আয়না ঘরে দুলালের ৩১ দিন
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
চব্বিশ ঘণ্টাই চোখ বাঁধা ও হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা হতো। নামাজ-ওয়াশরুম কিংবা বাথরুমে নেয়ার পর এগুলো খুলে দিতো। তাই কিছুটা স্বস্তির জন্য ওয়াশরুমে কিছুটা বিলম্ব করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দু’তিন মিনিট যেতে না যেতেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি করা হতো। ওয়াশ রুমের ভেতর থেকে আটকানোর সিটকিনি নেই। বাইরে তাদের পাহারা। একটু দেরি হলেও নির্যাতন করে রুমে নিয়ে আসতো। যে কক্ষটিতে রাখা হতো সেটির কোনো দরজা নেই। থানা হাজতখানার মতো লোহার শিকের দরজা। ওই শিকের সাথেই দুই হাত হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ছোট শিকলে বেঁধে রাখতো। মনে হতো মৃত্যু এ নির্যাতনের অনেক স্বস্তির। জাতীয় পার্টি-জেপির রাজনীতি করি। অথচ আমাকেই জঙ্গি নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে আনে র্যাব। গত বুধবার রাতে ইনকিলাবে এসে আয়না ঘরে দীর্ঘ ৩১ দিনের বন্দিজীবনের দুঃসহ স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন জাতীয় পার্টি- জেপির কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এবং পরিবহন শ্রমিক নেতা সাখাওয়াত হোসেন দুলাল।
দুলাল বলেন, আমি তখন সিএনজি অটোরিকশা ও মিশুক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প বান্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের (বিআরপি) প্রচার সম্পাদক, পশ্চিম ভাষানটেক কমিউনিটি পুলিশিংসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। ঘটনাটি ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। বেলা দেড়টা থেকে দুইটা। তখন ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের দ্বিপাক্ষিক সভা চলছিলো। সভার বিরতিতে আমি প্রকল্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সাথে বলছিলাম। হঠাৎই সেখানে হলুদ রংয়ের একটি ট্যাক্সি ক্যাব এসে থামে। ওই ট্যাক্সি থেকে ৪-৫ জন লোক নামে। সঙ্গে আরো মাইক্রোবাস ও দু’টি বাইক ছিলো। তারা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে অস্ত্র ঠেকায়। জোর করে তুলে নেয় গাড়িতে। আমার দু’পাশে দু’জন বসে। গাড়িতে তুলেই কালো কাপড়ের টুপিতে চোখ-মুখ বেঁধে দেয়। হ্যাণ্ডকাফও পরায়। আনুমানিক ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলে। এরপর নামায়। ওই অবস্থায় আমাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে একটি ভবনের উঁচু তলায় নিয়ে যায়। সেটি চার কিংবা ৫ তলা হতে পারে। এর পর নিয়ে যায় একটি কক্ষে। এ সময় চোখ খুলে দেয়। একটি টেবিল। বেশ পরিপাটি। একজন মাত্রই বসে আছেন নিজের চেয়ারে। বুঝলাম সেটি কোনো কর্মকর্তার অফিস। সেখানে তিনি আমাকে জিজ্ঞসাবাদ করেন। প্রসঙ্গ একটাই- পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে কেন আন্দোলন করি।
প্রায় মিনিট দশেক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আবারো চোখ বাঁধা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় একই ফ্লোরের ভিন্ন একটি রুমে। এ সময়ও অন্য কোনো কর্মকর্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে মূল বিষয় ছিলো ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পকে ঘিরে। এ সময় তাদের নিজস্ব আলোচনায় ফারুক খান নামে একজনের কথা উল্লেখ করে বলেন, তার নির্দেশ রয়েছে দুলাল-জব্বারসহ আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে হবে। এখানে প্রায় ২০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিয়ে যাওয়া হয় নিচের দিকের ভিন্ন এক ফ্লোরে। সেখানে লক আপে রাখা হয়। চোখ ওইভাবেই বাঁধা ছিলো কালো কাপড়ে। আর হ্যাণ্ডকাফ কখনোই খোলা হতোনা। রুমটি লম্বায় বেশি হলে ৭ ফিট। চওড়া বড়জোর ৪ ফিট। কোনো খাট নেই। ফ্যানের ব্যবস্থাও নেই। উচ্চতার কথা কি বলবো মাথা ছাদের সাথে ছুঁই ছুঁই অবস্থা। লোহার গেট। যেভাবে হাজতখানা। ঠিক তাই। ওই লোহার রডের সাথে হাত বাধা হ্যান্ডকাফ বেঁধে রাখা হতো। ঘুমাতেও হতো একই অবস্থায়। মাথা ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ কাত হতে হতো। ধারণা করা হচ্ছে, একটি গলির দু’পাশে এ ধরনের ৪টি অথবা ৫টি করে সর্বমোট ৮ অথবা ১০টি নির্যাতন সেল রয়েছে। এমন একটি এডজাস্ট ফ্যানের বিরক্তিকর শব্দে আশপাশের কিছুই শোনা যেতনা। ওই লকআপের ফাঁক গলিয়ে খাবার দিতো। খাবার সময় একহাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিতো। বাথরুমে যাবার সময়ও একই ব্যবস্থা। তবে যেহেতু বাথরুমে চোখ খোলা হয় তাই একটু দেরি করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাতে তেমন লাভ হতো না। সম্ভবত ওখানে বন্দিদের জন্য একটিমাত্র বাথরুম। দু’তিন মিনিটের বেশি দেরি করলেই নির্যাতন করতো। এরপর নামাজ পড়ার কথা জানালে তারা নামাজের ওয়াক্ত ও সময় উল্লেখ করে নির্ধারিত সময়ের জন্য চোখ ও এক হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিলে আশপাশের পরিবেশ কিছুটা দেখতে পেতাম। দু’একটি কক্ষের সামনে পর্দার ন্যায় কালো কাপড় দেয়া থাকতো। যাতে করে ভেতরে অবস্থান করা ব্যক্তিকে আশপাশের রুম থেকে না দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন সময় একাধিকবার ওই রুমেও কোনো কোনো কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করতো। আমি বলতাম আমার কি অন্যায় আমাকে কেন এনেছেন উত্তরে তারা ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলতো।
মাঝে মধ্যে রাতের দিকে গাড়িতে করে কোথাও নিয়ে যেত। আবার রুমে নিয়ে আসতো।
কোনো এক রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো। কয়েক মিনিট হাঁটিয়ে তোলা হয় একটি গাড়িতে। চোখ বাঁধা থাকলেও অনুমান করতে পারি পাশের রুম থেকেও আরো দু’একজন আমার মতো তুলে নিয়েছে গাড়িতে। অনেক সময় ধরে গাড়িতে ঘোরানো হলো। কিছুটা কোলাহলমুক্ত এলাকায় গিয়ে গাড়ি থামলো। টের পেলাম অ্যাম্বুলেন্সেরও হুইসেল। একই সময়ে সেখানে আরো কয়েকটি গাড়ির উপস্থিতি অনুমান করি। আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এরপরই চিৎকার চেঁচামেচি। দুলাল বলেন, হয়তো অন্য কাউকে ক্রসফায়ার দেয়ার সময় আমাদের মাঝে ভয় ধরানোর জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার রুমে নিয়ে আসা হয়। আনা-নেয়ার পথে তারা ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে কথা বলতো।
অন্ধকার ওই বন্দিশালায় সকালে রুটির সাথে ভাজি, দুপুরে ও রাতে ভাত দেয়া হলেও শুধু জীবন বাঁচানো প্রশ্নে তা খেতে হয়েছে। কখনো কখনো না খেয়ে থাকতাম। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিলোনা।
গোসল করার জন্য একটি গামছা দিয়েছিলো। বাকিটা এক পোশাকেই থাকতে হয়েছে। বাথরুমের ওপরের দিকে একটি জানালা আছে। একদিন সেটি দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। বুঝলাম এটি উত্তরা এলাকার রাস্তা। গাড়ির শব্দও পেতাম।
দুলাল বলেন, একদিন জোরে জোরে কান্না করছিলাম। এরপর ওযু করাতে নেয়ার সময় সেন্ট্রির দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, আপনি টেনশন নিবেন না। আপনার মুক্তির জন্য বাইরে বেশ আন্দোলন হচ্ছে। মিডিয়াও সোচ্চার। সরকারে থাকা অনেক নেতা তদবির করছেন। আশা করছি মুক্তি পাবেন। এটা শোনার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে মনে।
এভাবে ঠিক ৩১ দিন পেরিয়ে যায়। একদিন সন্ধ্যায় আমাকেসহ আশপাশের আরো দুই জনকে তোলা হয় গাড়িতে। সারা রাত গাড়িতে ঘোরানো হয়। আবার নিয়ে আসে রুমে। পরদিন বিকেলে র্যাব হেডকোয়ার্টার্সে। সেখানে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে অন্য দু’জনের সাথে আমাকেও মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়। বুকে কাগজে লেখা হয় জঙ্গী নেতা। বলা হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে জানতে পারি, আমার সাথে যাদের দেখানো হয়েছে, তাদের একজন যশোর থেকে তুলে আনা মাওলানা আবদুল লতিফ ও অন্যজন মাওলানা ইদ্রিস আলী। আমি আরবি পড়তে জানিনা অথচ আমাকেও মাদ্রাসার শিক্ষক বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। বিকেলে সংবাদ সম্মেলন শেষে নেয়া হয় মোহাম্মদপুর র্যাব ক্যাম্পে। দুই-তিন ঘণ্টা পরে বিভিন্ন ধারার মামলা দিয়ে সোপর্দ করা হয় মোহাম্মদপুর থানায়। র্যাবের এ সাজানো মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থেকে মুক্তি পাই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা