এক যুগ পর বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি লেনের উদ্বোধন আজ যানজট কমানোর প্রকল্পই ছিল যানজটের বড় কারণ

ভোগান্তির অবসান হবে তো?

Daily Inqilab বিশেষ সংবাদদাতা

১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম


গাজীপুর-বিমানবন্দর মহাসড়কের যানজট নিরসনে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের ভৌত কাজ চলেছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে প্রকল্প পরিচালক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর আওয়ামী সরকারের নির্লিপ্ততার কারণে এ প্রকল্প বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ৩/৪ ঘণ্টা। একই সাথে ধূলা বালিতে একাকার ছিল সড়কের আশপাশের এলাকা। ২০ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী এই ১২ বছরে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকেই পথে বসেছেন। বিআরটি লেন ও স্টেশন নির্মাণের পর দেখা গেছে, লেনগুলোতে যানজট আরো বেড়েছে। দিনের ব্যস্ততম সময়ে লেনগুলোর ২০ কিলোমিটার অংশ পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ২-৩ ঘণ্টা, কখনো তারও বেশি। তাতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রী, চালক ও পথচারিদের।
দীর্ঘ এক যুগ পর হাসিনা সরকারের নেয়া ‘অপরিকল্পিত’ এ প্রকল্প চালু হলে ভোগান্তির অবসান আদৌ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)-এর পরিচালনায় শিববাড়ি, গাজীপুর বিআরটি লেনে আজ রোববার বিআরটিসি এসি বাসের উদ্বোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক। গতকাল শনিবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা নোবেল দে বিআরটি লেনে বিআরটিসি এসি বাসের উদ্বোধন করার কথা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে ১০টি বিআরটিসি এসি বাস গাজীপুরের শিববাড়ি বিআরটি টার্মিনাল থেকে বিআরটি লেনে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার এবং এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার মোট ৪২.৫ কিলোমিটার পথ চলাচল করবে। শিববাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ভাড়া ৭০ টাকা এবং শিববাড়ি থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া ১৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যাত্রী চাহিদা এবং স্টেশনসমূহ সম্পূর্ণ প্রস্তুত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাসের সংখ্যা পরবর্তীতে বৃদ্ধি করা হবে। বিআরটি লেনে বিআরটিসির এসি বাস সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করছে।
জানা গেছে, বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশের মাঝের দুই লেন বিআরটি কোম্পানির বাসের জন্য সংরক্ষিত। দুই পাশে দুটি করে লেন রাখা হয়েছে সাধারণ যানবাহনের জন্য। আপাতত ছয়টি লেনই ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সব যানবাহন। পরিষেবা শুরুর পর এসব যানবাহনের জন্য বিআরটি লেন পুরোপুরি বন্ধ হলে যানজট বাড়বে নাকি কমবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা পর্যাপÍ সংখ্যক বাস দেয়া না হলে সাধারণ পরিবহনে যাত্রীদের চাপ বাড়লে যানজটও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিআরটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশ পরিণত হয়েছে ছয় লেনের রাস্তায়। মাঝের দুই লেন বিআরটি কোম্পানির বাসের জন্য সংরক্ষিত। দুই পাশে দুটি করে লেন রাখা হয়েছে সাধারণ যানবাহনের জন্য। পরিষেবা শুরু না হওয়ায় আপাতত বিভিন্ন পয়েন্টে ছয়টি লেনই ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সব যানবাহন। পরিষেবা শুরুর পর এসব যানবাহনের জন্য বিআরটি লেন পুরোপুরি বন্ধ হলে বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের যানজট আরো বেড়ে যেতে পারে।
জানা গেছে, বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোরটির প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কলকারখানা। এসব কারখানার মালামাল পরিবহনের জন্য বিপুলসংখ্যক ভারী যানবাহন সড়কে চলাচল করে। মহাসড়কটি ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বারও। চলাচল করে বিপুলসংখ্যক আন্তঃজেলা পরিবহন। শুধু যানবাহন নয়, দুই পাশে কলকারখানার প্রভাবে এ মহাসড়কে পথচারীও বেশি। রয়েছে ফুটপাত দখল করে দোকানপাট স্থাপন, অপ্রতুল ড্রেনেজ অবকাঠামো, যান চলাচলে বিশৃঙ্খলার মতো নানা অব্যবস্থাপনাও। এসব কারণে করিডোরটিতে প্রতিদিনই দেখা দিচ্ছে যানজট, যা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বিআরটি প্রকল্প।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় বিআরটির স্টেশন রয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে সাতটি স্টেশন ফ্লাইওভারে। মাটিতে থাকা বাকি ১৮ স্টেশনের প্রতিটিতেই দেখা গেছে তীব্র যানজট। একটি স্টেশনে তৈরি হওয়া যানজট কখনো গিয়ে ঠেকছে পেছনের আরেকটি স্টেশনে।
বিআরটি স্টেশন এলাকাগুলোয় সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়াকেই এ যানজটের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিআরটি করিডোরের দুই পাশের সার্ভিস লেনের প্রশস্ততা সাত মিটার। কিন্তু স্টেশন এলাকাগুলোয় তা নেমে এসেছে ছয় মিটারে। স্টেশন এলাকা পার হওয়ার সময় গতি কমিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে যানবাহন। ধীরগতির মধ্যে গাড়ির চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিচ্ছে যানজট।
স্টেশন নির্মাণের পর দুইপাশে যতটুকু জায়গা রাখা হয়েছে তা সাধারণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিআরটি প্রকল্পের পরিকল্পনাটিই ছিল ভুল। এর সঙ্গে নকশায় ভুল করা হয়েছে। স্টেশন বানাতে গিয়ে সড়ক সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় বিআরটি চালু হলে এখানকার যানজট আমরা যতটা কল্পনা করছি, তার চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বিআরটি প্রকল্পের সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগই আর অবশিষ্ট নেই উল্লেখ করে প্রফেসর শামসুল হক বলেন, প্রকল্পটিতে প্রধান বিনিয়োগকারী ছিল এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক)। বিআরটি সফল হবে না বুঝতে পেরে তারা এরই মধ্যে সরে গেছে। কারণ তারা দুর্নামের ভাগীদার হতে চায় না। সরে এসেছে অপারেশন মডেল তৈরির কাজে থাকা পরামর্শক হিসেবে বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ও ভারতের সেপ্ট ইউনিভার্সিটিও (সেন্ট্রার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্ল্যানিং অ্যান্ড টেকনোলজি)।
এমন প্রেক্ষাপটে এ প্রকল্পের জন্য বাস না কিনে, করিডোরটি সব ধরনের যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন অপারেশনে এসে যদি আরো ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা কাজে আসবে না। সংগত কারণে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। এখনো এটাকে রিভিজিট করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিআরটির সফলতা নিয়ে যেহেতু সন্দেহ দেখা দিয়েছে, আর সে সন্দেহের বশে মূল অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান এত বছর থাকার পর চলে গেছে, সেক্ষেত্রে এ প্রকল্পে বিনিয়োগ আদৌ কতটা কাজে আসবে তা ভাববার বিষয়। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাস্তবায়নের এ পর্যায়ে এসে বিআরটি প্রকল্প পুনর্বিবেচনার আর কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এখন বিআরটি প্রকল্পের যেসব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, সেগুলো অনুমোদিত নকশা মেনেই করা হয়েছে। এখন তো আর এ নকশা পরিবর্তন করা যাবে না। যখন এ প্রকল্পের নকশা করা হয়, তখনো কিন্তু ফুটপাতে পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। বিষয়টি তো নকশায়ই উঠে আসার কথা। এখন যদি আমরা ফুটপাত ও সড়ক প্রশস্ত করি, তাহলে আমাদের নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, যা চলমান প্রকল্প দিয়ে সম্ভব নয়।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার