পিতা-মাতার আদরবঞ্চিত কোরআনের হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুলের করুণ কাহিনী
১৬ মে ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৬ মে ২০২৪, ১২:০২ এএম
মধুখালী ডুমাইন পঞ্চপল্লীতে উগ্রবাদীদের হাতে নিহত কোরআনের হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুলের বেড়ে ওঠা ও হাফেজ থেকে শ্রমিক হওয়ার ঘটনা তুলে আনতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে পিতা-মাতার আদরবঞ্চিত দুই ভাইয়ের জীবনের করুণ কাহিনী। এই হৃদয়ভাঙা মর্মান্তিক কাহিনী তুলে আনতে গিয়ে এ প্রতিবেদককেও ঝরাতে হলো তারও চোখের পানি।
নিহত আশরাফুল ও আরশাদুলের বয়স যখন ৮/১০ বছর তখন তাদের পিতা মো. শাহজাহান খান থাকতেন প্রবাসে। ৫/৬ বছর প্রবাসী জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরার পরই আশরাফুল ও আরশাদুলের শিশু জীবনের ওপর নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে আশরাফুল ও আরশাদুলের আপন মা-আয়শা বেগম (৪০) এবং পিতা মো. শাহজাহান খানের মধ্যে দীর্ঘ ১০ বছরের সংসার জীবনের অবসান ঘটে ভুল বোঝাবুঝিতে। ভেঙে যায় সংসার। আলাদা হয়ে যায় তাদের শিশু বয়সেই দুই প্রান্তের ভাগ হয়ে যায় মা-বাবা। পিতৃহীন হয়ে পড়ে দুই ভাই। মা জননী ও বেঁচে থাকতে ঘর করে অন্যের সংসারে। পিতা জীবিত থাকতেও তারা হয়ে যায় এতিমের মতো। তথা পিতা মাতাহীন দুটি জীবন্ত বাঁধন হয়ে ওঠে হতাশার কাফন। জীবন্ত দুটি লাশ।
তাদের গর্ভধারিণী মা আয়শা বেগম (৪০)-এর স্বামী তথা তাদের পিতা শাহজাহান খান দীর্ঘদিন প্রবাসে সময় কাটানোর কারণে পারিবারিক কলহে অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আশরাফুল ও আরশাদুল মা আয়শা। পিতা বিদেশে মা অন্যের ঘরে। পুরো অসহায় হয়ে পড়ে তারা দু’জন। মা এবং বাবা দুইজন দুই মেরুতে বসবাস করলেও এই দুটি শিশুর শেষ ঠাঁই হয় বৃদ্ধ দাদী জরিনা বেগম (৬৮) এবং অবিবাহিত ছোট চাচা মো. শাজ্জাদ খানের (২৭) কাছে। দাদী এবং ছোট চাচা মিলে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি করেন তাদের। সেই ২০১২/১৩ সালের আগের কথা।
মধুখালী বিশ্ব রোডের পাশে ছিল পুরাতন মহিলা মাদরাসা। এ মাদরাসার পাশেই গড়ে উঠেছিল ছোট একটি হেফজখানা। দুই সহোদরকে ওখানে ভর্তি করে দেন দাদী জরিনা বেগম। আপন ছোট চাচা মো. সাজ্জাদ খান তাদের দুই ভাইকে প্রতিদিন মাদরাসায় দিয়ে যেতেন এবং নিয়ে আসতেন। এ মাদরাসা থেকেই দুই সহোদর আম্মাপারা, নুরানি কায়দা শেষ করে। তাদের জ্ঞান অর্জনের উর্বর শক্তির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই কোরআন হাতে দেন হেফজখানার ওস্তাদজী হাফেজ মো. মোবারক আলী। মধুখালী-যশোর সড়ক প্রশস্ত করার কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐ ছোট্ট হেফজখানাটি।
এরপর ঐ হেফজ খানার ওস্তাদজী তাদের দুই ভাইকে ভাল একটি হেফজখানায় ভর্তি করার পরামর্শ দেন দাদী ও চাচাকে। তখন তাদের সৎ মায়ের সহযোগিতায় ৬৮ বছর বয়সী দাদী জরিনা বেগম মধুখালী থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মাগুরা জেলার মোহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের ‘পাল্লা দারুল উলুম কওমী হাফেজি ও এতিম খানা ’ মাদরাসা ভর্তি করান দুই ভাইকে।
ঐ এলাকার সামাজিক রীতি-রেওয়াজ হলো মাদরাসায় যারা দূর থেকে এসে হাফেজি পড়তে আসবে এলাকার প্রত্যেকের বাড়িতে তাদের লজিং মাস্টার রাখতে হবে। ঠিক সে নিয়মে পড়ে লজিং বাড়িতে খেয়ে মাদরাসায় পড়ে। দুই ভাই নাজেরা বিভাগ হেফজখানায় একসাথে ভর্তি হয় তারা। একসাথে দুটি বিভাগে পড়া খুবই কঠিন কাজ।
ঐ মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. আবজাল হুসাইন ইনকিলাবকে জানান, তারা দুইজন ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় এ হেফজখানায়। হাফেজ ছাত্র হিসেবে আশরাফুল ১৫ পারা এবং আরশাদুল-৫ পারা কোরআন মুখস্ত করেন এখান থেকেই। এরপর দেশে চলে আসে করোনা মহামারি। সারাদেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলে তারা দুই ভাই আবারো চলে যায় বৃদ্ধ দাদী জরিনা ও ছোট চাচা সাজ্জাদ খানের কাছে।
এটাই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। পাল্লা থেকে ফিরে এসে মধুখালী এলাকার ‘শামচু আনজুয়ারা মাদরাসা’ হাফেজী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আশরাফুল ২২ পারা এবং আরশাদুল ১৫ পারা কোরআনের হাফেজ হয়ে বেরিয়ে পড়ে চরম অর্থকষ্টে। বাড়ি এসে তিন বেলা খাবার না পাওয়ার কষ্ট। সইতে পারেনি বৃদ্ধ দাদী। একদিকে দুই বেলা অনাহারী এক বেলা ভাত অথবা অর্থ ক্ষুদের জাউ খেয়ে বেঁচে থাকা। সাথে সংসারে ফিরে আসায় সৎ মায়ের অসৎ আচরণ এবং চরম দুর্ব্যবহার। পরে পারিবারিক অর্থ কষ্টের কারণে মাদরাসা ছেড়ে ফিরে আসতে হলো বাড়িতে। অভাবের সংসার। বাবা একদিকে, গর্ভধারিণী মা আরেক সংসারে। দাদীর সংসারে এসে বাসা বাধলো সৎ মা। আরাম আয়েশে বসে চারটা ডাল ভাত খাওয়ার ভাগ্য হয়নি তাদের কপালে।
বৃদ্ধ দাদীর মুখের দিক তাকিয়ে স্কুল মক্তব মাদরাসা ছেড়ে নেমে পড়লো কাজের সন্ধানে। কথা হলো নওপাড়া ইউনিয়নের চোপরঘাটের রাজের ঠিকাদার মো. জালাল উদ্দিন জালোনের সাথে। যে জালোন ডুমাইনে মন্দিরে কথিত আগুনের ঘটনায় ওদের হাত পা বেঁধে নিশ্চিত মৃত্যুতে উগ্রবাদীদের দাঁড়িয়ে থেকে সহযোগিতা করেছেন। প্রথমে রাজমিস্ত্রীর সহযোগী ৫/৬ বছর কাজ করার পর হলো ফুল মিস্ত্রি। বড় ভাই আশরাফুল হন রাজমিস্ত্রী এবং ছোট ভাই আরশাদুল হয় রড বান্ধা ও কাটার মিস্ত্রি। রোজ ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ টাকা বেতনে কাজ করেন ওরা দুই ভাই।
পঞ্চপল্লীর স্কুলের কাজটি শেষ হলেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বড় ভাই আশরাফুল। বৃদ্ধ দাদীর শেষ ইচ্ছে নাত-বউয়ের মুখ দেখেই মরবে। পারিবারিকভাবে সে প্রস্তুতি চলছিল। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইকে একসাথে গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় উগ্রবাদী হিন্দুদের হাতে মিথ্যা অজুহাতে লাশ হয়ে রক্তে ভেজা দেহ নিয়ে ফিরতে হলো দাদীর সামনে। নিথর দুটি দেহ উপহার পেল বৃদ্ধ দাদী জরিনা। যেদিন কোরআনের হাফেজ সহোদর দুটি ভাইকে উগ্রবাদীরা পিটিয়ে খুঁচিয়ে থেঁতলে হত্যা করলো সেদিন ওদের বয়স তথা আশরাফুলের বয়স ১৯ বছর এবং আরশাদুলের বয়স ১৫ বছর।
এলাকাবাসী মুখের একটাই কথা, ওরা দুটি ভাই ছিলো যেমন মেধাবী তেমনি ভদ্র এবং বিনয়ী। সুখ বলতে কী জিনিস কখনও ওদের কাছে আসেনি। শিশুকাল কাটছে একবেলা খেয়ে। কৈশর কাটছে লজিং বাড়িতে খেয়ে। যৌবনে এসে দুই ভাই একসাথে চলে গেলো পরোপারে বিপদগামীদের হাতে মিথ্যা অজুহাতের বলি হয়ে।
উল্লেখ্য, হাফেজ আশরাফুল ও আরশাদুল গত ১৮ এপ্রিল মন্দির পোড়ানো কলঙ্ক নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও মৃত্যুর ২০/২২ দিন পর ওদের কলঙ্কমুক্ত করেছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের তদন্ত টিম।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
১০০ বছর পর প্যারিসে পর্দা উঠলো অলিম্পিকের
‘খান ইউনিসে’ ৪ দিনে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ লাখ
পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কা
ইসরাইলকে বোমা সরবরাহের নীতি পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র
১ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে লোকসান ৬ কোটি
বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন
বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’
চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক
বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে
জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে
জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড
পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও
বেতাগী দরবারে ওরশ আজ
সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা
কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে
নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি
বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ
শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী
মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড