্যবহারযোগ্য পানিরও প্রকট অভাব দেখা দেয়। পানির দেশে পানির এই আকাল একইসঙ্গে অকল্পনীয় এবং উদ্বেগজনক।

নদীর উজানে ভারত অসংখ্য বাঁধ, প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেয়ায় দেশের শত শত নদী এখন শুকনো মওসুমে পানি শূন্যতার শিকারে পরিণত হয়েছে। পানি না দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার ভারতীয় অভিসন্ধির কারণে নদী স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শতাধিক ছোট নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বড় নদীগুলোর অস্তিত্বের সঙ্কটও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রথমেই বলেছি ভাটির দেশ বাংলাদেশ, ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু উজানের দেশের না করার নীতি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে।

গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এ যাবৎ দুটি চুক্তি হলেও বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি। চলমান ৩০ সালা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যায্য পানিপ্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। ফলে পানিবঞ্চনা আরো বেড়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের খোলাখুলি বক্তব্য, শুকনো মওসুমে তিস্তার পানি প্রবাাহ এত কমে আসে, যে, তা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজনই মেটে না, বাংলাদেশকে আমরা পানি দেবো কিভাবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং সব নদীকে পানি সংরক্ষণাগারে পরিণত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করা দরকার। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের কথা এদেশের মানুষ দশকের পর দশক ধরে শুনে আসছে। ব্যারাজটি এখনও নির্মাণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের তরফে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের কথা বার বার বলা হলেও এখন শোনা যাচ্ছে, ভারতের বিরোধিতার কারণে সরকার দ্বিধায় পড়ে গেছে। সরকার ভারতের সহযোগিতা নিয়ে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ চায় বলে জানানো হয়েছে। তাতেও কোনো ফলোদয় হয়নি। গঙ্গা-পদ্মা অভিন্ন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে, এ কথাটি আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারিনা কেন? আমাদের বলা উচিৎ নয় কি?


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ