বুড়িগঙ্গা দূষিত পানির ভাগাড়
৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
রাজধানী ঢাকার চার পাশে নদী। বুড়িগঙ্গা নদীকে বলা হয় রাজধানী ঢাকার প্রাণ। সেই বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদী। বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদীর অন্যতম বুড়িগঙ্গার মাত্র ৬ কিলোমিটারের মধ্যে ২৫১টি পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি অপরিশোধিত বর্জ্য এসে মিশছে। এ নদীর দূষণের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই হচ্ছে এসব পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচরের শেখ রাসেল স্কুল থেকে ফরাশগঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত ২৫১টি পাইপলাইনের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নদীতে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সে বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে গিয়ে দূষিত করছে পানি। ফলে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের কারণে নদীর পানিতে জীব বৈচিত্র্য বলে কিছু থাকছে না।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) পরিচালিত ‘ঢাকা নদীর দূষণ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গবেষণায় বাম তীরে (পুরান ঢাকা) ১৩৭টি এবং ডান তীরে (কেরানীগঞ্জের দিকে) ১১৪টি পয়ঃনিষ্কাশন লাইন পাওয়া গেছে। আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, মাঠপর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পাইপলাইন পাগলা পয়ঃশোধনাগারে (এসটিপি) স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র পরিসরের প্রকল্প মাত্র ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়েই সম্পন্ন হতে পারে। তিনি বলেন, যদি ২৫১টি পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ বন্ধ করা যায়, তাহলে বুড়িগঙ্গা নদীর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের প্রাথমিক উৎস অপরিশোধিত পয়োঃবর্জ্য নিষ্কাশন, শিল্প বর্জ্য, বর্জ্য ফেলার পয়েন্ট এবং পানির যানবাহন থেকে নির্গত বর্জ্য। পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণ না করলে নদীর পানি কখনোই পরিষ্কার বা ব্যবহারযোগ্য হবে না। এসব সংযোগ থেকে অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন স্থানে ছোট থেকে মাঝারি পয়ঃশোধনাগার (এসটিপি) স্থাপনের পরামর্শ দেন এই পরিবেশবিদ।
অধ্যাপক মজুমদার বলেন, জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে বুড়িগঙ্গার পানির গুণগত মান পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত জাতীয় মানদ-ের মধ্যে বা কাছাকাছি থাকে। তবে অন্য সময়ে পানির গুণগত মান ধারাবাহিকভাবে অনুমোদিত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
গবেষণায় বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীর বরাবর ২৫৭টি বর্জ্য ফেলার পয়েন্ট বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণের অন্যতম কারণ। এর মধ্যে ডান তীরে ১৪৮টি এবং বাম তীরে রয়েছে ১০৯টি। এ ছাড়া শিল্প কারখানা থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ৯৩টি স্থানে। এর মধ্যে বাম তীরে ৩৫টি এবং ডান তীরে ৫৮টি পয়েন্ট রয়েছে।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, নিকটবর্তী নদীগুলোতে অতিরিক্ত দূষণের উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে তুরাগ নদীর সঙ্গে ৯৯টি এবং বালু নদীর সঙ্গে ১০টি অপরিশোধিত বর্জ্য সংযোগ এবং তুরাগ নদীতে ১৩১টি, টঙ্গী খালে ৫১টি ও বালুতে ৩২টি বর্জ্য ফেলার সংযোগ পাওয়া গেছে।
মূলত সেই বুড়িগঙ্গা আর নেই। বুড়িগঙ্গা এখন আর খর¯্রােতা নয়। এখানে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ নেই, মৎস্য সম্পদ কিংবা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী নেই। এ নদী পরিণত হয়েছে রীতিমতো বিষাক্ত বর্জের বহমান আধারে। পানি ব্যবহার তো দূরের কথা এসব নদীর সংস্পর্শেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
এককালের প্রমত্তা এ নদীতে প্রতিদিন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গৃহস্থালি, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও নৌযানের বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিদস্যুদের অবৈধ আগ্রাসনই নদীগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিল্পবর্জ্য, কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য সবকিছুর আধার হলো বুড়িগঙ্গা। এখানে প্রতিদিন ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি শিল্পবর্জ্যসহ কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে। এসবের সঙ্গে রয়েছে নগরীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের পয়ঃবর্জ্য, যার ২০ শতাংশ পরিশোধিত ও ৪০ শতাংশ সেপটিক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে আংশিক পরিশোধিত এবং বাকি ৪০ শতাংশই অপরিশোধিত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরের গৃহস্থালি ও অন্যান্য শিল্প থেকে প্রতিদিন ৭ হাজার টনের বেশি বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ অপরিশোধিত কঠিন বর্জ্য বিভিন্ন সংযোগ খালের মধ্য দিয়ে নদীতে পড়ছে। এছাড়া ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এমনকি পারদের মতো ক্ষতিকর বিষাক্ত বর্জ্যরে ভারে নদীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিশোধন করেও এর পানি পান করা সম্ভব নয়। এছাড়া সদরঘাট টার্মিনালসহ ঢাকা নদী বন্দরের বিভিন্ন ঘাট থেকে প্রতিদিন ৪৯টি নৌরুটের শতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চসহ স্টিমার এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী নৌযান নানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও সমসংখ্যক নৌযান প্রতিদিন এখানে আসে। অর্থাৎ আসা-যাওয়া মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় ৪০০ নৌযান বুড়িগঙ্গা নদীতে বছরে ১.৭০ থেকে ২.৪০ বিলিয়ন টন পর্যন্ত বর্জ্য ফেলছে।
বুড়িগঙ্গার পানি কার্যত রীতিমতো বিষে পরিণত হয়েছে, যা আদৌ সেবন তো দূরের কথা ব্যবহারযোগ্যও নয়। এছাড়া যেখানে ডিজলভড অক্সিজেন থাকার কথা প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিগ্রামের বেশি সেখানে বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানিতে কোনো ডিজলভড অক্সিজেন নেই বললেই চলে। বুড়িগঙ্গার পানিতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সিসার পরিমাণও আশঙ্কাজনক। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্টস, ডায়িং, ওয়াশিং, প্লাস্টিক, পলিথিন, চামড়া কারখানা রয়েছে। এ কারখানাগুলোর অধিকাংশের তরল বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত তরল বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে।
পানিদূষণ ছাড়াও নদী দখলের কারণে বুড়িগঙ্গার দুই পাশ দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে বুড়িগঙ্গা দখল উচ্ছেদের জন্য কয়েক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। তারপরও প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে তাদের দখল অব্যাহত রেখেছে। এমনকি দেখা গেছে একদিক থেকে উচ্ছেদ শুরু হলে শেষ না হওয়ার আগেই আবার দখল শুরু হয়ে যায়।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, বুড়িগঙ্গায় যে পরিমাণ পানি প্রবাহ হয়, তার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে তুরাগ নদী, কিন্তু গাজীপুরসহ তুরাগ নদীর বিভিন্ন স্থানে দূষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এটা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ফর্মে ফিরতে বাবরকে কোহলির পথে হাঁটতে বললেন পন্টিং
মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার
সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!
সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে
ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩
সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা
যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু - ডা.মাজহার
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?
ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা
মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!
আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন
পরিবহনব্যবস্থা
রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর
ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন
জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত