৩২ বিচারপতির বাসায় সরকারি কমচারী দিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করার অভিযোগ

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৪ পিএম | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ পিএম

উচ্চ আদালতের ৩২ বিচারপতির বাসায় সরকারি কর্মচারীকে (এমএলএসএস) দিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। এতে ১৯ বিচারপতির পরিবারের বিরুদ্ধে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে। এ ছাড়া ১৬ বিচারপতি ও সাতজনের পরিবারের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তাদের মুখের ভাষা অশালীন। এ বিষয়ে তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ১০২ বিচারপতি কর্মরত। একজন বিচারপতি প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা গৃহস্থালি ভাতা পান। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিচারপতির আদালতের চেম্বারের জন্য একজন পিয়ন এবং বাসার কাজের জন্য একজন করে দারোয়ান ও বাবুর্চি দেওয়া হয়। তবে বেশ কয়েকজন বিচারপতি প্রভাব খাটিয়ে তাদের বাসায় দুই থেকে ছয়জন এমএলএসএস নিয়েছেন। এর মধ্যে চার অবসরপ্রাপ্তসহ হাইকোর্ট বিভাগের ৩২ বিচারপতির বাসায় ৭০ জন (১০ নারীসহ) এমএলএসএসকে কাজে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে।

 

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে দাপ্তরিক কাজের সহায়তার জন্য ৪৫৪ জন এমএলএসএস কর্মরত। তাদের বেশির ভাগই এসএসসি পাস। কেউ কেউ স্নাতকোত্তর কিংবা এমবিএ ডিগ্রিধারীও রয়েছেন।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এমএলএসএস পদের নতুন নাম অফিস সহায়ক। তাদের কাজ মূলত অফিসে সীমাবদ্ধ। ১৯৬৯ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, অফিস সহায়করা অফিসের আসবাব ও রেকর্ড সুন্দরভাবে বিন্যাস, ফাইল ও কাগজপত্র স্থানান্তর, হালকা আসবাব সরানো, ফাইল অন্য অফিসে নেওয়া, কর্মকর্তাদের পানীয়জল পরিবেশন, মনিহারি ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষণ, ইউনিফর্ম পরা, কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা, ভদ্র ব্যবহার করা, ব্যাংকে চেক জমা ও টাকা তোলা, ১৫ মিনিট আগে অফিসে আসা এবং বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করবে না। কিন্তু আদালতের যেসব কর্মচারীকে বাসায় পাঠানো হয়, তাদের গৃহকর্মী, বাবুর্চি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সরকারি বন্ধের দিনও তাদের ছুটি দেওয়া হয় না।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে গত ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করেন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকার। কমিটি তিন থেকে পাঁচ দিন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে একটি প্রতিবেদন প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রধান বিচারপতির বিবেচনায় রয়েছে।

 

প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ৩২ বিচারপতির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩২ বিচারপতির বাসায় কর্মরত এমএলএসএসরা কোনো না কোনো দুর্ব্যবহার কিংবা অমানবিক আচরণের শিকার। তাদের সাপ্তাহিকসহ অন্যান্য ছুটির প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করানো হয়। দেখানো হয় ভয়ভীতি। কর্মচারীদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার, মাছ কাটা, কাপড় ধোয়ানো, গৃহস্থালির সব কাজ করানো হয়। তা ছাড়া হাত তোলা, অনাহারে রাখা, পকেটের টাকা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে বাধ্য করা হয়।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী কর্মচারী জানান, কাকরাইলে এক বিচারপতির বাসভবনে ১১ বছর ধরে কাজ করেন। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের পরও ছোট দুটি সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন।

 

ওই নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আপিল বিভাগের এক বিচারপতির বাসায় গত বছর এক নারী কর্মচারীকে ধাক্কা মেরে ধারালো বঁটির ওপর ফেলে দেওয়া হয়। এতে তাঁর পেটের ডান পাশে ক্ষত হলে আটটি সেলাই দিতে হয়। তার পরও তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় বাসায় কাজ করতে হয়েছে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতির স্ত্রী বাসায় থাকা নারী এমএলএসএসের হাতে-পায়ে গরম পানি ঢেলে দেন। তাঁকে চিকিৎসকের কাছে না পাঠিয়ে বাসায় রেখে সপরিবারে মার্কেটে চলে যান। পরে ওই নারীর স্বামী এসে তাঁকে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে জানানো হলেও কারও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে এড়িয়ে থানা পুলিশে যেতে ভয় পান ভুক্তভোগীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবসরপ্রাপ্ত চার বিচারপতির বাসায় এখনও ১০ জন এমএলএসএস রয়েছেন। তবে বর্তমান হাইকোর্টের চারজন বিচারপতি বাসায় কোনো কর্মচারী নেননি। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়া নতুন ২২ অতিরিক্ত বিচারপতির বাসায় এখনও কোনো এমএলএসএস দেওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি। বিচারপতিদের বাসাবাড়ি থেকে কর্মচারী প্রত্যাহার করে অফিসে বদলির দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম আলম ভূঁইয়া।

এমএলএসএসদের নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, তাদের বাসাও একটি আদালত। সেখানে দেখাশোনার জন্য একজন লোক দেওয়া হয়। কিন্তু তারা (এমএলএসএস) বাসায় আসার পর নানাজনের পরিচয় দেয়। যেন তাদের ভারী কোনো কাজে ব্যবহার না করা হয়। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তাকে কোনো কাজের আদেশ যেন না করি। তা ছাড়া সন্ধ্যার আগে বাসায় যাওয়ার জন্য তারা ব্যস্ততা দেখায়। আবার অনুমতি ছাড়া ছুটি কাটায় এবং এসে বলে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. আজিজ আহমেদ ভূঞা বলেন, এসব অভিযোগ আমাদের কাছে আসা উচিত নয়। বিচারপতিরা সাধারণত আদালত ও বাসার বাইরে যেতে পারেন না। তাদের দৈনন্দিন কাজ কে করবে? এটি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

সুপ্রিম কোর্ট বারের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিচারপতিদের বাসভবনের এমন ঘটনায় আমরা লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী আচরণের এটি একটি উপসর্গ। আমার প্রত্যাশা, প্রধান বিচারপতি অনতিবিলম্বে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেবেন এবং ত্বরিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবেন।’

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক রেজিস্ট্রার বলেন, ‘মূলত এমএলএসএসদের বিচারকের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ কারণে কর্মচারীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষিপ্ত। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। বিচারকদের দাবির মুখে একরকম জোর করে তাদের বাসায় কর্মচারী পাঠানো হয়।’

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র (স্পেশাল অফিসার) মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, এমএলএসএসদের বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। কমিটি অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দাখিল করলে জানা যাবে। সূত্র : দৈনিক সমকাল


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার