গণভবন থেকে আসতো গুম-খুনের নির্দেশনা
২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০২ এএম
নারায়নগজ্ঞের সাত খুন, রাতের আধাঁরে মতিঝিলে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যা, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতাকে হত্যাসহ সকল খুন ও গুমের বিষয়ে জানতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক। বিএনপি ও জামায়াতসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বিষয়েও নির্দেশনা দিতেন তিনি। রিমান্ডে থাকা সেনাবাহিনীর বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গোয়েন্দাদের জেরার মুখে বলেছেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম। তিনি বলেছেন, তার কাছে সব ধরনের নির্দেশ আসত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছ থেকে। জিয়াউল আহসান, সালমান এফ রহমান ও আনিসুলসহ গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সাথে সম্পৃক্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান। আট দিনের রিমান্ডে থাকা অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গোয়েন্দা দপ্তরে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জিয়াউল আহসান জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক তাকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। নৌবাহিনীর আরেক কর্মকর্তা সোহায়েল শেখ হাসিনা ও তারেক আহমেদ সিদ্দিকের আস্থাভাজন ছিলেন। তারা অনেক বিষয়ে সমন্বয় করে কাজ করেছেন র্যাবে থাকা অবস্থায়। ওই কর্মকর্তা একসময় র্যাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি এখনো প্রেষণে কর্মরত।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভিন্নমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল দমন করার জন্য গুমের মতো জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটে। জিয়াউল আহসান গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, এসব গুম ও গুপ্ত খুনের সঙ্গে জড়িত হাসিনার উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তারিক সিদ্দিকের হাতে। তার ইশারায় চলত এনটিএমসির কার্যক্রম। অনেক সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও খুন-ঘুমের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলতেন।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউল আহসানকে র্যাবের উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও তারিক সিদ্দিক এবং জিয়াউল আহসান কর্তৃক গুম-খুনের অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে দেশে গুম ও গুপ্ত হত্যাগুলো মূল নিয়ন্ত্রক হলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। মূলত ব্যাপক পরিসরে গুমের ঘটনা শুরু হয় তার হাত ধরে। সেটি শুরু হয়েছিল ১/১১-এর পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ওই সময় আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী, বিরোধী ঘরানার রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সরকারবিরোধী সমালোচকসহ অসংখ্য ব্যক্তি গুমের শিকার হন। তখন দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি গুম হয়েছেন বলে খবর ছাপা হতো। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো থানা থেকে শুরু করে ডিবি, র্যাব কার্যালয়ে ধরনা দিয়েও নিখোঁজ স্বজনের খোঁজ পেত না। এসব বিষয়ে জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সাফ জানান- এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন তারিক সিদ্দিক।
ডিবির তদন্ত সূত্র জানায়, গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ তৈরি করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে যারাই নেতিবাচক সমালোচনা ও সরকারের জন্য যেসব ব্যক্তির মন্তব্য এবং কর্মকান্ড হুমকিস্বরূপ ছিল তাদের তুলে নিয়ে আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হতো। অমানবিক নির্যাতন করা হতো। বছর দুয়েক ধরে একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে আয়নাঘরের বিষয়টি জানাজানি হয়। সেখান থেকে মুক্ত হওয়া এক ব্যক্তি বিদেশি গণমাধ্যমে তার বর্ণনা তুলে ধরেন। এর পর থেকে দেশে নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নজর ওই আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার দিকে যায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর অনেক স্বজনের দাবির মুখে তিনজন বন্দিকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। গত ৭ আগস্ট তিনি ছাড়া পান। এর আগে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েক দিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়েছিল। আয়নাঘর থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া হলেও গুম হওয়া অন্য ব্যক্তিদের পরিবার এখনো পথ চেয়ে বসে আছে কবে নিখোঁজ ও গুম হওয়া স্বজনরা ফিরে আসবেন। আবার অনেকেই ফেরার আশা ছেড়ে দিয়ে এখন বিচারের অপেক্ষায় আছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন গুম হওয়া স্বজনরা আর বেঁচে নেই। তাদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
গোয়েন্দাদের জেরার মুখে তিনি জানান, ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন তিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেয়া হতো। তিনি এমটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন সরকারের এই সংস্থাটির আড়িপাতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। এই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তার নির্দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মোবাইল ফোনে আড়িপাতা হতো। এর পর ওইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কল রেকর্ড সংগ্রহ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এসব কল রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অনেক সুশীল সমাজের লোকজনকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতো।
সূত্র আরও জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তার দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুরো বিষয়টি তিনি প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। কিন্তু সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশকে দিয়ে বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন দমাতে চাইলে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভেস্তে যায়। এছাড়া আনিসুল হক অতি-উৎসাহী কিছু পুলিশ কর্মকর্তার ওপরও দায় চাপিয়েছেন। তার দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালানোটা উচিত হয়নি। এতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আসার বিপরীতে আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশের রমনা জোনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জিয়াউল আহসান খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক। তিনি ধীরস্থিরভাবে প্রশ্নের উত্তর দেন। পুলিশের পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে শেখ হাসিনা সরকারে তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠলেন কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, এনটিএমসি বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করত। পাশাপাশি শেখ হাসিনা বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য তাকে দিয়ে ক্রস চেক করাতেন। এতে তিনি দ্রুতই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে তার নাম কেন উঠে এল? এ বিষয়ে তিনি দাবি করেন যে, তিনি ওই খুন সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। তিনি দাবি করেন, তখন র্যাবে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার নামে বিএনপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের ৫ মার্চ র্যাব-২-এর উপ-অধিনায়ক হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সুপারিশ ছিল বলে তিনি দাবি করেন। ইসরায়েল থেকে আড়িপাতা সফটওয়্যার কেনার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলেও তিনি দাবি করেন।
কোটা আন্দোলনের ব্যাপারে রিমান্ডে আনিসুল হক পুলিশকে জানিয়েছেন, সরকার মনে করেছিল যে, ২০১৮ সালের মতোই কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটি সুষ্ঠু সুরাহা হয়ে যাবে। সরকার একদিকে আলোচনা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে দিয়ে বলপ্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ঘোলা হয়ে যাবে, তা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল, এমনকি শেখ হাসিনা নিজেও বুঝতে পারেননি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
সচিবালয়ে প্রবেশের সব অস্থায়ী পাস বাতিল, ঢুকতে পারবেন না সাংবাদিকরাও
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৩৭, আহত ৯৮
ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে সিলেট সীমান্তে আরেক যুবক খুন
খাঁটি মুসলমান হতে হলে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চলতে হবে-ছারছীনা পীর সাহেব
জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে
হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা
সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী
খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান
হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন
সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি
‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’
আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক
বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩
নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ
হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী