দুদকে পাভেলদের কী কাজ?
২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম
৮১টি বাঙালি গুচ্ছগ্রাম ছিলো খাগড়াছড়ির দিঘিনালায়। গ্রামগুলোতে রেশনকার্ডধারী মানুষ ছিলেন ২৬ হাজার। তাদের সঞ্চিত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে খাগড়াছড়ির দিঘিনালা তৎকালীন উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিলো, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ কর্মকর্তারা পরিকল্পিতভাবে ‘গুচ্ছগ্রামভিত্তিক প্রকল্প-সভাপতি’ নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য হয়েছে। ২ লাখ টাকা নিয়ে তখন ‘গুচ্ছগ্রামভিত্তিক প্রকল্প-সভাপতি’ নিয়োগ দেয়া হয়। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া প্রকল্পসভাপতিরা রেশনকার্ডধারীদের ওজনে কম প্রদান এবং পচা চাল রেশন হিসেবে কার্ডধারীদের সরবরাহ করেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা তখন খাগড়াছড়ি সদর কলাবাগান ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন। ঘটনাটি ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবরের। ওই সময় দিঘিনালার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুল জাহিদ পাভেল। প্রকল্প-সভাপতি নিয়োগের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সেই অভিযোগটি সময়ের শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে যায়। ঘটনাটি এক দশক আগের। যত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং অকাট্য প্রমাণই থাকুক না কেন, কে করবে এই অনুসন্ধান ? কেই বা দায়ের করবে মামলা? কোন্ আদালতে হবে এর বিচার? কারণ যার বিরুদ্ধে তখন ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে, তিনি এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) খাসবান্দা ! কেতাদুরস্ত, চুপচাপ স্বভাবের এই কর্মকর্তা গল্পকারও বটে। মানব অনুভূতির সূক্ষ¥াতিসূক্ষ¥ বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। তার গল্পে উঠে আসে মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা, দারিদ্র্য এমনকি দুর্নীতি, ন্যায় বিচার ও শুদ্ধাচারের কথাবার্তা। আপাতঃ দৃষ্টিতে তাকে তাই ‘ছহি’ মানুষ হিসেবেই ঠাহর হতে পারে যে কারও কাছে। অথচ খাগড়াছড়ির গুচ্ছগ্রামের দরিদ্রদের রেশন নিয়ে যে নয়-ছয় হয়েছে- সেটির গতানুগতিক জবাব ছাড়া তিনি তেমন কিছুই দেননি। তার বিষয়ে ন্যূনতম একটি অনুসন্ধানও ইকবাল মাহমুদ কমিশন শুরু করেননি। বরং করেছেন পুরস্কৃৃত।
এহেন দুদক পরিচালক ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পড়ে আছেন দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘দুদক’এ। প্রশাসন ক্যাডারের (পরিচিতি নং-১৬০৩৭) এই কর্মকর্তাকে শায়েস্তাগঞ্জের এডিসি (সার্বিক) থাকাকালে বিতর্কিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নিজের ‘একান্ত সচিব’ করে নিয়ে আসেন দুদকে। ‘পিএস’ হলেও তাকে দেয়া হয় ‘দুদক পরিচালক’র মর্যাদায়। দায়িত্ব দেয়া হয় অনুসন্ধান-তদন্ত-৭ এর। তাকে দিয়ে করানো হতো ইকবাল মাহমুদের ব্যক্তিগত ফুট-ফরমায়েশ। পিএস পদগুলো সাধারণতঃ ঊর্ধ্বতনের বদলি কিংবা রিটায়ার্ড করলে পিএস পদধারীরা অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। ব্যতিক্রম শুধু ফজলুল জাহিদ পাভেলের ক্ষেত্রে। ইকবাল মাহমুদ বিদায় নেয়ার পর তাকে বদলির ব্যবস্থা না করে রেখে যান নিজের একজন একনিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে। দুদকে চেয়ারম্যান হয়ে আসেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। কিন্তু ইকবাল মাহমুদের পিএস ফজলুল জাহিদ পাভেল কায়দা করে থেকে যান বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গেও। যদিও তিনি নতুন একজন পিএস নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পিএস’র প্রক্সি দিচ্ছিলেন। কিন্তু উপ-সচিব মো: আল-মামুন পিএস হিসেবে নিয়োগ লাভের পরও রহস্যজনকভাবে পিএস হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যান ফজলুল জাহিদ পাভেল।
তিন সদস্যের কমিশনের অর্গানোগ্রামে ৩ জন পিএস’র পদ থাকলেও পাভেলসহ বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৪ জন পিএস। মো: আল-মামুন পিএস হিসেবে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত পাভেল বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মামুন যোগদানের পরও তিনি পিএস’র পদ ছাড়েননি। অনু:-তদন্ত-৭ এর পরিচালক হিসেবে দুদক প্রধান কার্যালয়ের গ্যারেজ ভবনে তার সুপরিসর কক্ষ। কিন্তু তিনি সেখানে খুব কমই বসেন। কথা বলতে একাধিক দিন তার কক্ষে গেলেও প্রতিবারই কক্ষ বন্ধ পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষাপটে গতকাল শনিবার তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ‘কল’ দেয়া হয়। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এদিকে কমিশনের অন্য কর্মকর্তাদের বসার স্থান সংকুলান না হলেও চেয়ারম্যানের ‘খাস লোক’ হওয়ার দাপটে একাই কব্জায় রেখে দিয়েছেন দু’টি কক্ষ। নির্ধারিত কক্ষের পরিবর্তে সারাক্ষণ অবস্থান করেন মূল ভবনের ৫ তলাস্থ ‘রেডব্লক’ এ চেয়ারম্যান দফতর সংলগ্ন কক্ষে।
বরিশালের দায়িত্বে বসিয়ে রাখা হলেও তিনি কার্যত কোনো তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান করেন না। অথচ তদন্ত-অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন প্রকার আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় দুদকের পক্ষ থেকে পাঠানো হয় পাভেলকে। ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ আইন’ বিষয়ক এক সমন্বিত কর্মশালায় তিনি যোগদান করেন। যদিও ওই কর্মশালাটি ছিলো ভূমি মন্ত্রণালয় ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য। এ হিসেবে ফজলুল জাহিদ পাভেল উল্লেখিত ক্রাইটেরিয়ায় পড়েন না।
দুদক সূত্রটি জানায়, অফিসিয়াল পদবি যা-ই থাকুক না কেন, ফজলুল জাহিদ পাভেলের মূল কাজ হচ্ছে পূর্বতন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখভাল করা। ইকবাল মাহমুদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিতভাবে সম্পাদিত নথিগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা।
সূত্রমতে, ইকবাল মাহমুদ ফজলুল জাহিদ পাভেলকে দুদকে রেখেই যান তার ব্যক্তিগত স্বার্থ সুরক্ষার প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসেবে। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে থাকলেও তিনি দুদক এবং দুদক চেয়ারম্যানের সার্বিক কার্যক্রমের নিয়মিত ‘আপডেট’ দেন ইকবাল মাহমুদকে। এ কারণে ইকবাল মাহমুদের অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের নথিতে হাত দিতে কেউ সাহস করেন না।
সূত্র আরো জানায়, চেয়ারম্যানের পিএস মো: আল-মামুন সম্প্রতি যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেছেন। অন্য একটি সরকারি দফতরে তার পদায়নও হয়েছে। কিন্তু কমিশনকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনি চেষ্টায় আছে ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে দুদকেই থেকে যেতে। অন্যদিকে এই চেয়ারে স্থায়ীভাবে বসতে উন্মুখ হয়ে আছেন পাঁচ বছর আগে দুদকে প্রেষণে আসা পরিচালক ফজলুল জাহিদ পাভেল।
সূত্রমতে, ফজলুল জাহিদ পাভেল ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ির দিঘিনালা উপজেলার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় দিঘিনালায় ৫১ বডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ব্যাটালিয়নের সদর দফতর স্থাপনকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ সমর্থিত ‘দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটি’সহ কয়েকটি পাহাড়ি সংগঠন মানববন্ধন ও সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। ওই সমাবেশ পন্ড করতে পাভেল উপজেলা পরিষদ থেকে বাবুছড়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেন। ডিসি হিসেবে ‘ফিটলিস্টে’র পরীক্ষায় তিনি ওই ঘটনাকে সাহসিকতাপূর্ণ ‘কৃতিত্ব’ হিসেবে উল্লেখ করেন। গতবছর ৯ মার্চ ফজলুল জাহিদ পাভেল জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ইন্টারভিউ দেন। তাতে তিনি ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হন। ওই সাক্ষাৎকারে তার সিরিয়াল ছিলো ২২ নম্বরে।
দিঘিনালা থেকে ২০১৭ সালে তাকে বদলি করা হয় কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে। সেখানেও তার বিরুদ্ধে ওঠে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। তা সত্ত্বেও লবিং করে পদোন্নতি পেয়ে এডিসি (সার্বিক) হিসেবে। যোগদান করেন সিলেট শায়েস্তাগঞ্জ জেলায়। সেখান থেকে ইকবাল মাহমুদ তাকে ২০১৯ সালে একান্ত সচিব করে দুদক কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। ইকবাল মাহমুদের খয়ের খাঁ হিসেবে এখানে তিনি স্বীয় অবস্থান সংহত করেন। কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী ইকবাল মাহমুদের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ফললুল জাহিদের কাছে রীতিমতো ‘ইন্টারভিউ’ দিতে হতো। অনেক ভুক্তভোগী ন্যায়সঙ্গত বিষয় নিয়ে ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলে পাভেলের অনুমোদন ছাড়া মিলতো সাক্ষাৎ। তার আমলাতান্ত্রিক আচরণে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন অনেকে।
সূত্রটি জানায়, বর্তমান সরকারের ‘প্রিয়পাত্র’ হতে তার চেষ্টার অন্ত ছিলো না চাকরির শুরু থেকেই। এ লক্ষ্যে তিনি মাঠপর্যায় থেকে ‘কাজ’ও করে আসছেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-১ আসনে তৎকালীন ‘গণফোরাম’ প্রার্থী ড. রেজা কিবরিয়ার মনোনয়নপত্রটি বাছাই পর্বে বাতিল করে দেন। পাভেল তখন হবিগঞ্জের রিটার্নিং অফিসার (ডিসি) মাহমুদুল কবীর মুরাদের একান্ত অনুগত কর্মকর্তা ছিলেন।
এদিকে দুদক সূত্রটি জানায়, শুধু ফজলুল জাহিদ পাভেল নন। ডেপুটেশনে আসা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ, পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল, আব্দুল আউয়ালও ৫-৬ বছর ধরে দুদকে পড়ে আছেন। তাদের প্রত্যেকের যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি হলেও পড়ে আছেন দুদকেই। তারা কেউ সরাসরি অনুসন্ধান-তদন্ত করছেন না। তাদেরকে কোনো মামলার বাদী হতেও দেখা যায় না। ‘তদারককারী কর্মকর্তা’ হিসেবে তাদের অনেক গাফলতি ধরা পড়লেও অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। কমিশন কর্মকর্তাদের ওপর বসে ছড়ি ঘোরালেও কোনো মামলায় তাদের সাক্ষী পর্যন্ত করা হয় না। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে প্রেষণে পদ দখলে রাখা প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রকৃতপক্ষে কি কাজ ? পদোন্নতি পেয়েও কী অদৃশ্য মধু-মোহে তারা নিম্নতম পদে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন দুদকে?
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা, দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল জনতা
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন বোর্ড, নিয়ন্ত্রণ এস আলমের হাতে
তুরস্কের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় ‘চরম বিপাকে’ ইসরায়েল
রাউজানে অপহরণের ১৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার চুয়েট স্কুল ছাত্র সাজিদ
পাকিস্তানে ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত, ১৪৪ জনের প্রাণহানি
সুন্দরবনে আগুন যেখানে ধোঁয়া সেখানেই পানি দেওয়া হচ্ছে
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একসঙ্গে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিলেন প্রসূতি
বীরাঙ্গনার বাড়ির পানির বিল ১৭ লাখ!
সন্ধ্যার মধ্যে ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে পশ্চিমারা স্পষ্ট ভণ্ডামি করছে : মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী
পোস্ট দেখেই ‘ফলো’ দুষ্কৃতীদের, রেস্তোরাঁয় ঢুকে ইকুয়েডর সুন্দরীকে খুন
শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল ইন্দোনেশিয়া
দেশের সার্বিক কাজে হিজড়া সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন-সিলেট জেলা প্রশাসক
জাপানে শিশু সংখ্যায় সর্বনিম্ন রেকর্ড
গৌরনদীতে লোডশেডিং ও তীব্র গরমে কদর বেড়েছে হাতপাখার
নির্বাচনে কঙ্গনার বিরুদ্ধে লড়তে চান রাখি
সিসিকে ভৌতিক হারে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ : বিএনপির নিন্দা ও প্রতিবাদ
‘সারেগামাপা’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ
বিশ্রামে যাচ্ছেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান!
শেনচেনে গ্যাস স্টেশন ছাড়িয়ে ৩৬২টি সুপারচার্জিং স্টেশন