‘জুতার মালা’ মুক্তিযোদ্ধা কানুর ফ্যাসিস্ট রঙ মুছে দিলো?
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
‘চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন/ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে/কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে’(কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার)। কবি বুঝিয়েছেন সাপ যাকে কোনোদিন দংশন করেনি, সে ব্যক্তি সাপের বিষ সম্পর্কে কিছুই বুঝবে না। ৯টি মামলার আসামি খুনের দায়ে জেলখাটা এবং নিষ্ঠুরতার হোতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানুকে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় কিছু রাজনীতিক ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইয়িংয়ের বক্তব্য শুনে সেটাই মনে হচ্ছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হাই কানু কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও একই সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাবেক সহ-সভাপতি। ১৫ বছর প্রতিপক্ষকে নানাভাবে জুলুম নির্যাতন করায় অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। খুনের মামলায় জেলও খেটেছেন। দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষ নেতাদের এলাকা ছাড়া করেছিলেন হাসিনার পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে। অনেকেই তার ভয়ে এলাকা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে সেই কানুর গলায় নির্যাতিতরা জুতার মালা পরিয়েছেন। এ নিয়ে হৈচৈ চলছে। এমনকি বিএনপির শরীক দলের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাইফুল হকেরাও ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র গলায় জুতার মালা পরানোয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আর জামায়াত তো দু’জনকে দল থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করেছে। ইউটিউবার পিনাকি ভট্টচার্যের ভাষায় জামায়াত এখন ‘পোপের চেয়েও বেশি ক্যাথলিক’ হয়ে গেছে। শুধু এটাই নয় জামায়াত ভারতকে খুশি করতে জামায়াতের হিন্দু শাখা খুলেছে। দলটির আমিরের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান সিলেট ইউমেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ শতাংশ হিন্দু চাকরি করে সে তথ্য সম্বলিত প্রামাণ্য চিত্র করে দিল্লির দরবারে পাঠিয়েছে। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দলটি এখন ক্ষমতার লোভে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হলেই কি তার সব অপরাধ মাফ করতে হবে? শেখ মুজিব হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে কেন? দেশে আইনের শাসন চললে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলার কথা। হাসিনার শাসনামলে আইনের শাসন ছিল না। সে সুযোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কানুর মতো নেতারা আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে এলাকার মানুষের উপর ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। যারা বিগত দিনগুলোতে নির্যাতিত হয়েছেন তারা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে জুতার মালা পরিয়েছেন সন্ত্রাসী কানুকে।
ইতোমধ্যেই তথ্য বের হতে শুরু করেছে এই আবদুল হাই কানু মুক্তিযোদ্ধার নামে নিজেকে এলাকার রাজাধিরাজ হিসেবে জাহির করেছিলেন। তার ছেলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ানোয় অন্য প্রার্থীকে পানিতে ডুবিয়েছিলেন। এমনকি এই কানু আওয়ামী লীগের সাবেক একজন মন্ত্রীর সঙ্গে টক্কর দিয়ে নিজের জাহির করায় তার ঘরবাড়িও ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। হাসিনার দোসর আবদুল হাইকে লাঞ্ছিত করা নিয়ে যেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে; কানু যাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করেছেন তারা কি দেশের নাগরিক নয়? মুক্তিযুদ্ধ না করলে কি মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার থাকবে না? মুক্তিযোদ্ধা হলেই তিনি যা খুশি তাই করবেন? মুক্তিযুদ্ধ স্পর্শ ইস্যু। এ ইস্যুতে পুঁজি করে কিছু রাজনীতিক ফ্যাসিস্ট হাসিনার অলিগার্কদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। ৯ মামলার আসামিকে গ্রেফতারের দাবির বদলে তার অপকা-ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাফাই গাইছেন। মুক্তিযোদ্ধা হলেই যদি তার সাতখুন মাফ হয় তাহলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা ড. তৈৗফিক ই এলাহীকে গ্রেফতার করা হয়েছে কেন? হাসিনার অলিগার্ক এবং বিগত ১৫ বছরের জুলুম নির্যাতনের নির্দেশদাতা অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখন কারাগারে বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
জানা গেছে, আবদুল হাই কানু শুধু বিএনপি-জামায়াত না হাসিনার শাসনামলে আ.লীগের প্রতিপক্ষ নেতাদের কাছেও আতঙ্কের নাম ছিলেন। ২০১৬ সালে চৌদ্দগ্রামের লুদিয়ারা বাজারে এই কানু ও তার ছেলে বিপ্লব আওয়ামী লীগ নেতা আবু বকর সিদ্দিককে হত্যা করে। অভিযোগ আছে আব্দুল হাই কানু উপজেলা যুবলীগ নেতা মো. শাহীন হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলো। কানুর অত্যাচারে দেশ ছাড়া প্রবাসীরা এলাকায় ফিরে এসে তার গলায় জুতার মালা দেয়। তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাকে গলায় জুতার মালা দেয়। এই কানু তাদের জামাত-বিএনপির তকমা দিয়ে জুলুম নির্যাতন করেন। এমনকি বিক্ষুব্ধ ওই জামায়াত নেতাদের দেশ ছাড়া করেছিলেন। এই কানুর বিরুদ্ধে এখনো ৯টি মামলা চলমান রয়েছে। কানুকে এতোদিন গ্রেফতার কেন করা হয়নি এ নিযে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় প্রশাসন কী আবদুল হাই কানুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। নাকি চৌদ্দগ্রামে আইন-শৃংখলা বাহিনী কানুর অনুগত?
খুন, চাঁদাবাজী, প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের অভিযোগে আবদুল হাই কানু টানা কয়েক বছর জেল খেটেছেন। ৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তার ছেলে বিপ্লবও বাপের সঙ্গে খুনের আসামি হিসেবে কারাগারে ছিলেন। বাপ-ছেলে একাধিকবার জেল খেটেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কানুর ছেলে বিপ্লব অংশ নেন। নির্বাচনের দিন ভোট ডাকাতি, সন্ত্রাস, লুটপাট নানা অপরাধে জরিত এই কানু। কথিত আছে, এই কানুই শাহীনকে হত্যা করে। শাহীনের জানাজায় অংশ নেয়ার জন্য গেলে কানু সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়ে। ওই সময় এই কানু হাতজোর করে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। এই কানু একাধিকবার আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে মারধর খেয়ে ক্ষমা চায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে যখন হাতজোর করে ক্ষমা চেয়েছেন এবং খুনের মামলায় জেল খেটেছেন তখন মুক্তিযোদ্ধার খবর ছিলো না? এই কানুর বিরুদ্ধে বাড়িঘরে ভাঙচুর, লোকজনকে বাড়িছাড়া, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলাসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ছাড় দেয়নি। ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী কানুর ভয়ে নিজ বাড়িতে থাকতে পারেননি; এমনকি অনেক নেতাকর্মী এলাকায় আসতেই পারেনি। প্রতিপক্ষকেই শুধু নির্যাতন নয় দলের ভিতরেও প্রভাব খাটাতে যুবলীগ নেতা সোহাগকেও হত্যা করে এই কানু। কানুকে জুতার মালা পড়ানোয় যারা কান্না-কাটি করছেন তারা জানেন এর আগেও তাকে কতবার মারধর করা হয়েছে? এলাকার ত্রাস কানু মুক্তিযোদ্ধা হলেও অপরাধে জড়িয়ে জেল খেটেছে, মামলা খেয়েছে। তখন মুক্তিযোদ্ধার কোনো লাঞ্ছনা হয়নি? দীর্ঘ দিন যারা এলাকা ছাড়া ছিলেন তারা ফিরে এসে প্রতিশোধ স্প্রীহা হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার লাঞ্ছনা হয়?
কানু লদিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ে নির্বাচনে আব্দুল হালিম মুজুমদারকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলো অনেকেই বলছেন জুতার মালা পড়ানো ঘটনা ওই ঘটনার জন্যই হয়েছে। লোকজনের কাছে কানু এলাকায় থাকার আকুতি করেন। স্থানীয় লোকজন বলছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বহুদিন তারা কানুর অত্যাচারে এলাকায় থাকতে পারেনি। নিজের অপকর্মের কথা বুঝতে পেরেই কানু জুতার মালা গলায় পড়ানোর সময় প্রতিবাদ করেননি। বরং সুবোধ বালকের মতো জুতার মালা নিজ হাতে গলায় পড়েছেন। সে সময় তিনি গ্রাম ঘুরে ক্ষমা চান। জনতাও তাকে ক্ষমা করে। স্থানীয় নাগরিক ও সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হক বলেছেন, ১৭ বছরে এই কানু এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি। হাসিনার শাসনামলে এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। স্থানীয়রা আগের ক্ষোভ থেকে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। জামায়াত এই ঘটনায় দুইজনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। বিএনপি মিছিল করেছে।
আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় সোস্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক চলছেই। নেটিজেনদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা কানুকে এভাবে জুতার মালা পরানোর নিন্দা জানাচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন, কানু ছিল শেখ হাসিনার অলিগার্ক। ১৫ বছর এলাকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর জুলুম নির্যাতন করেছে। মানুষ খুন করে জেল খেটেছে। এখন জামায়াত, বিএনপি, বিএনপির শরীক দল এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং যে ভাবে কানুর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে তা লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয়। খুনের মামলার জেল খাটা কানু অপকর্ম যদি জায়েজ করে তার পক্ষে নেতারা দাঁড়ান তাহলে তো ড. তৌফিক ই এলাহী, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুদের গ্রেফতার ও বিচারের বিরুদ্ধে যেতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় আবদুল হাইকে নিয়ে এতো লাফালাফি হলে কারাবন্দী ওই মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের জন্য কেন নয়? তাছাড়া আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পড়ানো মুক্তিযুদ্ধ ও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা নয়। ব্যক্তি আবদুল হাই কানু তার অকপর্মের জন্য লাঞ্ছিত হয়েছেন। এখানে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় টেনে আনা অবান্তর।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক সংকট ,অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন আদালতে হাজির হননি
সালথায় দু'গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর
শুধু নির্বাচনের জন্য মানুষ জীবন দেয়নি : আসিফ মাহমুদ
নোয়াখালীর কবিরহাটে ১৩ বান্ডেল জাল ডলার ও টাকা জব্দ, গ্রেপ্তার-১
জম্মু-কাশ্মীরে ৫ ভারতীয় সেনা নিহত
অ্যাবারক্রোম্বি সিইও যৌন পাচার মামলায় অভিযুক্ত
চাঁদপুরে সেভেন মার্ডার: নৃশংসতার বর্ণনা দিলো র্যাব
ধার্মিক জামাই পেলে শোবিজ ছাড়বেন প্রিয়াঙ্কা, শেষ ইচ্ছা হাফেজ হওয়া
আন্দোলনে নামলেন এবার ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা
রূপগঞ্জে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, পৌর ছাত্রদলের আহ্বায়ক নিহত
চাঁদপুরে জাহাজে সাতজনকে হত্যা: সেই ইরফান গ্রেপ্তার
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় মোজাম্বিকে নিহত ১০৩
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের দেশের গর্ব : সেনাপ্রধান
ব্যারিস্টার ফুয়াদের ছবি সম্পাদনা করে ভুয়া প্রতিবেদন প্রচার
সৈয়দপুরে তালাবন্ধ ঘর থেকে গৃহবধূর লাশ উদ্ধার
পাকিস্তান থেকে সরাসরি আসছে জাহাজ, আমদানি বেড়েছে ২১ শতাংশ
হাসিনা গত ১৫ বছরে দেশের ও নিজের সর্বনাশ করেছে, বাপকে ডুবিয়েছে, দেশকে ডুবিয়েছে: ফজলুর রহমান
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের
স্বৈরশাসক হটানোর পর গণতন্ত্র পুনঃনির্মাণে শিক্ষার্থীরা
সার্চ কমিটি করে গ্রহণযোগ্যদের স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি