ওলিদের আল্লাহপ্রেম
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
আল্লাহওয়ালাদের সাথে সম্পর্ক পরশ পাথরের সাথে তুলনীয়। আল্লাহওয়ালাদের সাথে যার যত সম্পর্ক থাকবে তার জীবন তত বেশি পরিশীলিত হবে, পরিচ্ছন্ন হবে, আল্লাহমুখী হবে। অন্যদিকে দুনিয়া ওয়ালাদের সাথে যত বেশি সম্পর্ক থাকবে দুনিয়ার প্রতি তত লোভ, ভালবাসা, আসক্তি বাড়বে। সব কিছু থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিবে। আজ অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ ওয়ালা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সাথে সাথে আমরা দুনিয়া নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, যে আল্লাহওয়ালাদের সন্ধান করা বা তাদের সাথে সময় দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যাই হোক আমরা তাদের সংস্পর্শ না পেলেও অন্তত নবী আলাইহিমুস সালাম গনের জীবন, সাহাবায়ে কেরাম রাঃ গনের জীবন, পরবর্তী আল্লাহওয়ালা গনের জীবন অধ্যয়ন করে আমাদের পথের দিশা নির্ণয় করতে পারি।
সুফিয়ান রাহঃ বলেন, রবি ইবনে খুসাইমের মায়ের কাছ থেকে আমরা জেনেছি যে, তিনি তার ছেলে রবিকে বলতেন, হে রবি তুমি কি ঘুমাবে না? রবি জবাবে বলতেন, মা, সেই ব্যক্তি কিভাবে রাতের অন্ধকারে ঘুমাতে পারে, যে রবের নিকট জবাব দিহিতার ভয় করে? রবি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও তার কান্না কাটি থামত না। তখন তার মা বলতেন, হে আমার ছেলে তোমার কী হয়েছে? মনে হয় তুমি বিরাট কোন অপরাধ করে বসেছ? কোন মানুষকে হত্যা করে ফেলেছ? রবি জবাবে বলতেন হ্যাঁ মা আমি মানুষ খুন করেছি। তখন তার মা অস্থিরভাবে জানতে চাইতেন, তুমি কাকে খুন করেছ আমাকে বল। আমি তার পরিবারকে খুশি করে তোমার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে পারব। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, নিহত ব্যক্তির পরিবার যদি তোমার এই কান্নাকাটির কথা, তোমার পেরেশানী আর দুঃখের কথা, তোমার বিনিদ্র রাত্রি যাপনের কথা জানত, তাহলে নিশ্চিত তারা তোমাকে অনুগ্রহ করতে। তোমাকে ক্ষমা করে দিত। রবি জবাবে বললেন, না মা, আমি বরং আমার নিজেকেই খুন করেছি।
ইয়াজিদ ইবনে মায়শারাহ বলতেন, শোকর সংবলিত নিয়ামত, ধৈর্য্য সংবলিত বিপদ এবং আনুগত্যের দরুন আপতিত বিপদ ক্ষতিকর হয় না। আল্লাহর আনুগত্য তার নাফরমানির দরুন আগত নিয়ামত হতে উত্তম।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত শো’বা রাহঃ বলেন, আমি ইয়াহইয়া উবায়দুল্লাহর ন্যায় একজন পন্ডিত ব্যক্তির হাদিস গ্রহণ করতে কুন্ঠিত। কারণ আমি তার নামাজের প্রতি লক্ষ্য করেছি। আমার নিকট তার নামাজ উন্নতমানের মনে হয়নি। দুনিয়ার জীবনে মুসলমানদের কর্মধারা নামাজের শুদ্ধ অশুদ্ধের উপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি শুদ্ধভাবে নামাজ আদায় করতে অভ্যস্ত হয়, তার দুনিয়ার কাজ কর্মও ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে। যার নামাজ ত্রুটিপূর্ণ, তার অন্য সব কাজে অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। আফলাতুন বলেন, মানুষের দৈনন্দিন ছোট ছোট আচার আচরণ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বড় কাজগুলো যেহেতু অনেক চিন্তা ভাবনা করে করতে হয়, অনেক চিন্তা ভাবনা করে কাজ আগাতে হয়। এসব কারণে বড় কাজ করার মধ্যে অনেক কৃত্রিমতাও থাকে। বিখ্যাত তাবেয়ী ওরওয়া ইবনে যুবায়ের রাহঃ একদিন মসজিদে বসা ছিলেন। দেখতে পেলেন এক যুবক খুব তাড়াহুড়া করে নামাজ আদায় করল এবং চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। এই দৃশ্য দেখে ওরওয়া রাহঃ যুবকটিকে কাছে ডাকলেন আর বললেন, ভাইপো মহান আল্লাহর নিকট কি তোমার কোন কিছুই চাওয়ার নেই। তুমি তাড়াহুড়া করে নামাজ আদায় করেছ। আবার দ্রুত চলে যাচ্ছ। আমারতো একটু লবনের প্রয়োজন হলেও তা নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নেই। আল্লাহর বান্দারা বিভিন্নভাবে ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত হয়। তাদের ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হয় কি না, তা অনুধাবন করার জন্য প্রধান একটি আলামত রয়েছে, যে ইবাদত করার পর অন্তরে এক ধরণের প্রশান্তি বিরাজ করে। মন নরম হয়। একটি বিনীত ভাব, মহান আল্লাহর নিকট রোনাজারির একটি ভাব পয়দা হয়। অন্যদিকে একটি সৎকাজ বা ইবাদত আঞ্জাম দেওয়ার পর যদি মনের ভেতর অহংকার জেগে উঠে আত্মশ্লাগা সৃষ্টি হতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ইবাদত কবুল হচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর নিকট বার বার তওবা করতে হবে। ফকির মিসকিনদের সেবা, দান খয়রাত বেশি বেশি করতে হবে।
হাসান রাহঃ বলেন, আমির ইবনে কাইস এক মজলিসে সালাত চলাকালে ঘরের বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তোমরা কি এমনটা অনুভব কর? তারা জবাবে বলে হ্যাঁ। তিনি বলেন আল্লাহর কসম আমার কাছে সালাত এমন হওয়ার চেয়ে পেটে বার বার বর্শার ফলা বিদ্ধ হওয়া অধিক পছন্দনীয়।
আবু আলী সীনা রাহঃ বলেন, জাহেদ ঐ ব্যক্তি যে পার্থিব বিষয় সম্পদের নেশায় থেকে নিজেকে দূরে রাখে, তাকদিরের প্রতি প্রসন্ন থাকে এবং নিজের আমল অনুপাতে কথা বলে। ফকীর ঐ ব্যক্তি যে নিরিবিলি সময় কাটায় চিন্তা ফিকিরের সাথে এবং নিরবতা ভঙ্গ করে আল্লাহর জিকিরের সাথে। যে ব্যক্তি প্রতিশোধের নেশায় সারাক্ষন উম্মুক্ত থাকে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কখনো বন্ধ হয় না। ইমাম হাসান ইবনে আলী রাঃ একদিন শহরতলীর পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক জায়গায় কিছু সংখ্যক দরিদ্র লোককে নিতান্তই জীর্ণ একটু টুকরো কাপড় বিছিয়ে তার উপর শুকনা রুটি রেখে খেতে দেখলেন। লোকগুলো প্রিয় ইমামকে দেখে আহবান জানালো। যদিও ওদের আহবান ছিল সামান্য লৌকিকতার খাতিরে। কিন্তু ইমাম হাসান রাঃ তাদের আহবানে সাড়া দিলেন বাহন থেকে নেমে গবীর লোকগুলোর সাথে মাটিতে বসে রুটির কয়েকটি টুকরো খেলেন। তারপর সবাইকে নিজের বাড়িতে দাওয়ার দিয়ে নিয়ে গেলেন, তাদেরকে তৃপ্তির সাথে আপ্যায়ন করালেন। তারপর লোকগুলোকে লক্ষ্য করে বললেন, যে তোমাদের মনে যাতে এই বিশ^াস দৃঢ়মূল হয় এবং প্রয়োজনে মহান রবের দরবারে আমার ব্যাপারে এই সাক্ষ্য দিতে পারো যে, আমি অহংকারী ছিলাম না, এই জন্য তোমাদের সামান্য আহারে আমি অংশ গ্রহণ করেছি।
কাছির ইবনে ইয়াহইয়া রাহঃ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, একবার খলিফা সুলাইমান ইবনে মালিক মদীনায় আগমন করেন, তখন মদিনার গভর্ণর ছিলেন, উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাহঃ। কাছীর ইবনে ইয়াহইয়া বলেন, খলিফা সবাইকে নিয়ে মসজিদে নববীতে যোহরের নামাজ আদায় করেন। অতঃপর বিশেষ কামরার দরজা খুলে দেওয়া হয়। তিনি মেহরাবের সাথে হেলান দিয়ে আগত লোকদের মুখোমুখি বসেন। এসময় সফওয়ান ইবনে সুলাইমানের উপর তার দৃষ্টি পড়ে। সফওয়ান নামাজ রত অবস্থায় ছিলেন। তখন খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজকে জিজ্ঞাসা করেন, এই লোকটি কে? তার মত এত সুন্দর করে সালাত আদায় করতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি বললেন, এ হলো সফওয়ান ইবনে সুলাইম। খলিফা তার গোলামকে ডেকে বললেন, ৫০০ দিনার ভর্তি থলিটা নিয়ে আসার জন্য। থলি আনা হলে তিনি গোলামকে পুনরায় বললেন, তুমি এই থলিটা ঐ সালাত আদায়কারীকে দিয়ে এসো। খলিফার আদেশ অনুযায়ী গোলাম সফওয়ানের পাশে এসে বসে পড়ে। সফওয়ান তখনও নামাজ পড়ছিলেন। নামাজের সালাম ফেরানোর পর তিনি পাশে বসা লোকটির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কাছে কি তোমার কোন প্রয়োজন আছে? সে জবাবে বলে আমিরুল মুমিনীন সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক বলেছেন, আপনি যেন এই থলিটা গ্রহন করেন এবং তা আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য ব্যয় করেন। তখন সফওয়ান বলেন, সম্ভবত তুমি ভুল লোকের কাছে এসেছ। লোকটি বলে, আপনি কি সফওয়ান ইবনে সুলাইম নন? সফওয়ান বলেন, অবশ্যই আমি সফওয়ান ইবনে সুলাইম। লোকটি বলে, তাহলে আমাকে আপনার কাছেই পাঠানো হয়েছে। সফওয়ান বললেন, তুমি আবার খলিফার কাছে যাও এবং নিশ্চিত হয়ে এসো। গোলাম খলিফার কাছে ফিরে যায়। সফওয়ান তৎক্ষনাৎ জুতা নিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়েন। এরপর যতদিন খলিফা মদিনায় ছিলেন, ততদিন সফওয়ানকে আর মদিনার কোথাও দেখা যায়নি। নুআইম ইবনে হাম্মাদ রাহঃ বলেন, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহঃ যখন আখেরাতের স্মরণ ও দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব বিষয়ক হাদিস সমূহ পড়তেন, তখন জবাইকৃত গরুর মত ছটফট করতেন আর কাঁদতেন। এই সময় আমাদের কারো সাহস হতো না, তাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করার। যতক্ষণ না তিনি স্বাভাবিক হতেন। ফুযাইল ইবনে আয়ায রাহঃ কে প্রশ্ন করা হলো, সর্বাধিক আশ্চর্য জিনিস কী? তিনি জবাবে বললেন, তা হলো, তুমি আল্লাহকে চিন। কিন্তু তারপরও তাঁর অবাধ্যতা নাফরমানী করে যাও।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নেতাকর্মীদের রেখে লক্ষণ সেনের মত পালিয়ে গেছে স্বৈরাচার- সিলেটে ব্যারিস্টার সালাম
অভিনেতা অপূর্বকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মিথ্যাচার
পুঠিয়ার শিবপুরে স্বামী-স্ত্রী ও শেলিকাসহ একই পরিবারের ৩জন নিহত
বরিশালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অংশীজন সখভায় প্রধান প্রকৌশলী
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতিতে সাধারণ ক্রেতাদের নাভিশ্বাস
সংস্কারোত্তর পিআর পদ্ধতিতেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে
‘শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে’
‘রাষ্ট্রের সকল স্তরে ইসলামী সংস্কৃতির অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে’
মেট্রোকে থামিয়ে ফাইনালে রংপুর
৪৩ বছর পর কুয়েতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারতে: দুলু
মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল, কানাডায় কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন ট্রুডো?
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ
ভারতের সেবাদাসী হাসিনাকে পুনর্বাসনে এবার জঙ্গি মিশনে তারা!
মাহফুজকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া উচিত? যা বললেন ড. জাহেদ
৬ বছরের মধ্যেই চীনের হাতে হাজার পরমাণু বোমা! উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের
বিগত সময়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে বড় ধরনের অপরাধ করেছে পুলিশ, এ জন্য আমরা লজ্জিত: আইজিপি
ব্রাহ্মণপাড়ায় পাঁচ দিনেও খোঁজ মিলেনি নিখোঁজ সোহাগের
কসবায় পাহাড় কাটার অপরাধে ২ জনের অর্থদণ্ড
নরসিংদীতে মাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার