‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিবিদ সাংবাদিক বেশি অভিযুক্ত’

‘দেশে এখন কবরস্থানের মতো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান’

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০১ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম

বিতর্কিত আইন হিসেবে পরিচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) করা মামলায় ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন বিরোধী দলের (বিএনপি) রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির (আওয়ামী লীগ) সঙ্গে যুক্তরা শীর্ষে আছেন। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে। গতকাল মঙ্গলবার ডিজিটাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) একটি ওয়েবিনারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা’ নামে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। এতে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সংবাদপত্র, আদালতের নথি, আইনজীবী, ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা হয়েছে। এগুলোকে এ গবেষণার উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশি বিদেশী চাপ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এ গবেষণার প্রধান গবেষক ছিলেন। ওয়েবিনারে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত তিনি তুলে ধরেন। তাতে দেখা যায়, ৫ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ৪ হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত এবং ১ হাজার ৫৪৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় ২৪টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ২৬ জন। অভিযুক্তের মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। এ ছাড়া অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকেরা বেশি অভিযুক্ত।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৯০টি। বেশির ভাগ মামলা করেছেন তার সমর্থকেরা। এরপর বেশি মামলা করেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার দায়ে এ আইনে মামলা হয়েছে ৯০৮টি। এই আইনে বাকি ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, মামলায় দেশের কোনো জেলা বাদ যায়নি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ২৮ শিশুকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গবেষণায় তিনি কিছু উদ্বেগজনক বিষয় তুলে ধরেন। এগুলো হলো স্বচ্ছতার অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিচার-পূর্ব আটক, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় আনা এবং আইনের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার।
গবেষণায় সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে আটক ব্যক্তিদের জামিন এবং গত ৫ বছরে এই আইনের অধীনে করা মামলাগুলো পর্যালোচনার জন্য নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা।
সাংবাদিকদের অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, এখন সাংবাদিকতার অনেক চ্যালেঞ্জ। মালিকানা, নিজেদের দলীয়করণ এবং ডিএসএর মতো আইন। ডিএসএ শুধু সাংবাদিকতার ওপরই প্রভাব ফেলছে না। এটা একাডেমিক, গবেষণার ওপরও প্রভাব ফেলছে। তিনি আরো বলেন, স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা, কোয়ালিশন (জোট) করতে হবে। সেটা না হলে প্রতিকূল পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের পর যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে, তা কবরস্থানের মতো। যেখানে পাখির কিচিরমিচিরসহ শান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করে। এটা কাম্য নয়। এর কারণ হচ্ছে ডিএসএর মতো আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাগরিক সমাজকে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, এই আইনগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে প্রতিপক্ষ মাঠ ছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তারা যেখানে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারছে না, সেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষে এই ভূমিকা পালন করার আশাও বিলাসী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, সরকার, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনকে এবং এক-দুটি পরিবারকে সুরক্ষা দিতে যদি কোনো আইন হয়, তবে সে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থাকে। তেমন একটি আইন হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে কিন্তু ডিজিটাল আইনের এই ৫ বছরই তাদের কলঙ্কময় করতে যথেষ্ট।
এএফপির ব্যুরোপ্রধান শফিকুল আলম বলেন, ডিএসএর উদ্দেশ্য ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ বানানো। ডিএসএ পুরোপুরি বাতিল করারই আন্দোলন করা উচিত ছিল। কারণ, এটা ডিএসএ বা সিএসএ যে ফর্মেই থাককু না কেন, এটার অপপ্রয়োগ হবেই।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আরো বক্তব্য দেন সংস্থার চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান প্রমূখ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু