আল কুরআনে নূর প্রসঙ্গ-৩
০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
আল্লাহ কর্তৃক নি:সৃত জ্যোতিকে সুতন্দ্র সত্তা রূপে গণ্য করলে বিশ্বসত্তার বিভিন্ন অংশে তা বিদ্যমান বলে স্বীকার করা যায়। অধিকাংশ ধর্ম শাস্ত্রবিদ ও দার্শনিক জ্যোতিকে রূহ বা আকলের সাথে সংযুক্ত বলে থাকেন অথবা একেই রূহ বা আকল বলে থাকেন। আবার তাঁরা কখনো কখনো একে জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যেভাবে যুক্ত বলে মনে করেন। কিন্তু এ বিষয়টি পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষিত হওয়া দরকার। সহৃদয় পাঠক ও পাঠিকাগণ আমাদের পরিবেশিত বেশ কিছু পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে অবহিত হবেন, ইনশাআল্লাহ।
হিজরী তৃতীয় শতাব্দি অর্থাৎ খৃস্টীয় নবম শতাব্দীতে সুন্নী সম্প্রদায়ের সুফীগণের মধ্যে সর্বপ্রথম এই মতবাদ উদ্ভাবিত হয় যে, “ইহলোকে আবিভাবের পূর্বে নূর নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আত্মকে আল্লাহর নূর হতে অত্যুজ্জ জ্যোতিরূপে সর্ব প্রথম সৃষ্টি করা হয় এবং সেই আত্মা হতে পূর্ব নির্ধারিত সকল আত্মা নি:সৃত হয়।” এই মতবাদ “নূর মোহাম্মাদী” বলে খ্যাত। তারপর এই মতবাদ ক্রমশ: জনসাধারণের উপাসনার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। (শাহল তুসতারী, হাকেম তিরমিজী) আবু বকর ওয়াসিতী এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর হামীম আল কিদাম গ্রন্থটি হাল্লাজকৃত তাওয়াসীনের প্রথম অধ্যায়ের তুল্য বলে বিবেচিত হয় কীলানীর মতে নূর নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা:) সৃষ্টির কেন্দ্রে চক্ষুতারার প্রতিচ্ছবি (ইনসান আইনুহু ওয়াজদ : ইহাতেই ইবনে আরাবী হাফীকাহ মুহাম্মাদিয়া নামে অভিহিত করেছেন। সারসারী ও বিত্রী প্রমুখ কবিগণ এবং জাযুলী প্রমুখ সুফীগণ তাদের রচনার এই মতবাদেরই প্রশংসাগীতি গেয়েছেন। এ জন্যই হযরত আদম (আ:) হতে নূর নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) এর বংশ বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। নূর মোহাম্মাদী সম্পর্কে হাবশিয়াগণ নানা প্রকার কাহিনী বর্ণনা করেছে।
শিয়াদের মধ্যে এই মতবাদ পূর্বেই দেখা দিয়েছিল। তাদের মতে এই আত্মা যুগ হতে যুগান্তরে এবং এক নির্বাচিত ব্যক্তিসত্তা হতে অপর নির্বাচিত ব্যক্তি সত্তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে হযরত মুগিরা ইবনে শো’বা (রা:) ও হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) এই মত ব্যক্ত করেন যে, নূর নবী হযরত মোহাম্মাদের ভাস্বর প্রতিচ্ছায়া (ইহা শাবাহ-এর জড়দেহের বিপরীত) সর্বাগ্রে জন্ম লাভ করেন। সূচনা হতেই ইসমাঈলী সম্প্রদায় এই মতবাদকে তাদের মৌলিক বিশ্বাস রূপে পোষণ করে আসছেন। এই মতবাদ অপরিবর্তিত রূপে হযরত আলী (রা:)-এর শিষ্যবৃন্দ তা সকল তালেবী শীয়াদের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ইমামগণের নিষ্পাপ হওয়ার ধারণাসহ নূশায়রী শীয়াদের মধ্যে এমন কি ধার্মিক ইমামী গ্রন্থকারদের মধ্যেও নূর মোহাম্মাদীর সর্বাগ্রে উদ্ভবের মতবাদ বিস্তার লাভ করেছে। নূর নবী হযরত মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকদীর ওয়াসলাহ, খালক অনুসারে সর্ব প্রথম এবং ইজাদ, নাবুওয়্যাহ, বাছ অনুসারে সর্বশেষ। কিন্তু পূর্ববর্তী খৃস্টান মরমীয়াদে এবং মানী সম্প্রদায়ের উদ্দীপনা দ্বারা এই মতবাদ পরিপুষ্ট হয়েছে বেশী। ‘নূর’ শব্দটি আরবী। এর আভিধানিক অর্থ হলো, আলো, জ্যোতি। [ফাতহুল ক্বাদীর] আর নূল শব্দের ব্যবহারিক সংজ্ঞা সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত পাওয়া যায়। যেমন, (এক) নূর শব্দের ব্যবহারিক সংজ্ঞা সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালী (রহ:) বলেছেন : “ যে বস্তু নিজে নিজে প্রকাশমান ও উজ্জ্বল এবং অপরাপর বস্তুকেও প্রকাশমান ও উজ্জ্বল করে তোলে, তাই নূর। (দুই) তাফসীরে মাযহারীতে আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ:) উল্লেখ করেছেন যে, নূর প্রকৃত পক্ষে এমন একটি অবস্থার নাম, যাকে প্রথমে মানুষের দৃষ্টি শক্তি অনুভব করে। অত:পর তার মাধ্যমে চোখে দেখা যায় এমন সব বস্তুকে অনুভব করে। যেমন সূর্য ও চন্দ্রের কিরণ তার বিপরীতে অবস্থিত কোন ঘণ বা ভারী পদার্থের উপর পতিত হয়ে প্রথমে তাকে আলোকিত করে। তারপর সেখান থেকে কিরণ প্রতিফলিত হয়ে অন্যান্য বস্তুুকেও আলোকিত করে।
এ থেকে জানা যায় যে, নূল শব্দটি তার আভিধানিক ও প্রচলিত অর্থের দিক দিয়ে আল্লাহ তায়ালার জাত বা সত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা, আল্লাহপাক আল্লাহ। তিনি পদার্থ নন এবং পদার্থজাত ও নন। বরং তিনি পদার্থ হওয়ার বহুঊর্ধ্বে এবং এগুলো থেকে পবিত্র ও মুক্ত। আল কুরআনে এই সত্যটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : “তিনিই প্রথম ও শেষ; প্রকাশ্য (উপরে) ও গোপন (নিকটে) আর তিনি সব কিছু সম্পর্কে সম্যক.... অবগত। তিনি ছয়দিনে আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি অবশেষ উপর আসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা থেকে বের হন, আর আসমান থেকে যা কিছু অবর্তীণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা সেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা আল হাদীদ : আয়াত ৩-৪] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন : কেনা সময় তোমার অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ও ইসলাম সম্পর্কে শয়তানী কুমন্ত্রণা দেখা দিলে-“হুয়াল আইয়্যালু ওয়াল আখিরু ওয়াল যাহিরু ওয়াল বাতিনু ওয়া হুওয়া বিকুল্লি শাই-ইন, আলীম “পড়ে নাও।” [সুনানে আবু দাউদ: ৫১০ সূরা আল হাদীদ-এর ৩ নং আয়াতের তাফসীর এবং “আউয়্যাল” “আখির” “যাহের” ও “বাতেন” এ শব্দ চারটির অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের বহু উক্তি বর্ণিত আছে। তন্মধ্যে “আউয়্যাল” শব্দের অর্থ তো প্রায় নির্দিষ্ট, অর্থাৎ অস্তিত্বের দিক দিয়ে সকল সৃষ্ট জনতের অগ্নে ও আদি হলেন আল্লাহ। কারণ, তিনি ব্যতীত সব কিছু তাঁরই সৃজিত। তাই তিনি সবার আদি।“আখের”-এর অর্থ কারো কারো মতে এই যে, সব কিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিদ্যমান থাকবেন। যেমন আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “আল্লাহর সত্তা ছাড়া সমস্ত কিছুই ধ্বংশীল।” [সূরা আল্ হাদীদ : আয়াত-৮৮] এখানে “ওয়াজ্বহাহু” বলে আল্লাহ তায়ালার পুরো সত্তাকে বোঝানো হলেও অন্যদিক হতে এটা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালার চেহারা রয়েছে। কারণ, যার চেহারা নেই তার সম্পর্কে এ শব্দ ব্যবহার করা যায় না। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালার সত্তা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংসশীল। কোন কোন তাফসীরকার বলেন, এখানে “ওয়াজ্বহাহু” বলে এমন আমলকে বোঝানো হয়েছে, যা একান্তভাবে আল্লাহর জন্য করা হয়। তখন আয়াতের উদ্দেশ্য হবে এই যে, যে আমল আল্লাহর জন্য খাঁটিভাবে করা হয়, তাই অবশিষ্ট থাকবে-এছাড়া সব ধ্বংসশীল। উভয় তাফসীরি শুদ্ধ। [তাফসীরে ইবনে কাসির]
ইমাম বুখারী (রহ:) বলেন, “যাহের” অর্থ জ্ঞানে তিনি সব কিছুর উপর, অনুরূপ তিনি “বাতেন” অর্থাৎ জ্ঞানে সব কিছুর নিকটে। বিভিন্ন হাদীসে এ আয়াতের তাফসীর এসেছে। এক হাদীসে এসেছে-রাসূলুল্লাহ (সা:) ঘুমানোর সময় বলতেন-“ হে আল্লাহ! সাত আসমানের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব, এবং সব কিছুর রব..., তাওরাত, ইঞ্জিল ও ফুরকান নাযিলকারী, দানা ও আঁটি চিরে বৃক্ষের উদ্ভাবকারী, আপনি ব্যতীত কোন সত্য মা’বুদ নেই। যাদের কপাল আপনার নিয়ন্ত্রনে এমন প্রত্যেক বস্তুুর অনিষ্ট হতে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আপনি অনাদি, আপনার আগে কিছু নেই। আপনি অনন্ত, আপনার পরে, কিছুই থাকবে না। আপনি সব কিছুর উপরে। আপনার উপরে কিছুই নেই। আপনি নিকটবর্তী। আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কেউ নেই। আমার পক্ষ থেকে আপনি আমার ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিন।” [সহীহ মুসলিম : ২৭১৩; মুসনাদে আহমাদ:
২/৪০৪] অন্য কথায় তিনি শুধু সামগ্রিক জ্ঞানের অধিকারীই নন, খুঁটি-নাটি বিষয়েও জ্ঞানের অধিকারী। এক একটি শস্যদানা বা বীজ যা মাটির গভীর প্রবিষ্ট হয়, এক একটি ছোট পাতা ও অংকুর যা মাটি ফুঁড়ে বের হয়, বৃষ্টির এক একটি বিন্দু যা আসমান থেকে পতিত হয় এবং সমুদ্র ও খাল বিল থেকে সে বাস্পরাশি আকাশের দিকে উত্থিত হয়, তার প্রতিটি অনুকণা ও মাত্রা তাঁর জানা আছে। [তাফসীরে ইবনে কাসির; তাফসীরে ফাতহুল কাদীর]। সুতরাং তোমরা কোন জায়গায়ই তাঁর জ্ঞান, তাঁর অসীম ক্ষমতা, তাঁর শাসন কর্র্তৃত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনার আওতা বহির্র্ভূত নও। মাটিতে, বায়ূতে, পানিতে অথবা কোন নিভৃত কোনে যেখানেই তোমরা থাকনা কেন র্সববস্থঅয়ই আল্লাহ তায়ালা জানেন তোমরা কোথায় আছে। [তাফসীরে ইবনে কাসির]। ইমাম আহমাদ (রাহ:) বলেন : সূরা আল হাদীদ-এর ৪নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “তিনি সম্যকদ্রষ্টা। যা প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি জগতের বাইরে থেকেও সবকিছু দেখছেন। তাই এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ, সৃষ্টির সাথে লেগে থাকার অর্থ নয়, বরং এর অর্থ হচ্ছে তোমরা তাঁর দৃষ্টি ও শক্তির অধীন। তাঁর দৃষ্টি ও শক্তি তোমাদের সঙ্গেই আছে। ” (চলবে)
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নওগাঁয় ৩ জনকে পিটিয়ে জখম, আহতদের উদ্ধার করলো পুলিশ
মাদারীপুরে গুড়ি বৃষ্টি আর হিমেল বাতাসে জনজীবন স্থবির
দুমকীতে বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফনে বাঁধা
দুবাই মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীর অ্যাওয়ার্ড লাভ
'বরবাদ' সিনেমা শতকোটির গন্ডি পেরিয়ে যাবে! কি বললেন শাকিব?
রাজশাহীর পুঠিয়ায় বাস চাপায় মা ছেলেসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত
দোয়ারাবাজারে ভারতেীয় সীমান্তে ৩০০ বস্তা রশুন আটক করেছে টাস্কফোর্স
রাজশাহীতে নেসকোর ভৌতিক বিল বন্ধসহ নানারকম হয়রানীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শ্যামনগর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার
যুবদলের উদ্যোগে ৩১ দফা অবহিতকরণে আলোচনা সভা
এমাজউদ্দীন আহমদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বজনীন
বাংলাদেশে সা'দ পন্থিদের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে: হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা
ভারত বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিততে মরিয়া বাংলাদেশ
দোয়ারাবাজারে ভ্যানের ধাক্কায় শিশু নিহত
গারো পাহাড়ের পানি হাতায় ঘুরতে এসে ভোগা নদীতে ডুবে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
সিলেট-তামাবিল চার লেন উন্নতিকরণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ
১০ বছর আগে উধাও মালয়েশিয়া বিমানের নতুন করে খোঁজ শুরু
৯/১১-র ধাঁচে রাশিয়ায় ড্রোন হামলা ইউক্রেনের, বন্ধ বিমানবন্দর
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান