অটোরিকশা চালকদের নৈরাজ্য
২০ মে ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২০ মে ২০২৪, ১২:০৩ এএম
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় বসবাসকারী কর্মজীবীরা গতকাল ঘর থেকে বের হয়েই বিড়ম্বনায় পড়ে যান। সাপ্তাহের প্রথম দিন কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে হোঁচট খান। সড়কে সব ধরণের যানবাহনের গতিরোধ করে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করছে একদল মানুষ। বিক্ষোভ এক পর্যায়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা নৈরাজ্যে রুপ নেয়। এক সময় পুলিশের সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ৩০টির অধিক বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। বিকেলে মিরপুরের কালশীতে ট্রাফিক বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। সড়ক অবরোধ করে এই বিক্ষোভকারী কারা? এরা হচ্ছে রাজধানীতে চলাচল করা অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক। এই অটোরিকশাকে বলা হয় রাজধানীর সড়কের চলমান যমদূত। রিকশার চালকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলে। অন্য যানগুলোকে তোয়াক্কাই করে না। অবৈধভাবে রিক্সায় ব্যাটারী লাগিয়ে চলাচল করা এই যানবাহন রাজধানীতে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। এর যানবাহনের দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে এবং এর যন্ত্রণায় নগরবাসী অতিষ্ট।
গত বুধবার ১৫ মে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ব্যাটারিচালিত কোনো গাড়ি (তিন চাকার) যেন ঢাকা সিটিতে না চলে। আমরা ২২টি মহাসড়কে নিষিদ্ধ করেছি। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, চালাতে যেন না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিআরটিএ ভবনে মন্ত্রীর সঙ্গে ওই সভায় ঢাকার দুই মেয়রও শহরের মধ্যে এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে তাদের সম্মতি জানান। অতপর রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবিতে সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি দেয় রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ।
জানতে চাইলে মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্ল্যা জানান, হাইকোর্টের আদেশের পর মিরপুর এলাকা থেকে অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে অটোরিকশা চালকরা মিরপুর-১০ গোলচত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন এবং সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর মিরপুর-১০ নম্বর চত্বরে থাকা চালকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মিরপুর-১০ নম্বর থেকে সরে তারা কালশীতে গিয়ে রাস্তায় আগুন দিয়েছে।
মূলত ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে সকাল থেকেই আগারগাঁও ও মিরপুর ১০ নম্বরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে চালকরা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০টির অধিক বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় তিন বিক্ষোভকারী আহত হয়। আগারগাঁও ও মিরপুর ১০ নম্বরে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকরা। পরে মিরপুর-১ নম্বরের সনি সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মিরপুরে যানচলাচল স্বাভাবিক করে দেয় পুলিশ। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে অটোরিকশাচালকরা কালশীতে ট্রাফিক বক্সে আগুন দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান বলেন, কালশীতে আন্দোলনকারীরা সহিংস আন্দোলন করছে। তারা কালশী মোড়ে অবস্থিত একটি পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে। পুলিশ বক্সটি ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্স। আমরা ঘটনাস্থলে আছি এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।
আন্দোলনের কারণ জানাতে গিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, তাঁদের অনেক চালককে পুলিশ আটক করেছে। তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে দেওয়া পর্যন্ত অটোরিকশা চালানোর সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, সকালে কিস্তির টাকা নেওয়ার জন্য লোকজন এসে তার বাসায় বসে আছেন। অটোরিকশা বন্ধ থাকায় তার কোনো উপার্জন নেই। কীভাবে কিস্তির টাকা পরিশোধ করবেন, পরিবারের খরচ চালাব? বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে।
মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সির সাব্বির জানান, অটোরিকশার বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযান চলছে। বেশ কিছু অটোরিকশা ও চালককে আটক করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছেন অটোরিকশাচালকেরা।
মূলত গত কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এতে করে নগরজীবনে বেড়েছে ভোগান্তি। আগে পাড়া মহল্লায় চললেও এখন ভিআইপি এলাকাগুলো ছাড়া প্রায় সব স্থানেই এসব রিকশার আধিক্য। এলাকাগুলোর প্রবেশমুখে ভিড় করে থাকে এসব রিকশা। ফলে রাস্তায় বেড়েছে যান চলাচলে বিশৃংখলা ও দুর্ঘটনা। ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া গতি ও চালকদের অসতর্কতাকেই দায়ী করছেন অন্য যানচালকরা। রিক্সা চালকদের মতে, ব্যাটারিচালিত রিকশায় কম পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। পায়েচালিত রিকশা যতটুকু দূরত্বে ৪০ টাকা হাঁকে, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ২০ থেকে ২৫ টাকায় রাজি হয়ে যায় এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছায়। এতে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা আরেকবার যাত্রী নিতে পারেন। তবে দ্রুত গন্তব্য পৌঁছানো, অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা রয়েছে বলেও ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা স্বীকার করেন। মিরপুরের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মো. আবদুল হক বলেন, ‘ব্যাটারির রিকশা সারাদিন চালানো লাগে না। আধবেলা চালালেই ১৫-১৬টা ট্রিপে ৫০০ টাকার মতো থাকে।’ অবৈধ হওয়ার পরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান কেন এমন প্রশ্নে রহমান বলেন, ‘এখন গ্যারেজগুলাতে ব্যাটারি রিকশা বেশি। আর এই রিকশা চালাতেও আরাম। অবৈধের বিষয়টা গ্যারেজ মালিক জানে।’
জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা লোহা দিয়ে তৈরি। তাই এ রিকশা টেকসই। দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এই রিকশা পুনরায় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। এসব কারণে রিকশার মালিকরা ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতি আগ্রহী। তিনি জানান, এসব রিকশা ৬৫ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে এসব রিকশা কোনও বৈজ্ঞানিক নকশায় বানানো নয়। রিকশার মালিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়।
ব্যাটারী চালিত রিক্সায় চড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এমন একজন হলেন আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, অটোরিকশা সড়কের চলমান যমদূত। রিকশার চালকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলে। অন্য যানগুলোকে তোয়াক্কাই করে না। তাদের চাইতে আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কোনও লুকিং গ্লাস নাই, যখন-তখন রিকশার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুরো রাস্তা দখল করে ওভারটেকিং করা তো তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক বিষয়।
জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীতে এখন অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করে। কিন্তু তাদের জন্য বেশিরভাগ এলাকার সড়কগুলোয় নেই কোনও ফুটপাত। বাধ্য হয়েই যান চলাচলের সড়কেই পথচারীদের হাঁটতে হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। হাঁটার কষ্ট এড়াতে অনেকেই রিকশার ওপর নির্ভর হন। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান তো হয়ই না উল্টো আরো বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে পথচারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকি আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দেয় অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচল করা এসব রিকশা একদিকে যেমন দেশের বিদ্যুৎ নষ্ট করছে, তেমনি এলাকার রাস্তাগুলোকে হেঁটে চলার অনুপযোগী করে তুলেছে।
বিআরটিএ’র বিজ্ঞপ্তি : এদিকে ঢাকা মহানগরে ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান এবং রংচটা, জরাজীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড় মোটরযান চলাচল বন্ধ করা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গতকাল রোববার বিআরটিএর প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার ঢাকা মহানগরে চলাচলের কারণে সড়কে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরে ব্যাটারি অথবা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা অনুরূপ শ্রেণির থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় মোটরযান চলাচল বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। অন্যথায়, এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বিআরটিএ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়
রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড
ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ
বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার
কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?
এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে
রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি
নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা
ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ
ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে
দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী
ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়
বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি
পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে
পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ
শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক
অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল
‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’
হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী