ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ৯ মাঘ ১৪৩১
প্রশ্ন দ্য ডিপ্লোম্যাট-এর

যুক্তরাষ্ট্রকে কি শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমালোচনা করার মূল্য দিতে হচ্ছে

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

২৭ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

দ্য ডিপ্লোম্যাটের ‘যুক্তরাষ্ট্রকে কি শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমালোচনা করার মূল্য দিতে হচ্ছে?’ শীর্ষক এক নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। সিডনি-ভিত্তিক প-িত এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক মোবাশ্বের হাসানের লেখা ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

আমেরিকার তৈরি বোয়িং উড়োজাহাজ ব্যবহার করার দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের জাতীয় বিমান বাহক, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’ সম্প্রতি চারটি ইউরোপিয়ান এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছু ড্যাশ-৮ টার্বোপ্রপস সহ বিমান বাংলাদেশের ২০টিরও বেশি বিমানের বহর রয়েছে, যার বেশিরভাগই প্রশস্ত দেহের বোয়িং প্লেন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ওয়াইড বডি বা প্রশস্ত দেহের এয়ারবাস এ-৩০ প্লেন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়, বিমান তার নিজস্ব মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধে গিয়েছিল।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একটি মূল্যায়নে দেখা যায় যে , ‘বিমান বাংলাদেশ’ এয়ারবাস বিমান কিনলে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেই কমিটির রিপোর্টের পর সরকার আরেকটি মূল্যায়ন কমিটি নিযুক্ত করে, যেটি ২০২৪ সালের এপ্রিলে দেখেছিল যে, এয়ারবাস বিমান কেনা বিমানের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে।

সরকার এয়ারবাস বেছে নিতে দ্বিতীয় মূল্যায়নটাকে বেছে নিয়েছে। প্রতিটি এয়ারবাস বিমানের মূল্য ১৮০ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে অ-ফেরতযোগ্য ৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি ফি সম্পৃক্ত। যখন দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ডলারের সংকটে পড়েছে তখন বাংলাদেশকে চারটি এয়ারবাস বিমানের জন্য এই অর্থ ব্যয় করতে হবে।

ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা পাঠাতে পারছে না বলে পরিস্থিতি ভালো নয়। একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে, বিমানের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিজুল আজিম বলেছেন যে বোয়িংকে ঘিরে সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এড়াতে এয়ারবাস প্লেন ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এয়ারলাইন্সের বহরে বৈচিত্র আনার মাধ্যমে বিমান তার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে । আজিমের যুক্তি ভিত্তিহীন নয়। বোয়িং দুর্ঘটনা, তাদের বিমানের ত্রুটি এবং গ্রাহকদের কাছে বিমান সরবরাহের ধীরগতির কারণে গুরুতর বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

ফলস্বরূপ, সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী ৩২ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। এই আইকনিক আমেরিকান কোম্পানি থেকে গ্রাহকরা দূরে সরে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ সউদী আরব সম্প্রতি ১০৫টি এয়ারবাস বিমানের জন্য একটি অর্ডার দিয়েছে। তবে বিমান বাংলাদেশের এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত আর্থিক বা ব্যবসায়িক যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়। বরং এটি ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয়।

এভিয়েশন সেক্টরে ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া বাংলাদেশের কাছে নতুন কিছু নয়। এভিয়েশন গবেষকদের মতে, এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি পরিষেবা পণ্য সম্পর্কিত বেশিরভাগ ব্যবসার থেকে আলাদা কারণ এটি সরাসরি জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং দেশের প্রতিপত্তির সাথে জড়িত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বেসামরিক বিমান চালনার রাজনীতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। সরকার সেই দেশকে কীভাবে দেখে এবং দেশের নাগরিকরা তাদের নিজস্ব এবং বিদেশী দেশগুলিকে কীভাবে দেখে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লংঘনের জন্য বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তারপরে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের বিতর্কিত একতরফা সাধারণ নির্বাচনের দৌড়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের জন্য ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছিল যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের কড়া জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম না করে তিনি দাবি করেছেন যে, একটি দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভূখ- ব্যবহার করে তিমুর-লেস্তের মতো একটি বিমান ঘাঁটি এবং একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে।

যদিও মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বোয়িং থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্ভবত সাম্প্রতিক মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রতি ঢাকার প্রতিক্রিয়ার অংশ।
এয়ারবাস বিমান কেনার উদ্দেশ্য ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করা, যারা এয়ারবাস বিমানের বিভিন্ন অংশ তৈরি এবং একত্রিত করে। এয়ারবাস কেসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি ফাটলও তুলে ধরে।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে এটিকে ‘অবাধ বা সুষ্ঠু নয়’ বলে বর্ণনা করেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গভীর করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কম কঠোর ছিল, শুধুমাত্র সীমিত অংশগ্রহণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সরকারকে বৃহত্তর স্বচ্ছতার দিকে কাজ করার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েই তারা দায় সেরেছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ১০টি এয়ারবাস বিমান বিক্রির ঘোষণা দেন। সফর শেষে যৌথ বিবৃতিতে ‘সমৃদ্ধি, শান্তি এবং জনগণ’ এর কথা উল্লেখ করলেও ম্যাক্রন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলেন। বাংলাদেশের কাছে এয়ারবাস বিমান বিক্রি ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিকে আমেরিকানদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেব, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বহু ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের সঙ্গে চুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দ্বিপক্ষীয় বিমান পরিষেবা চুক্তি ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এই বৈরিতা শেখ হাসিনাকে সুবিধা দিয়েছে। অন্তত এয়ারবাস বিমান কেনার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে গণতন্ত্রের জন্য চাপ কমবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি
রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর
এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ
বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম
পঞ্চগড়ে চার বিচারক অপসারণে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
আরও

আরও পড়ুন

ভারতকে ছেড়ে কেন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা?

ভারতকে ছেড়ে কেন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা?

রাজনৈতিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে জাপান

রাজনৈতিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে জাপান

প্রবাসী উপদেষ্টার আশ্বাসে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের আন্দোলন স্থগিত

প্রবাসী উপদেষ্টার আশ্বাসে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের আন্দোলন স্থগিত

মহার্ঘভাতার সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থ উপদেষ্টা

মহার্ঘভাতার সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থ উপদেষ্টা

পুরো বইমেলা মনিটরিং হবে ড্রোনে-ডিএমপি কমিশনার

পুরো বইমেলা মনিটরিং হবে ড্রোনে-ডিএমপি কমিশনার

যানবাহন চালক-পথচারীদের জন্য ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা

যানবাহন চালক-পথচারীদের জন্য ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা

মাস্ক বা অন্য কেউ টিকটক কিনলে বিনিয়োগ করবে প্রিন্স তালালের কোম্পানি

মাস্ক বা অন্য কেউ টিকটক কিনলে বিনিয়োগ করবে প্রিন্স তালালের কোম্পানি

মৃত বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পাওনাদার নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে?

মৃত বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পাওনাদার নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে?

খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকশিত হয় -ডিসি তৌফিকুর রহমান

খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকশিত হয় -ডিসি তৌফিকুর রহমান

চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবি বিএসএফ বৈঠক

চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবি বিএসএফ বৈঠক

জিয়াউল হক মাইজভা-ারী ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান

জিয়াউল হক মাইজভা-ারী ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি

৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী

৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী

মাদারীপুরে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের আন্তঃসম্পর্কবিষয়ক কর্মশালা

মাদারীপুরে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের আন্তঃসম্পর্কবিষয়ক কর্মশালা

রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর

রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর

মাদারীপুরে হত্যার দায়ে ৫ জনের যাবজ্জীবন

মাদারীপুরে হত্যার দায়ে ৫ জনের যাবজ্জীবন

এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ

এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ

‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’ দেয়ালে লিখে হত্যার হুমকি

‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’ দেয়ালে লিখে হত্যার হুমকি

বিমানের এই কর্মকা- সহ্য করার মতো নয় -সিলেট সুধীজন

বিমানের এই কর্মকা- সহ্য করার মতো নয় -সিলেট সুধীজন

বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম

বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম