ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১
এস আলমকে কর্ণফুলীতে বর্জ্য না ফেলার নির্দেশ দিয়েই প্রশাসন খালাস : ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি ৬ সংগঠনের

হুমকিতে ৬০০ জাতের উদ্ভিদ : মরছে ১১ প্রজাতির মাছ

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

এস আলম রিফাইন সুগার মিলের পোড়া চিনির বর্জ্যে চট্টগ্রামের প্রাণ প্রবাহ কর্ণফুলী নদীতে ভয়াবহ দূষণ অব্যাহত আছে। নদীতে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিকের বিষক্রিয়ায় হরেক প্রজাতির জলজ প্রাণীসহ ১১ প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। চরম হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির জলজ-স্থলজ উদ্ভিদও। গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মাছসহ জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। নদীর পানি বিবর্ণ হয়ে গেছে। জোয়ারের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

এ অবস্থায় নদীর জীব বৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানান পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। নিজেদের কারখানার পোড়া বর্জ্য অবাধে নদীতে ফেলে দিয়ে নদীর এমন সর্বনাশ করলেও এস আলমের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গতকাল নদীতে আর বর্জ্য না ফেলার নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এতে নদী তীরের বাসিন্দা ও পরিবেশবাদি সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। নদী এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের বিশাল ক্ষতি সাধনের সাথে জড়িত এস আলম গ্রæপের কাছ থেকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে গতকাল রাস্তায় নামে ছয়টি সংগঠন।
এদিকে গতকাল ঘটনাস্থলে যান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তার আগে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ারও প্রথমবারের মতো ঘটনাস্থলে যান। তারা এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃপক্ষের প্রতি গলিত চিনির রাসায়নিক তরল নদীতে না ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান।

তারা যখন অগ্নিকাÐের শিকার কারখানা পরিদর্শন করছিলেন, তখনও কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে আসছিল মরা এবং আধমরা মাছ। সেই মাছ ধরার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা নদীতে ভিড় জমান। একেকজনকে চার-পাঁচ কেজি করে মাছ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। দেদারসে এসব মাছ কেনাবেচা চললেও এবং সেগুলো খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা থাকলেও যথারীতি নির্বিকার ভ‚মিকা পালন করছে প্রশাসন। স্থানীয়রা জানান, আগের দিনের চেয়ে গতকাল আরো বেশি মাছ ভেসে উঠে। প্রথমদিনে শুধু ট্যাংরা এবং গলদা চিংড়ি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এদিন ছোট আইড়, বেলে, ট্যাংরা, গলদা চিংড়ি, পোয়া, রিটা মাছ মিলছে। ঘটনাস্থলে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আলীউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, একটা জলজ প্রাণী আছে, চট্টগ্রামের ভাষায় আমরা এটিকে কুইচ্যা বলি, এটা মাটির গভীরে থাকে। আজ দেখলাম, কুইচ্যা পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। মাটির নিচে থাকে কাঁকড়া, সেগুলো মরে পড়ে আছে। আইড় মাছ সাধারণত নদীর গভীরে থাকে, সেগুলো মারা যাচ্ছে। তাহলে বোঝা যায়, নদীর দূষণটা কী ভয়াবহ হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র জানান, গত দুইদিনে তারা কর্ণফুলী ১১ প্রজাতির মাছ মৃত অথবা অর্ধমৃত অবস্থায় ভেসে আসতে দেখেছেন। এগুলো হলো- চিংড়ি, টেংরা, লাল চেঁউয়া, কুকুরজিভ, ছটা বেলে, লেজেপোয়া, বস্তাপোয়া, দেশি বেলে, দাঁতিনা কোরালের বাচ্চা, টেকচান্দা এবং কাঁকড়া।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, অগ্নিনির্বাপণের পানিটা নদীতে গিয়ে সরাসরি পড়ছে। এর সঙ্গে র-সুগার মিক্স আছে। সেটা আবার আগুনে গলে লাভায় পরিণত হয়েছে। সেই পানি নদীতে পড়ার কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে জলজ প্রাণী ভেসে উঠছে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা একটা নির্দেশনা দিয়েছি, আমর মানে পরিবেশ অধিদফতর, কলকারখানা পরিবেশ অধিদফতর, ফায়ার, বিএসটিআইসহ আরো সংস্থা মিলে। নির্দেশনাটা হচ্ছে, এখানে কারখানা থেকে চিনির যে লাভাটা নদীতে গিয়ে পড়ছে, সেটা যেন আর না পড়ে। এটা আমরা আর কোনোভাবে অ্যালাউ করব না। কারখানার পাশেই প্রচুর জায়গা আছে। এখানে গভীর গর্ত করে বর্জ্যগুলে স্টোর করে রাখা যাবে।

এদিকে দূষণের কারণে জলজ এবং স্থলজ উদ্ভিদও হুমকিতে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল। ২০২২ সালে বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ‘ইকো’ কর্ণফুলী নদীতে এবং এর তীরে প্রায় ৬০০ প্রজাতির জলজ ও স্থলজ উদ্ভিদ শনাক্ত করে। এর মধ্যে ৫২৮ প্রজাতির সঙ্গে ৮১ প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদও সংস্থাটি শনাক্ত করে। সেই গবেষণা টিমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
চিনিকলের আগুনে ভয়াবহ দূষণের পর গতকাল ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি টিম কর্ণফুলী নদীর দূষণ কবলিত এলাকা ঘুরে দেখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নদীতীরে শনাক্ত করা ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদই হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, তপ্ত চিনির রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্যরে কারণে স্থলজ উদ্ভিদের শিকড় থেকে পানি বের হয়ে যাবে। পানির স্বল্পতার কারণে উদ্ভিদ মারা যাবে। অক্সিজেনের অভাবে জলজ উদ্ভিদ মারা যাবে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এ আগুন পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে গেল। এ ছাড়া তপ্ত রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ার কারণে আগুন কবলিত কারখানার আশপাশের উদ্ভিদ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় মারা যাবে বলে জানান এ গবেষক।

রাস্তায় ছয়টি সংগঠন
কর্ণফুলী নদীর পানিদূষণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রতিবাদে আগুন কবলিত কারখানার কাছে বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় অবস্থান ধর্মঘট কমসূচি পালন করেছে ছয়টি সংগঠন। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, আর কে এস ফাউন্ডেশন এবং চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আলীউর রহমান বলেন, এস আলমের চিনি কারখানার আগুনের কারণে কর্ণফুলী নদী স্মরণকালের ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে। জলজ প্রাণী, উদ্ভিদসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে। মরা মাছ ভেসে আসছে। এমন পরিস্থিতি স্মরণকালে কর্ণফুলী নদীতে আর হয়নি। এর জন্য এস আলম কর্তৃপক্ষ দায়ী, একইসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরও দায়ী। পরিবেশ অধিদফতর যদি শুরু থেকে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতো, তাহলে এত ক্ষতিকর বর্জ্য নদীতে যেতে পারতো না। রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই- এস আলম গ্রæপের কাছ থেকে এমনভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে শিল্পকারখানাগুলো খাল, নদী, জলাশয় দূষণ করার সাহস না পায়। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং আলীউর রহমানের সঞ্চালনায় এস এম পেয়ার আলী, বেলার চট্টগ্রাম কার্যালয় সমন্বয়ক মনিরা পারভিন রুবা, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সিঞ্চন ভৌমিকসহ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

গত ৪ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর এলাকায় এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক নম্বর গুদামে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিভেনি। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট সেখানে কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ৮০ শতাংশ আগুন নিভেছে, ২০ শতাংশ নেভানো যায়নি।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী