বাণিজ্য সম্ভাবনায় ‘সেভেন সিস্টার্স’
২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
ভারতের মূল অংশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল। যেটি উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও মনিপুর নিয়ে ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত। বিশাল অঞ্চলটি ভূমিবেষ্টিত হলেও বাংলাদেশের সন্নিকটে। সেখানকার অর্থনীতি ভারতের মূল অংশের তুলনায় দুর্বল। জনগণের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত এমনকি নিম্নস্তরে রয়ে গেছে। এর সুবাদে ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে বাংলাদেশের বাজার সম্ভাবনা উজ্জ্বল এবং ব্যাপক। ভারতের উত্তর-পূর্বের জনগণ সুলভে হরেক বাংলাদেশি পণ্য কিনতে পারেন। এর ফলে শুধু বাংলাদেশের লাভ হবে না; বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগণ কম দামে উৎকৃষ্টমানের পণ্যসামগ্রী কিনতে এবং জীবনমান উন্নত করতে সক্ষম হবে।
প্রায় আট কোটি জনগণের বিরাট বাজার ‘দি সেভেন সিস্টার্স’। বাংলাদেশের জন্য অপার বাণিজ্য সম্ভাবনায় ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চল। তাছাড়া এর পাশর্^বর্তী রাজ্য সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ছাড়িয়ে এমনকি দক্ষিণে তামিলনাড়ু-উড়িষ্যাসহ ভারতের অনেক অঞ্চলে এবং নিকট প্রতিবেশী অপর দুই ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপাল, ভুটানেও বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রীর বড়সড় বাজার চাহিদা রয়েছে। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলসহ নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের প্রধান দুই সমুদ্র বন্দর (চট্টগ্রাম ও মোংলা) দিয়ে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর পুনঃরফতানির (রি-এক্সপোর্ট) অপার সুযোগও রয়েছে।
‘সেভেন সিস্টার্স’খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের উৎপাদিত সিমেন্ট, স্টিল ও আয়রন, ঢেউটিন, তৈরি পোশাক, মাছ ও শুঁটকি, ভোজ্যতেল, ওষুধ ও পেটেন্টসামগ্রী, ভেষজদ্রব্য, শাড়ি, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যসামগ্রী, সিরামিকস পণ্যসামগ্রী, প্লাস্টিকজাত দ্রব্য, আসবাবপত্র, ইমিটেশনের অলঙ্কার-গহনা, তথ্য-প্রযুক্তি পণ্য, আসবাবপত্র, হালকা যন্ত্রপাতি, কেবল্স, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সেবাজাত পণ্যের ব্যাপক রফতানি বাজার চাহিদা রয়েছে।
এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজার পুরোটা প্রায় দখলে নিচ্ছিল বাংলাদেশের রহিমআফরোজ কোম্পানির ব্যাটারি, আইপিএস ও অন্যান্য সামগ্রী। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্টিল ও আয়রন শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত এমএস রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রী, ঢাকার এরোমেটিক সাবান, কেয়া কসমেটিক্স, তিব্বত-এর প্রসাধনী সামগ্রী, চট্টগ্রামের ১৯৪৭ গোল্লা সাবান এবং সবশেষে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির হরেক পণ্যসামগ্রী ভারতের ওই অঞ্চলের পুরো বাজার ধরার পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
তখনই শুরু হয় নয়াদিল্লির মাথাব্যাথা। সুকৌশলে থামানো হয় বাংলাদেশের উৎপাদিত উৎকৃষ্ট পণ্যসামগ্রীর ভারতে রফতানি বাজারের দুর্দমনীয় অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশের রফতানি থামাতে ভারতের ‘কৌশল’ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক (ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) বাধা-প্রতিবন্ধকতার পাহাড়। নয়াদিল্লির সরকারি নীতি-নির্ধারকরা জানেন, বাংলাদেশের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। কেননা ওই বিশাল অঞ্চলটি ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন, দুর্গম, তুলনামূলক অনুন্নত, সুবিধাবঞ্চিত এবং দীর্ঘ ঘুরপথে যেতে হয়।
ব্যবসায়ী মহল বলছেন, বাংলাদেশের উৎপাদিত শতাধিক ধরনের উৎকৃষ্টমানের পণ্য, শিল্পপণ্য, নির্মাণ খাতের পণ্য, আইটি ও সেবাখাতের সামগ্রীর উচ্চ চাহিদা তথা ব্যাপক রফতানি বাজার সম্ভাবনা রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। ট্যারিফ নন-ট্যারিফ (শুল্ক ও অশুল্ক) বাধা-প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে বাংলাদেশের উন্নতমানের পণ্যসামগ্রীর ভারতে প্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে।
এদিকে ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট-করিডোর চুক্তিটির মাধ্যমে একতরফা সুবিধা দেয়া হয়েছিলÑ ‘ভারত থেকে ভারতের পণ্য- ভারতের জন্য’। একমুখী ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধাদানের ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি এবং তাতে উভয় দেশ লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে উবে যায়। অন্যদিকে বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে বাংলাদেশের গুণগত মানসম্পন্ন অনেক পণ্যের রফতানি বাজার সম্ভাবনা খুলে যাবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের অপর দুই নিকট প্রতিবেশী ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপল-ভুটানের সাথেও সহজে আমদানি-রফতানি বাজার প্রসারের সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।
নিকট প্রতিবেশী অপর দুই দেশ নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যোগাযোগ, সহযোগিতামূলক আদান-প্রদান বৃদ্ধির জন্য ভারতের সহযোগিতা অপরিহার্য। তাহলেই চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ কিলোমিটার সড়কপথে সহজে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে। এর জন্য বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানের মাঝামাঝি ভারতের শিলিগুড়ির (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত) কাছে মাত্র ২২ কি.মি. সড়কপথ করিডোর পাড়ি দিতে হয়। যা ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ‘চিকেন নেক’ হিসেবে পরিচিত। সেই ২২ কি.মি. দূরত্বের ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি করিডোরের প্রস্থ ২১ থেকে স্থানভেদে ৪০ কি.মি.।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বৃহত্তর বাংলা দুই ভাগ হলে শিলিগুড়ি ‘চিকেন নেক’ করিডোর সৃষ্টি হয়। এটি সহজে ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত ফুলবাড়ী চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু ভারতের অসহযোগিতা ও হরেক বাধা-বিপত্তি, হয়রানি, জটিলতার মারপ্যাঁচে এই করিডোর দিয়ে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে আমদানিতে নেপাল প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতনির্ভর। ২০ ভাগ পণ্য আসে চীন থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সৃষ্টির সুযোগ ব্যাপক। কেননা নেপাল ভারত-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তুত। বিশ^ায়নের দিকে ঝুঁকেছে নেপাল।
এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম ইনকিলাব প্রতিনিধির সাথে আলাপচারিতায় বলেন, ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের গুণগত মানসম্পন্ন উন্নত পণ্যসামগ্রী রফতানির যে প্রভূত সম্ভাবনা, তা আজও ‘সম্ভাবনা’র মাঝেই রয়ে গেছে। মাছ, শুঁটকি, এমএস রড, সিমেন্ট এ ধরনের সামান্য কিছু পণ্য ছাড়া সেই অঞ্চলে তেমন বেশি পণ্য যায় না। ভারতের মূল অংশের তুলনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি অনুন্নত। সেখানকার জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানও পিছিয়ে। অথচ স্বল্প দূরত্বে ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী সহজে রফতানি করা গেলে ওই অঞ্চলের জনগণের জীবনমানও উন্নত হতো। ভারতের সাথে আমাদের কানেকটিভিটি দুর্বল। তার ওপর বর্তমানে দু’দেশের সম্পর্কও শীতল।
তিনি আরো বলেন, ভারতে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অনেক বেশি। সেটাও বড় সমস্যা। ভারত শুল্ক-অশুল্ক বাধা সরাতে চাইছে না। কেননা ভারতে চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী সেখানে যাক সেটা ভারত চাইছে না। অথচ বাংলাদেশের মানসম্পন্ন গার্মেন্টস পণ্যসামগ্রীর ভালো চাহিদা রয়েছে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বা উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে। অন্যদিকে ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি ‘চিকেন নেক’ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে ভারত। এতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের বাণিজ্যের ব্যাপক সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, নেপাল তার আমদানি-রফতানির জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু এতে কলকাতা, হলদিয়া বন্দরের গুরুত্ব, ব্যস্ততা ও ব্যবসা কমে যাবেÑ এ কারণে ভারত তার ওপর নেপাল, ভুটানকে নির্ভরশীল রেখে প্রকারান্তরে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে চাইছে না। এরজন্য ‘চিকেন নেক’ ব্যবহার করতে দিতে চাইছে না ভারত।
তিনি উল্লেখ করেন, ভারত বাস্তবে আঞ্চলিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত হোক সেটা চাইছে না। এটা তাদের আধিপত্যবাদী নীতি। ভারতের অনীহার কারণেই ‘সার্ক’ মৃতবৎ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘সার্ক’কে পুনরায় সচল করার প্রত্যয়ের কথা বলেছেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গ্রেফতার কারা আসামী যুবদল নেতাকে গারদ ভেঙ্গে নিয়ে গেলো শ্রীনগর বিএনপি
লক্ষ্মীপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ২ জনের, আহত ৯
দেশের হয়ে আর খেলবেন না তামিম
গোপালগঞ্জে বিএনপি-আওয়ামীলীগ সংঘর্ষ
হেরেই চলেছে ঢাকা, পরাজয়ের বৃত্ত ভাঙল সিলেট
মুকসুদপুরে ক্যালেন্ডার বিতরনকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ আহত ২০ জন
১০ জেলায় শৈত্যপ্রবাহসহ সারাদেশে তীব্র শীত
আ.লীগ ক্রীড়াঙ্গনেও ব্যাপক দলীয়করণ করেছিল : মির্জা ফখরুল
নালিতাবাড়ীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযানে ড্রেজার মেশিন ও পাম্প জব্দ
ছাগলনাইয়ায় এসএসসি ব্যাচ-২০০০’র বন্ধুদের মেজবান ও মিলনমেলা
রাতের আধারে দুস্থ রোগীদের শীতবস্ত্র দিলেন ইউএনও
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল : চিকিৎসক
ঝগড়ার সময় স্ত্রীকে বাপের বাড়ী চলে যেতে বা মন ইচ্ছামতো চলতে বলা প্রসঙ্গে।
ফারুক হাসানের উপর হামলা ও আসামিদের জামিন পাওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয় : খসরু
মানিকগঞ্জে ওয়ারেন্টের ৫ আসামী গ্রেফতার
আশুলিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পিঠা উৎসব
সন্ধান মিললো ফ্যাসিস্ট গণহত্যার শিকার আরও ৬ শহীদের লাশ!
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লাভলু হত্যার বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ
ছাগলনাইয়ায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ
কেরানীগঞ্জে তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিপক্ষের হাতে নিহত ১