নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্রই
১৫ মে ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৫ মে ২০২৪, ১২:০১ এএম
এমনিতেই দুই বছর ধরে চলছে ডলার সংকট। আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা চেষ্টা এবং আইএমএফের ঋণ নিয়েও ডলার সংকটের সুরাহা করতে পারেনি সরকার। ডলার সংকটে আগে থেকেই সব পণ্যের দাম বেশি। এর মধ্যে ৮ মে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই পণ্যের দামের উপর সেটির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে চাল, ডাল, আটা এবং ভোজ্য তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দেশের ব্যাংক ও খোলাবাজারে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। দেশের মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে একাধিক পদক্ষেপও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের দাম। চলমান সঙ্কটে বেশি বিপাকে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ২০২২ সালের মার্চ থেকে ব্যাপক হারে দেশে মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ ডলারের অফিশিয়াল দাম ছিল ৮৬ দশমিক ২০ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে এখন ১১৭ টাকায় উঠেছে। ২৫ মাসের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। তবে ব্যাংকগুলো আমদানি দায় মেটাতে ডলারের দাম ১২০ টাকার বেশি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। কারণ ব্যাংকগুলো ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্স কিনছে।
এদিকে ডলার দাম বৃদ্ধি পেলেও খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না বিদেশি এই মুদ্রাটি। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতেও থাকছে বিভিন্ন রেট। ডলারের দর ১১৭ বেঁধে দেওযার পরও খোলা বাজারে এ মুদ্রা তিন দামে বিক্রি হচ্ছে। একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেওয়া মূল্য, দ্বিতীয়টি মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ রেট ও তিন নম্বরটি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর নিয়োজিত এজেন্টের দাম। গতকাল মতিঝিলের দিলকুশা ও পুরানা পল্টনের মানি এক্সচেন্স হাউজগুলোয় এ দৃশ্য দেখা গেছে। শৃঙ্খলা না থাকায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অপরিপক্ক পদক্ষেপে বর্তমান পরিষ্থিতির তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের আমদানি ও পরিবহন খবর বেড়ে যাওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তাদের মতে, ডলারের দাম এক লাফে সাত টাকা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের খরচও অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ছাড়া তো উপায় নেই বলে উল্লেখ করেন খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিকারক মোহাম্মদ মাজেদ। যদিও এত অল্প সময়ে মধ্যে খাদ্যপণ্যের দামে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ার কোনও কারণ নেই বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঙ্কট সমাধানের জন্য বাংলাদেশে যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, এতে শিগগিরই এই ডলার সমস্যার সমাধান হবে না, যদি আমরা রেমিট্যান্স ও এক্সপোর্ট গ্রোথ বাড়াতে না পারি। পাশাপাশি মাল্টিল্যাটারাল অ্যাসিস্ট্যান্স যাতে পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়নের শর্ত রয়েছে, যেগুলো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
সরেজমিনে দেখা যায়, মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২১ টাকায়। আবার যখন এ হাউজগুলো থেকে দূরে এজেন্টরা বিক্রি করছেন, মুদ্রার দাম হয়ে যাচ্ছে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত। অপরদিকে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করা দাম বোর্ডে দেখানো হচ্ছে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা। মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর বাইরে দেখা গেছে, কেউ গেলে ডলার বা রিয়াল কিনবেন কিনা, জানতে চাওয়া হচ্ছে। কেউ আগ্রহ প্রকাশ করছে ডলারের মূল্য ১২১ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে পুরানা পল্টনের লিগ্যাল মানি এক্সচেঞ্জের সত্ত্বাধিকারী মো. মনির হোসেন বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি করছে। তবে ডলার স্টকে নেই। পেলে বিক্রি করি। পাশের অন্যান্য হাউজে ডলার ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দিলকুশার গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জে গেলে এক বিক্রেতা ক্রেতা ভেবে ডলার ১২১ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। সাংবাদিক পরিচয় দিলে ডলারের দাম ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা বলে জানান তিনি। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দাম। এই দামে বিক্রি করছেন বলেও তিনি দাবি করেন। তবে তাদের কাছে ডলারের স্টক নেই।
খোলা বাজারে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় দামের পেছনে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিমাতাসুলভ আচরণ দায়ী বলে মনে করছে এ খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোয় যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে- মানি এক্সচেঞ্জগুলো সেগুলো পায় না। ফলে খোলা বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হয়। আর বেঁধে দেওয়া দামও একটি অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। যে কারণে খোলা বাজারে ডলার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না।
এ বিষয়ে মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমএস জামান বলেন, ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ বিভিন্ন সোর্স থেকে ডলার পেয়ে থাকে। তারা প্রণোদনা সহ ১১৯ টাকা ৯০ পয়সা দামে রেমিট্যান্স কিনছে। আর মানি এক্সচেঞ্জের ডলার সংগ্রহের একমাত্র উৎস বিদেশ ফেরত প্রবাসী বা ভ্রমণকারীরা। তারা যদি ব্যাংকে বাড়তি দামে ডলার বিক্রি করতে পারে তাহলে আমাদের কাছে কেন কম দামে প্রবাসী আয় ডলার বিক্রি করবে। আর মানি এক্সচেঞ্জ লোকশান দিয়ে কম দামে ডলার বিক্রি করলেও কত পরিমাণই বা দিতে পারবে?
গত বুধবার ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগে থেকেই অবশ্য এ মুদ্রা ১২০ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল। নতুন করে ১১৭ টাকা করায় খোলা বাজারে ডলার বিক্রেতাদের উপস্থিতি কমে গেছে।
ডলার সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্ত মাঝারি উদ্যোক্তা শাবাব লেদারের মালিক মাকসুদা খাতুন বলেন, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আমার মতো অনেক উদ্যোক্তাকে ডলার সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়। একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ডলারের ব্যবস্থা করা যায় না। যেসব বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক ভালো, তারাই ডলার পায় এবং এলসি করতে পারে। এতে ছোট রফতানিকারকদের বায়াররা আগ্রহ হারান। কারণ আমরা বায়ারদের চাহিদামতো পণ্য সরবরাহ করতে পারি না। এ বছর (২০২৪) আমরা নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করছি। আশা করছি, বায়াররাও বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের বিষয় বুঝতে পেরেছেন।
বাংলাদেশে খাদ্যশস্য ও মসলার বাৎসরিক চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, ছোলা, সয়াবিনসহ বিভিন্ন রকম নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য রয়েছে। ডলারের দাম বাড়ার ঘোষণার পর থেকেই সেসব খাদ্য পণ্যের বাজারে বেশ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। গত সোমবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে প্রকাশিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকায় দেখা যাচ্ছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে মোটা চাল এক শতাংশ এবং সরু চালের দাম প্রায় তিন শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে, প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিতে সাড়ে চার শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল এবং সুপার পাম ওয়েলের দাম সাড়ে ৯১ শতাংশ, নেপালি ডাল প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ এবং এলাচের দাম প্রতি কেজিতে প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। দু’টি কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
এলসি খোলার জন্য আগে যেখানে ১০ শতাংশ টাকা জমা দিলেই চলতো, এখন সেখানে শতভাগ টাকা জমা দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ঢাকার শ্যামবাজারের খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রদেশ পোদ্দার। একই সঙ্গে, আমদানি শুল্ক, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়াতেও খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দাম ও ঋণের সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ডলারের দাম ১১০ থেকে একলাফে সাত টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। এতে সরাসরি প্রভাব পড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও খোলাবাজারে। এলসি খোলার কিছু ক্ষেত্রে ১২০ টাকা এবং খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৫ টাকা ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার আগমনের চেয়ে বহির্গমন বেশি। এটা যত দিন না বাড়বে, তত দিন সঙ্কট কাটবে না। ডলারের বহির্গমন ঠেকাতে বড় বড় এলসি তদারকি এবং কিছু বিলাসী পণ্য আমদানিতে শর্ত আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? দেশের প্রয়োজনেই একটা সময় এই শর্ত তুলে দিতে হবে। কারণ বিদেশ থেকে ফ্যাক্টরির মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি না করলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। তাই আমদানিতে আরোপ করা এই সীমা একটা সময় উঠিয়ে দিতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী
কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?
গুজবে কান দেবেন না : জনপ্রশাসন সচিব
কোয়াড সম্মেলনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা
এনজিও,নাস্তিকদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সংগ্রাম চলবে- চরমোনাই
লৌহজংয়ে দিনমজুর যুবকের আত্মহত্যা
তিন সপ্তাহেও কোনো রেমিট্যান্স আসেনি যে ৭ ব্যাংকে
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ফাঁসির দাবিতে সুনামগঞ্জে বিএনপির বিক্ষোভ
রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গৃহবধুর মৃত্যু
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম গ্রেপ্তার
পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
শ্রীলঙ্কার সামনে রাচিন বাধা
বৃহৎ স্বার্থে ভারতে ইলিশ রফতানির অনুমোদন: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও পুলিশিং কার্যক্রমে গতি আনতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম শুরু
ফারাক্কা বাঁধের কারনে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটির সদস্য হলেন ডুজার সাবেক সভাপতি তুষার
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জামায়াত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে -কক্সবাজারে সমাবেশে নেতৃবৃন্দ
আইবিটিআরএ-তে ‘সার্টিফিকেশন কোর্স অন ট্রেজারি ডিলিংস’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু
শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় হর্ন বাজানোয় নতুন নির্দেশনা
খুলনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের জরুরী মতবিনিময় সভা