ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

নজরুলের দেখা ‘বাংলার ভেনিস’ বরিশালের প্রকৃতিকে রক্ষার উদ্যোগ নেই

Daily Inqilab নাছিম উল আলম

২৫ মে ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০৩ এএম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজরিত বরিশালে তার জন্ম বার্ষিকী এবারো যেনতেনভাবেই পালিত হচ্ছে। প্রতিবারের মত এবারো শুধুমাত্র নজরুল স্মৃতিসংসদ জাতীয় কবির জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে দায়সারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দায়িত্ব সম্পাদন করছে। এমনকি এ মহাগরীতে কবির দেখা ও লেখার স্মৃতিগুলোর অস্তিতও¡ ইতোমধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হলেও সুশীল সমাজের তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। বর্তমান ও অতীত কোন নগর পরিষদও এ নগরীতে জাতীয় কবির স্মৃতি ধরে রাখার বিষয়টি বিবেচনাতেই আনতে পারেনি। কবি নজরুলের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এ নগরীতে একটি রাস্তার নামকরনও হয়নি অদ্যাবদি। বৃটিশÑভারত যুগে কবি নজরুল দুবার বরিশালে এসে এ নগরীর অপরূপ প্রকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার অমর উপন্যাস ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় তা তুলে ধরে ছিলেন। কবি বরিশাল নগরীর পাশে প্রবাহমান কির্তনখোলা নদী ও তার পাশের বাঁধ রোডের ধারের ঝাউ বাগানের অপরূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশ যুগে অবিভক্ত বাংলার গভর্ণর শের এ বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে প্রথম বরিশালে এসেছিলেন ১৯২০ সালে। বরিশালের সন্তান ফজলুল হকের সাথে সেবার তিনি বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভায় দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন করেন। পরবর্তিতে ১৯৩০ সালের দিকে তিনি নোয়াখালী হয়ে আরো একবার বরিশালে এসে এনগরীর প্রকৃতির শোভায় মোহিত হয়ে তার অমর উপন্যাস ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় বরিশাল নগরীর প্রাকৃতিক শোভার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দিয়েছেন। অমর কবি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের সম্পাদনায় ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটি বাংলা ১৩৩৪-এর অগ্রহায়ণ থেকে ’৩৬ সালের ফাল্গুন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। কবি বৃটিশ যুগে এ শহরের পাশে প্রবাহমান কির্তনখোলা নদী তীরে ইটের সুরকীর রাস্তা আর গাছ গাছালীর কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি তার অমর উপন্যাসে।

জাতীয় কবি লিখেছিলেন, ‘বরিশাল। বাংলার ভেনিস। আঁকাবাঁকা লাল রাস্তা। শহরটি জড়িয়ে ধরে আছে ভুজ-বন্ধের মত করে। রাস্তার দু-ধারে ঝাউ গাছের সারি। তারই পাশে নদী। টলমল টলমল করছেÑবোম্বাই শাড়ী পরা ভরা-যৌবন বধুর পথ-চলার মত করে। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে অনেক বেশী। নদীর ওপারে ধানের ক্ষেত। তারও ওপারে নারকেল-সুপারী কুঞ্জঘেরা সবুজ গ্রাম, শান্ত নিশ্চুপ। সবুজ শাড়ী-পরা বাসর-ঘরের ভয়-পাওয়া ছোট্ট কনে-বৌটির মত। এক আকাশ হতে আর-আকাশে কার অনুনয় সঞ্চারন করে ফিরছে। বৌ কথা কও, বৌ কথা কও। আঁধারে চাঁদর মুড়ি দিয়ে তখনো রাত্রী অভিসারে বোরোয়নি। তখনো বুঝি তার সন্ধ্যা প্রসাধন শেষ হয়নি। শঙ্কায় হাতের আলতার শিশি সাঁঝের আকাশে গড়িয়ে পড়েছে। পায়ের চেয়ে আকাশটাই রেঙে উঠেছে বেশী। মেঘের কালো খোপায় ভূতীয়া চাঁদরে গো’ড়ে মালাটা জড়াতে গিয়ে বেঁেক গেছে। উঠোনময় তারার ফুল ছড়ানো....।’

তবে নজরুলের দেখা ‘বাংলার ভেনিস বরিশাল’কে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায়না। অপরিকল্পিত নগরায়নে জাতীয় কবির দেখা বরিশাল থেকে বেশীরভাগ খাল বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। ফলে এনগরীতে এখন আর জোয়ারÑভাটার পানি আসা যাওয়া করে না। খাল ছোট করে যেসব কংক্রীটের ড্রেন নির্মিত হয়েছে, তাতে পানি চলাচলের পরিবর্তে ময়লার ভাগার জয়েছে। ফলে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে ড্রেনের পানি অনেক রাস্তাকে সয়লাব করে দিচ্ছে। অপরদিকে বরিশাল নদীবন্দর সচল রাখার নামে অপরিকল্পিত ড্রেজিং-এ কির্তনখোলার পলি আবার নদীতেই ফেলায় খালের উৎস্য থেকে তলদেশ ভড়াট হয়ে এ নগরী ক্রমাগত জলাবদ্ধতার কবলে।

নজরুলের বরিশালে এখনো রূপসী বাংলার চিরয়াত কিছু রূপ চোখে পড়লেও অপরিকল্পিত নগরায়নে এ নগরীতে কবির দেখা ঝাউ ও পাম গাছসহ প্রকৃতির অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। দলবাজ সুশীল সমাজ ও দলদাস বুদ্ধিজীবীসহ কথিত পরিবেশবাদীরাও এপর্যন্ত কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার কোন দাবি তোলেননি। এমনকি গত কয়েক বছরে এনগরীতে সবুজায়ন সম্প্রসারণের পরিবর্তে আরো ধ্বংস করা হলেও কোন প্রতিবাদ হয়নি। বছর দুয়েক আগেও এ নগরীর অভ্যন্তর দিয়ে চলে যাওয়া বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাড়কের একাংশ দখল করে একটি পার্ক নির্মাণের নামে বেশ কিছু পাম গাছ ও মেহগনি গাছ কেটে ফেলা হলেও কেউ টু শব্দটিও করেননি।

এনগরীর সদর হাসতালের সামনে কয়েকটি পাম গাছ শেষ অস্তিত্ব ধরে রাখলেও তাও প্রায় জবনিকা কম্পমান। নগরীর ফজলুল হক এভেনিউ ও বাঁধ রোড সহ আরো কয়েকটি সড়কের ধারে সারি সারি পাম গাছ বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। ২০১০ থেকে ’১৫-১৬ সালের মধ্যে নগর পরিাষদ কয়েকটি স্থানে ঝাউ বাগান সৃজন করায় তার কিছু এখনো নগরীতে সবুজ ছড়ালেও অযত্ন অবহেলায় বেশীরভাগেরই অস্তিত্ব বিপন্ন। নগরীর পাশে বহমান কির্তনখোলা নদীর পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, ত্রীশ গোডাউন সংলগ্ন শতায়ু অংগন, আমতলার মোড়ের স্বাধিনতা পার্ক, গোড়াচাঁদ দাশ রোডের খৃষ্টান গোরস্থান এবং বিসিক রোডের ধারে মহাশষানের পাশে ঝাউগাছের যে বনায়ন হয়েছিল বিগত দিনে, এখন আর তার কোন যত্ন নেই।

কবি নজরুল ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় যে স্থানের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেটি নিঃসন্দেহে নগরীর বাঁধ রোডের ভাটার খাল থেকে স্টেডিয়ামের মধ্যবর্তি এলাকা। কির্তনখোলা নদী তীরে সে সময়ের বরিশাল শহর, আজকের মহানগরীর ঐ এলাকায় বাঁধ রেডের দুধারে তখন ঝাউ আর পাম গাছের সারি যেকোন পাষানেরও মন যুড়াত। নজরুলের দেখা বাঁধ রোডটি জাতীয় কবির নামে নামকরণের দাবীও রয়েছে সাধারন মানুষের।

অপরিকল্পিত ও বিবেকহীন নগরায়নের ধাক্কায় গত কয়েক যুগে নগরীর বাঁধ রোডের দুধার থেকে প্রকৃতির দান বিলুপ্ত হয়েছে। এ নগরীতে কোন পাম গাছেরই অস্তিত্ব আর চোখে পরছেনা। বাঁধ রোডে কির্র্তনখোলা তীরের ঝাউ বাগান পুরোপুরি বিলুপ্তির পরে বছর দশেক আগে মুক্তিযোদ্ধা পার্কে তা ফিরিয়ে আনায় এখন মাথা উচু করে অতীত স্মৃতির জানান দিচ্ছে। তবে বাঁধ রেডে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পাশে যে কয়টি পাম গাছ সর্বশেষ তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল, তাও ২০১৮ সালে কেটে ফেলা হয়েছে কথিত নিরাপত্তার অজুহাতে। যদিও বঙ্গবন্ধু উদ্যানের কোল ঘেষে বাঁধ রোডের ধারে কিছু সোনালু গাছ এখনো রঙ ছড়াচ্ছে। চোখ যুড়াচ্ছে ছোট-বড় সবার।
পাশাপাশি নিকট-দুরের হীমনীড়-এর ‘পদ্ম পুকুর’এর পদ্ম ফুলের বংশ সমুলে ধ্বংশ করারও একটি কর্মজজ্ঞ ইতোমধ্যে পরিচালিত হলেও প্রকৃতিকে নিঃশেষ করা যায়নি। পদ্ম পুকুরের স্বেত পদ্ম’রা আবার ফিরে এসেছে। এ পদ্ম পুকুরের ফুল দেখতে এখনো দুর দুরান্ত থেকে বহু মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসেন।

কিন্তু পাম গাছ আর ফিরে আসেনি। ফেরানোর কোন উদ্যোগও নেয়নি নগর ভবন। বাঁধ রোডের ধারে বঙ্গবন্ধু উদ্যান বা বেল পার্কের পাশের সোনালু ফুল এ নগরীর শোভা বর্ধন করলেও পাম গাছের অস্তিত্ব পুরো নগরী থেকেই প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। নগরীর ফজলুল হক এভেনিউ ও হাসপাতাল রোডের পাশের প্রায় সব পাম গাছ বিলুপ্ত হয়েছে গত দেড় দশকে।

নগর ভবন বা বন অধিদপ্তরও এ নগরীকে সবুজায়নসহ প্রকৃতির অতীত রূপে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী নয়। এ অভিযোগ সাধারন নগরবাসীর। তবে চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে নগর ভবনের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, বিবেকহীন নানা কর্মকান্ডে এ নগরী থেকে প্রকৃতির অনেক দান বিলুপ্ত হলেও তাকে রক্ষা করাসহ ফিরিয়ে আনার সময় এখনো আছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা