বহু কুকর্মের হোতা সেই শাজাহান খান গ্রেফতার
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
রাজধানীর ঝিগাতলায় মোতালিব নামের এক কিশোর হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে এ তথ্য জানান ধানমন্ডি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) ঝিগাতলা বাস স্ট্যান্ড এলাকায় মোতালিব নামের কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ২৭ আগস্ট তার বাবা আব্দুল মতিন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা রুজু করেন। প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং শাহজাহান খানসহ ১৭৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এজাহারে।
ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শাজাহান খানকে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে গতকাল দুপুরে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পরিবহন শ্রমিক নেতার আড়ালে তার কাজই ছিল সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করা। পরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ এহেন কাজ নেই যা তিনি করেন নি। জুলাইয়ে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতেও পরিবহন শ্রমিকদের অস্ত্র হাতে মাঠে নামিয়েছিলেন মাফিয়া ডন শাজাহান খান। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পরিবহন ধর্মঘটসহ রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টির বহু রেকর্ড আছে শাজাহান খানের। শ্রমিক নেতা হয়ে তিনি শ্রমিকদের শোষণ করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
শাজাহান খানের রাজনীতির শুরুটা হয়েছিল আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মাঝে জাসদ হয়ে আবার ফিরেছেন আওয়ামী লীগে। হয়েছেন বড় নেতা ও মন্ত্রী। সড়কে দাপট শুরু হয়েছিল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন দিয়ে। সেখান থেকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হয়ে এ খাতের সম্রাট হয়ে ওঠেন। ক্ষমতা ও দাপটে অঢেল সম্পদও কামিয়েছেন। শাজাহান খান সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত শেখ হাসিনা সরকারের নৌমন্ত্রী ছিলেন তিনি। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীতে আছেন শাজাহান খান। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতিও।
শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নাম ভাঙিয়ে ২০০৯ সাল থেকে হতে চলতি বছর পর্যন্ত শুধুমাত্র সড়ক পরিবহন যান থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বেশিরভাগই গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের নেতারা জানান, সংগঠন চালানোর জন্য সামান্য কিছু টাকা তাদের দেয়া হতো। বাকি সব টাকাই নিতেন শাজাহান খান ও তার অন্যতম সহযোগী ওসমান আলী। শ্রমিক নেতারা জানান, করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় পরিবহন শ্রমিকরা অতি কষ্টে দিনাতিপাত করেছে। অথচ সেই সময় শাজাহান খান কারও দিকে ফিরেও তাকান নি। তিনি তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য শ্রমিকদের ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাজাহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ফুড ভিলেজ (সার্বিক হোটেল) সবকিছুই তার পরিবারের সদস্যদের নামে। বিশেষ করে ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহন কোম্পানিতে একক আধিপত্য তার। এ পরিবহনের ব্যানারে ২০০টির বেশি গাড়ি চলাচল করত। এ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করেছিলেন তার ছেলেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় শাজাহান খানের বেশ কয়েকটি বহুতল বাড়ি, বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট, ঢাকার বাইরে মাদারীপুরে শত শত বিঘা জমি এমনকি টাকা পাচার করে বিদেশের মাটিতেও গড়েছেন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ২৩/২ তোপখানা রোড, সেগুনবাগিচায় একটি বহুতলবিশিষ্ট বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্টের নির্মাণ কাজ চলছে। অবশ্য নির্মাণার্ধীন ওই এ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান জানিয়েছেন, এটি শাজাহান খানের একার নয়, সাথে বাসদের খালেকুজ্জামান ও শ্রমিক নেতা ওসমান আলীও আছেন।
শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম একসময় একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। তার বড় ছেলে আসিব খান আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সর্বশেষ মাদারীপুরের সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। ছোট ছেলে মাহাদী খান শামস। একমাত্র মেয়ে ঐশী খানকে বিয়ে দিয়েছেন টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) তানভীর হাসানের (ছোট মনির) সঙ্গে। ঐশীকেও বাসের মালিকানা দেওয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর শাজাহান খানের সার্বিক পরিবহনের ৩২টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তিনিও এতদিন গা-ঢাকা দিয়েছিলেন।
শাজাহান খানের পরিবহন সাম্রাজ্য শুরুতে চালাতেন তার চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান শফিক। একসময় তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে (কালু) উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান এবং তার মাধ্যমে মাদারীপুর নিয়ন্ত্রণ করেন। সর্বশেষ তার নিজ বড় ছেলে আসিব খানকে মাদারীপুরের সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে ছিল ব্যাপক ক্ষোভ।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগমের মাধ্যমে তার অবৈধ অর্থের লেনদেন হতো। এ ছাড়া তার আরেক ভাই হাফিজুর রহমান খানও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।
শাজাহান খানের উত্থান : শাজাহান খানের উত্থান ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে। ওই বছরই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর ১৯৮০ সালে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৯৪ সালে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন।
পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ায় শাজাহান খানের জন্য সড়কে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, শাজাহান খানের নির্দেশে পুরো পরিবহন খাত চলত। তার ইশারায় পরিবহন বন্ধ বা চালু থাকত। পরিবহন শ্রমিকদের উন্নয়নে কোনো অবদানই ছিল না তার। প্রতিদিন সড়ক থেকে ৫ কোটির বেশি টাকা তুলত তার ফেডারেশন। কিন্তু সেসব টাকা শ্রমিকদের কোনো কাজেই আসত না। ওই শ্রমিক নেতার অভিযোগ, শাজাহান খান তার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীকে নিয়ে সারা দেশে পরিবহন খাতকে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, বাস মালিকদের জিম্মি করে রাখতেন শাজাহান খান। তার জন্য সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যেত না। তখনকার বাস মালিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহন খাতকে নাজেহাল করেছেন তিনি। ফেডারেশনকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের জন্য দায়ীদের মধ্যে শাজাহান খান অন্যতম বলে জানান সাইফুল আলম।
পরিবহন শ্রমিক নেতা থেকে শাজাহান খান হাত বাড়ান পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর দিকে। ২০১৩ সালে ৫২টি গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এরও প্রধান তিনি। গার্মেন্টসগুলো থেকেও তার নামে মোটা অংকের চাঁদা তোলা হতো।
সড়ক পরিবহন আইনের বিরোধিতা : ২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হন। ওই বছর সাজা কঠোর করে ও জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। তাকে রেখে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমিটি করা হয়, যা নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
শাজাহান খানের নেতৃত্বে মালিক ঐক্য পরিষদ আইন সংশোধনসহ সাত দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকে। তাদের বিরোধিতার কারণে আইনটি কার্যকর করতে ১৪ মাস লেগে যায়। চলতি বছর মার্চে আইনের ১২টি ধারায় অপরাধের শাস্তি ও ৮টি ধারায় জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে খসড়া সংশোধনীতে সায় দেয় হাসিনার মন্ত্রিসভা।
ইউনিয়নিস্ট পেশায় শাজাহান খানের বিশাল এক সাফল্যের উদাহরণও দেওয়া আছে জীবনবৃত্তান্তে। সেখানে বলা আছে, ১৯৮৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে ড্রাইভার হারুন অর রশিদকে ফাঁসির আদেশ এবং সুপারভাইজার মজিবর রহমান ও হেলপার আজিবর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের প্রতিবাদে আন্দোলন করে তাঁদের মুক্ত করেন। এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। তবে শাজাহন খানকে পরিবহন শ্রমিকরা একজন খুনি, ডাকাত, চাঁদাবাজ, স্বার্থপর ও সরকারের লাঠিয়াল বলেই জানে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা