মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরজীবন
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
‘মশা ভন ভন করে রে, মশা ভন ভন করে, রাজার বাড়ির মশা এলো গরিবের ঘরে’। এক সময় এই গান মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। এখন গরিবের ঘরে কেবল মশা নয়, রাজাও মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পারছেন না। রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত ধনী-গরিব সবাই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। দিন নেই-রাত নেই ২৪ ঘণ্টায় মশার কামড় খেতে হচ্ছে। এখন নীচতলায় যেমন মশা তেমনি হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে ১০ তলায়ও মশার উপদ্রব বাড়ছে।
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর মানুষ। মশার কামড়ে ২০২৪ সালে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ছয়শ’ মানুষ। সিটি করপোরেশনগুলোতে বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ছিল বেশি। এডিস মশার সংক্রমণ একটু কমতে শুরু করলেই সদর্পে হাজির হয় কিউলেক্স মশা। এই মশার অত্যাচার এত বেড়েছে যে, তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলছে খোদ সিটি করপোরেশন।
বিগত কয়েক বছর রাজধানী ঢাকায় নির্দিষ্ট একটি সময়ে মশার উপদ্রব বেশি থাকতো, এখন তা বছরজুড়ে। দিন যায় কিন্তু মশা কমে না বরং প্রতিদিন বাড়ছে মশার যন্ত্রণা। শত শত কোটি টাকা মশা নিধনে ব্যয় দেখানো হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম কখনোই খুব শক্তিশালী দেখা যায়নি। অধিকাংশ সময় নগরবাসী ব্যর্থতাই দেখেছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এর সুফল নগরবাসী পায় না। অনেক কার্যক্রম নিলেও তা ক’দিন না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। মশার কামড় খাওয়া এবং অসুস্থ হয়ে ভোগাই যেন নগরবাসীর নিয়তি!
নগরবাসীর অভিযোগ, এখন কিউলেক্স মশার উপদ্রবে নাজেহাল নগরবাসী। রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারা, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, মিরপুর, পুরান ঢাকা সর্বত্রই মশার উৎপাত বেড়েছে। মশক নিধনে কোনো কাজ করছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। আগে সপ্তাহে একবার মশার ওষুধ ছিটালেও এখন এক মাসেও তাদের দেখা যায় না। ফলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই বাসা-বাড়িতে মশা কামড়ায়। সারাদিন বাসায় কয়েল জ্বালানো বা মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি দাবি করছে, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই মশার ওষুধ ছিটান। কিন্তু যে হারে মশার উপদ্রব বাড়ছে, তা নিধনে সিটি করপোরেশনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। বছরজুড়ে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। কিউলেক্স মশায় কামড়ালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অবস্থা তৈরি না হলেও এদের বাড়-বাড়ন্ত সহ্য করা কঠিন।
নতুন বছর শুরু থেকে নগরে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে। কীট বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘চলতি মাসের শুরু থেকে ঢাকা মহানগরে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা বাড়বে। এতে মানুষ অসহ্য হয়ে উঠবে। তাই সিটি করপোরেশনগুলোর উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া।’
রাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নাগরিকরা। মহাখালীর আমতলীর একটি বহুতল ভবনের পঞ্চম তলায় পরিবার নিয়ে বাস করেন বাবর আলী। পোশাক ব্যবসায়ী বাবর বলেন, মশার উপদ্রব এতটাই বেড়েছে, পাঁচ তলার ওপরও মশা আসে। বাসায় দিন-রাত মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে মশা। এখন সকালবেলা ফুটপাথের টং দোকানে চা খেতে বসেও মশার উপদ্রবে শান্তি নেই।
ডিএনসিসির মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এই বিভাগের দাবি, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম ঠিকমতোই চলছিল। তবে আতিকুল ইসলামের মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর থেকে ডিএনসিসির মশক নিধন কার্যক্রম ভেঙে পড়ে। এখন যারা মশার ওষুধ ছিটান, তাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে ডেঙ্গুর পর কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আগে মশা নিধনে জনসচেতনতা তৈরিতে ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল। মূলত তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেছে। এছাড়া যেসব ভবনে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছিল তাদের জরিমানাও করছিলেন ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরিত্যক্ত পণ্য কেনার একটি প্রকল্পও চলমান ছিল। এখন কোনো কর্মসূচিই নেই।
২০২৩ সালের ২৩ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছিল ডিএনসিসি। সমঝোতার আওতায় ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে পরীক্ষা করার কথা। আর পরীক্ষার মাধ্যমেই মশা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ ও যেকোনো ডিভাইসের ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। এখন ওই কার্যক্রম চলছে নামমাত্র।
ডিএসসিসি এডিস ও কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। তবে এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ জন্য ২৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। যার অধিকাংশই সিটি করপোরেশন পূরণ করেনি। শুধু একটি শর্ত তারা পালন করছে। সেটি হলো, ডিএনসিসির পাঁচটা জোনে শুধু গবেষণা কাজ করা। ওয়ার্ডগুলো মশার লার্ভা কেমন আছে, কোনটাতে বেশি বা কোনটাতে কম, কোন ওয়ার্ডে বেশি ওষুধ ছিটাতে হবে বা কোন ধরনের ওষুধ ছিটাতে হবে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। প্রতি সপ্তাহে এ রিপোর্ট ডিএনসিসিতে পাঠাচ্ছি। কিন্তু তারা কোনো কাজ করছে কি না, তা জানি না।’
এদিকে ডিএসসিসিতে বরাবরই মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। কিন্তু এ সেবা কার্যক্রমে তেমন পরিবর্তন হয়নি। তারপরও চলতি অর্থবছর ৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ডিএসসিসি। নাগরিকদের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে যখন এডিস মশার উপদ্রবে দিনে হাজারো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল, তখনও ডিএসসিসি ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটাতো না। আবার এখন শুষ্ক মৌসুমেও তাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ফলে ডিএসসিসির নতুন ওয়ার্ড তথাÑ জুরাইন, ধনিয়া, শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা এলাকায় মশার যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ।
ডেমরার কোনাপাড়ার বাসিন্দা মির্জা খবির। আলাপকালে তিনি বলেন, ডেমরা থানা এলাকায় হাজারো খাল, বিল, ঝিল, ডোবা, নালা রয়েছে। এখন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা বা গলিতে দাঁড়ালে মনে হবে, মশা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মৌমাছির মতো চার দিক থেকে ঘিরে ধরে।
সায়েদাবাদের আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে মশক নিধন কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে তদারকি করতেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। ৫ আগস্টের পর ডিএসসিসির সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন মশার উপদ্রব নিয়ে কারও কোনো জবাবদিহি নেই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতকে ছেড়ে কেন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা?
রাজনৈতিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে জাপান
প্রবাসী উপদেষ্টার আশ্বাসে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের আন্দোলন স্থগিত
মহার্ঘভাতার সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থ উপদেষ্টা
পুরো বইমেলা মনিটরিং হবে ড্রোনে-ডিএমপি কমিশনার
যানবাহন চালক-পথচারীদের জন্য ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা
মাস্ক বা অন্য কেউ টিকটক কিনলে বিনিয়োগ করবে প্রিন্স তালালের কোম্পানি
মৃত বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পাওনাদার নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে?
খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকশিত হয় -ডিসি তৌফিকুর রহমান
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবি বিএসএফ বৈঠক
জিয়াউল হক মাইজভা-ারী ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান
অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি
৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী
মাদারীপুরে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের আন্তঃসম্পর্কবিষয়ক কর্মশালা
রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর
মাদারীপুরে হত্যার দায়ে ৫ জনের যাবজ্জীবন
এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ
‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’ দেয়ালে লিখে হত্যার হুমকি
বিমানের এই কর্মকা- সহ্য করার মতো নয় -সিলেট সুধীজন
বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম