বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

Daily Inqilab ইনকিলাব

১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা, এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সমাজের সকল স্তরের মানুষ যেন সমান মর্যাদা এবং সুযোগ পায়, এই লক্ষ্যই একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজের ভিত্তি। ইসলামের আদর্শে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবন ও শিক্ষা দ্বারা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা ও কর্মের মাধ্যমে, সমাজে বৈষম্য নির্মূল এবং সকল মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের কাছে বারবার এই শিক্ষাটি দিয়েছিলেন যে আল্লাহর কাছে সকল মানুষ সমান। বর্ণ, গোত্র, বা আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা উচিত নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে আরব সমাজ ছিল গভীরভাবে বৈষম্যমূলক। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য ছিল একাধিক মাত্রায়, যা সমাজের সামগ্রিক ন্যায়বিচারকে বিপর্যস্ত করেছিল। ধনী-গরিব, ক্রীতদাস-মুক্ত, পুরুষ-নারী-এই ধরনের বৈষম্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ধর্মীয় সহনশীলতার অভাব ছিল এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলত। জাহেলিয়াতের যুগে (ইসলামের আগের যুগে) আরব সমাজে কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেওয়ার প্রথা ছিল। এই বর্বর প্রথা নারীদের মর্যাদার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং সমাজের বৈষম্যমূলক মনোভাবের একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। মহানবী (সা.) এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তা বন্ধ করেছিলেন, যা নারীদের মর্যাদা ও অধিকারের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।

ইসলামের আগমন এবং মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা: ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা ছিল এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সকল মানুষকে সমান মর্যাদায় দেখা। মহানবী (সা.) ইসলামের প্রচার শুরু করেন, এবং প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা ছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। ইসলাম প্রচারের সময়, মহানবী (সা.) নতুন সমাজ গঠনের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি মুহাজির (মক্কার মুসলমান) ও আনসার (মদিনার মুসলমান) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মুহাজিরদের ও আনসারদের মধ্যে সম্পত্তি, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ ভাগাভাগি করা হয়, যা ইসলামের সমতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা প্রতিফলিত করে। এই ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে, মহানবী (সা.) একটি বৈষম্যহীন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।

বৈষম্যহীন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: মহানবী (সা.) সমাজে সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সময়ে, জাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, যা ধনীদের সম্পদ থেকে গরীবদের জন্য অংশ প্রদান নিশ্চিত করেছিল। জাকাত একটি সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করে এবং এটি সমাজের গরীব ও দুর্বলদের সাহায্য করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। জাকাত ব্যবস্থা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যা সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জীবন চলার পথে বৈষম্য দূর করা অতীব জরুরী। যেটাকে আমারা অন্য ভাষায় ন্যায়বিচার বলতে পারি। কারণ ন্যায়বিচার ছাড়া মানুষ শান্তি-শৃঙ্খলা লাভ করতে পারে না। সূরা শুরা এর ১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি।” এখানে সরাসরি ন্যায়বিচার করতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। যেখানে একটুও অন্যায় হওয়ার সুযোগ ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য বিচার সমান। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে রিসালাত পূর্ণতা লাভ করে। লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা। দীর্ঘ ২৩ বছরে চেষ্টা চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন। তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থা মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদিক দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিটায় ধারক ও বাহক । সূরা হাদিদ এর ২৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “মহান আল্লাহ সব নবী ও রাসূলকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।” বিচারক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘‘(হে নবী)! আমি সত্য সহকারে আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যাতে আপনি আল্লাহর দেখানো মুক্তির আলোকে বিচার-আচার করতে পারেন।’’ [সূরা নিসা : ১০৫] আমারা যদি একটা উদাহরণ নিয়ে আসি তাহলে দেখতে পাবো তিনি কতটা স্বজনপ্রীতি দূরে থাকতেন বা বৈষম্য করেন নাই । তিনি বলতেন, আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে আমি নির্দ্বিধায় চুরির শাস্তি হিসেবে তার দু’হাত কেটে দেবো। সূরা আল-মায়িদা এর ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসেবে সদা দন্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন, “আর যখন তোমরা মানুষের কোনো বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ করো তখন ইনসাফের সাথে বিচার মীমাংসা করো।” [সূরা নিসা : ৫৮] হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’’

নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য দূরীকরণ : আমরা যদি ইসলামের আগে জাহেলী যুগ ও পরের যুগ খেয়াল করি তাহলে নারীদের প্রতি যে বৈষম্য করা হতো সেটা আমাদের নবী দূর করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তা কেউ দেখাতে পারে নাই। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বলা যায় যে, মহানবী (সা.)-এর প্রিয় স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.); যিনি একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী ছিলেন। খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মহানবী (সা.) নারীদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদার গুরুত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাথে বিবাহের মাধ্যমে, মহানবী (সা.) নারীদের ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি, তিনি নারীদের বিয়েতে সম্মতি, সম্পত্তির অধিকার, এবং শিক্ষার গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা নারীদের সমানাধিকারের বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ছিল। নিচে আরও কিছু পয়েন্ট তুলে ধরা হল : ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.) নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, যা তার সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় ছিল বিপ্লবাত্মক। নবী (সা.) এর আগমনের পূর্বে আরব সমাজে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ছিল। তাদেরকে অনেক সময় সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হত, এবং নারীশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর রীতি ছিল প্রচলিত। ইসলামের উদ্ভাবনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষের মর্যাদা সমান করেছেন, এবং কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে নারীদের অধিকারের সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন।

কুরআনে নারীর অধিকার: কুরআন শরীফে বিভিন্ন জায়গায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, আল্লাহ বলেন: ্রপুরুষদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল, আর নারীদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল।গ্ধ (সূরা নিসা, ৪:৩২) এখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং তাদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি ছিল এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যেখানে নারীকে পুরুষের সমান হিসাবে গণ্য করা হলো।

উত্তরাধিকার আইন: ইসলাম নারীদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছে, যা পূর্ববর্তী সমাজে অনুপস্থিত ছিল। কুরআন বলে, ্রপুরুষদের জন্য যা পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়রা রেখে যায় তার একটি অংশ রয়েছে, এবং নারীদের জন্যও রয়েছে যা পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়রা রেখে যায়।গ্ধ (সূরা নিসা, ৪:৭) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি লাভের অধিকার দিয়েছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার: নবী মুহাম্মাদ (সা.) স্পষ্টভাবে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ, নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য।” (ইবন মাজাহ ) এটি ছিল নারী শিক্ষা নিয়ে সেই যুগের অন্যতম বিপ্লবী নির্দেশনা। শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নারীরা সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কারণ সেই সময় নারীরা সকল জায়গায় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

হাদীসের আলোকে নবী (সা.) এর দৃষ্টিভঙ্গি: হাদীসে নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে অসংখ্য নির্দেশনা পাওয়া যায়। এক হাদীসে নবী (সা.) বলেন, ্রতোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে।গ্ধ (তিরমিজি, ৩৮৯৫) এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, নারীদের মর্যাদা কতটা উঁচু ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগে। নবী মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও তার স্ত্রীদের সাথে অত্যন্ত সহানুভূতি ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতেন, যা ফলো করলে কল্যাণই বয়ে আনে।

বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের অবসানে মহানবী (সা.): ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.) মানবতার জন্য এমন এক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেখানে বর্ণ, জাতি, গোত্র বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে কারও উপর কারও শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না। বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য ইসলামের পূর্ববর্তী আরব সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল, যেখানে গোত্রবাদ, বংশমর্যাদা এবং গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করা হতো। মহানবী (সা.) এই ধরনের সব বৈষম্য দূর করার জন্য শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন এবং সকল মানুষের মধ্যে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করেছিলেন।

কুরআনের নির্দেশনা: কুরআন শরীফে বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের অবসান বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ্রহে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চেনো। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে বেশি পরহেজগার।

(সূরা হুজরাত, ৪৯:১৩) এই আয়াতটি বর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যের অবসানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, মানুষের মধ্যে যে বিভক্তি তা শুধু পরিচয়ের জন্য, মর্যাদার জন্য নয়। প্রকৃত মর্যাদা আল্লাহর কাছে কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
বিদায় হজের ভাষণ: মহানবী (সা.) বিদায় হজে সমগ্র মানবতার জন্য একটি বার্তা দেন, যা আজও বর্ণবাদবিরোধী এবং সাম্যবাদী সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ্রহে মানবজাতি! তোমাদের প্রভু এক এবং তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো আরবের উপর অ-আরবের, এবং কোনো অ-আরবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কোনো কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, একমাত্র তাকওয়া বা আল্লাহভীতির মাধ্যমে।গ্ধ (মুসলিম, ১৬৯) এটি ছিল বর্ণবাদবিরোধী একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা, যা ইসলামের সাম্যবাদী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

হযরত বিলাল (রাঃ)-এর উদাহরণ: নবী (সা.) বর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্য দূর করার জন্য প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। হযরত বিলাল (রাঃ) ছিলেন একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস, যার গায়ের রং ছিল কালো। ইসলাম গ্রহণের পর, নবী (সা.) তাকে মক্কার অন্যতম সম্মানিত এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করেন—তিনি মসজিদে নববীতে আজান দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নবী (সা.) তার গায়ের রঙ বা সামাজিক অবস্থানের কারণে তাকে কোনোভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করেননি বরং তার যোগ্যতা ও ঈমানের ভিত্তিতে মর্যাদা প্রদান করেছিলেন।

হাদীসের দৃষ্টিতে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান: বর্ণবাদ দূর করার জন্য মহানবী (সা.) এর নির্দেশনা হাদীসের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। নবী (সা.) বলেছেন, ্রআল্লাহ তোমাদের বর্ণ, আকৃতি, সম্পদ কিংবা সামাজিক অবস্থানের দিকে তাকান না; তিনি তোমাদের অন্তরের দিকে এবং তোমাদের কাজের দিকে তাকান।গ্ধ (মুসলিম, ২৫৬৪) এই হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইসলামে মানুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, যেমন বর্ণ বা জাতিগত পরিচিতির উপর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বরং একজন মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয় তার কর্ম এবং আল্লাহভীতি দ্বারা।

সাম্যের মডেল: মদিনা সনদ: মদিনায় যখন নবী মুহাম্মাদ (সা.) ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি এবং গোত্রের মানুষ বাস করত। তিনি সবাইকে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ্রমদিনা সনদগ্ধ প্রণয়ন করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, মদিনার সকল অধিবাসী, তাদের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় যাই হোক না কেন, সমান অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এটি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং বৈষম্যহীনতার এক অনন্য উদাহরণ।

ধর্মীয় সহনশীলতা: মহানবী (সা.) অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করতেন। ধর্মীয় সহনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো মদিনায় ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মহানবী (সা.) ্রমদিনার সনদগ্ধ তৈরি করেছিলেন। মদিনার সনদ একটি লিখিত সংবিধান হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহাবস্থান এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই সনদটি ধর্মীয় সহনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এবং মহানবী (সা.)-এর সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির প্রতিফলন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ধর্মীয় সহনশীলতা ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার সময়ে আরব উপদ্বীপ ছিল গোত্রভিত্তিক এবং ধর্মীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন। ইসলাম শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য নয়, বরং মানবজাতির জন্য সাম্য, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক সম্মানের বার্তা নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরণ রেখে গেছেন। (চলবে)

লেখক : মুহাদ্দিস ও মুফতী, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা, মোমেনশাহী


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও

আরও পড়ুন

আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান

দ. আফ্রিকাকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের অভিযানে পাকিস্তান

পাকিস্তানে তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র হামলা, নিহত ১৬ সেনা

পাকিস্তানে তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র হামলা, নিহত ১৬ সেনা

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য

ঝিকরগাছায় মোটরসাইকেল আরোহীকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় নিহত ১,  আহত ১৫

ঝিকরগাছায় মোটরসাইকেল আরোহীকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় নিহত ১, আহত ১৫

হিলিতে বিএনপির উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ

হিলিতে বিএনপির উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের খসড়া তালিকা প্রকাশ

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের খসড়া তালিকা প্রকাশ

বদলগাছীতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

বদলগাছীতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের দায় আছে: অর্থ উপদেষ্টা

পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের দায় আছে: অর্থ উপদেষ্টা

সা'দ অনুসারী কতৃক হত্যা-তান্ডবের বিচার দাবীতে কটিয়াদীতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল

সা'দ অনুসারী কতৃক হত্যা-তান্ডবের বিচার দাবীতে কটিয়াদীতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল

এক সময় কোরআন ও হাদিসের আলোকে কথা বলা দুরহ ছিল: অতিরিক্ত আইজিপি খোন্দকার রফিকুল

এক সময় কোরআন ও হাদিসের আলোকে কথা বলা দুরহ ছিল: অতিরিক্ত আইজিপি খোন্দকার রফিকুল

নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত, বৃষ্টি ও শীতে জনজীবনে চরম ভোগান্তি

নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত, বৃষ্টি ও শীতে জনজীবনে চরম ভোগান্তি

মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের দখলে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি

মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের দখলে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি

মাহফিল থেকে ফেরার পথে ফুলগাজীতে বাস উল্টে আহত ২১

মাহফিল থেকে ফেরার পথে ফুলগাজীতে বাস উল্টে আহত ২১

একমাস ধরে চলছে সড়কের গাছ কর্তন, জানেনা প্রশাসন

একমাস ধরে চলছে সড়কের গাছ কর্তন, জানেনা প্রশাসন

যানবাহন চালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে : খুবি উপাচার্য

যানবাহন চালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে : খুবি উপাচার্য

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদী গ্রেপ্তার

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদী গ্রেপ্তার

কিশোরগঞ্জ হাওরের অলওয়েদার সড়কের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে: ফাওজুল কবির খান

কিশোরগঞ্জ হাওরের অলওয়েদার সড়কের সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে: ফাওজুল কবির খান

মোংলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

মোংলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

এবিসির প্রতিবেদন: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

এবিসির প্রতিবেদন: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়