বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)
১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
মদিনা সনদ: মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সেখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করত। এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে তিনি ্রমদিনা সনদগ্ধ প্রণয়ন করেন। এটি ছিল সেই সময়ের প্রথম লিখিত সংবিধান, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সমান অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। মদিনা সনদের মূল বিষয় ছিল:
সকল ধর্মের মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা।
মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও নিরাপত্তা।
কোনো সম্প্রদায়ের উপর অন্য সম্প্রদায়ের বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ।
ইহুদিদের সাথে চুক্তি: মদিনায় ইহুদিদের সাথে রাসূল (সা.) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য চুক্তি করেন। ইহুদিদের জন্য তিনি তাদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ইহুদি ও মুসলমান উভয়ে মদিনার শান্তি রক্ষার দায়িত্বে সমানভাবে অংশ নেবে। এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে, রাসূল (সা.) ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সহনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করতেন।
নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে সহনশীলতা : মক্কা বিজয়ের পর, দক্ষিণ আরবের নাজরান অঞ্চল থেকে একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে দেখা করতে আসে। তারা ইসলামের সাথে খ্রিস্টান ধর্মের বিষয়ে আলোচনা করে এবং রাসূল (সা.) তাদের শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেন। তিনি তাদের জন্য মসজিদে নববীতে বিশেষ স্থানের ব্যবস্থা করে দেন, যেখানে তারা তাদের প্রার্থনা করতে পারে। এই উদাহরণটি ধর্মীয় সহনশীলতার একটি স্পষ্ট নিদর্শন।
বিদায় হজের ভাষণ: রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজে তার ভাষণে সমগ্র মানবজাতির জন্য সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ্রকোনো আরবের উপর অ-আরবের, এবং কোনো অ-আরবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।গ্ধ (তিরমিজি) এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের বিরোধিতা করেন এবং মানবজাতির সকলকে সমান মর্যাদা প্রদানের আহ্বান জানান।
ইসলামে ধর্মান্তর করতে বাধ্য না করা: কুরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ্রধর্মের বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই।গ্ধ (সূরা বাকারা, ২:২৫৬) এই নির্দেশনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনোই কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেননি। তিনি সব ধর্মের মানুষকে তাদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে শিখিয়েছেন। ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর গড়ে তোলা সমাজ ছিল একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। তার জীবন ও কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ধর্মীয় বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব। তার এই শিক্ষা আজও আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেখানে বৈষম্য ও ধর্মীয় উগ্রবাদ এক বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
দাসপ্রথার বিলোপ:
মহানবী (সা.) দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং দাসদের মুক্তি দিতে উৎসাহিত করেছেন। দাসদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের মুক্তির প্রচেষ্টা তাঁর ন্যায়বিচার ও সমতার আদর্শের অংশ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, হযরত বিলাল (রা.), যিনি একসময় একজন ক্রীতদাস ছিলেন, তাঁকে মহানবী (সা.) মুক্তি দিয়ে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিনের (আজানদাতা) মর্যাদা দিয়েছিলেন। বিলালের এই উন্নতি সমাজে দাসদের মর্যাদা বৃদ্ধির একটি উদাহরণ এবং মহানবী (সা.)-এর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নবীজির বার্তা: মহানবী (সা.) বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের কাছে ইসলামের বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং সকল মানুষের সমতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বার্তাটি শুধুমাত্র আরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, মহানবী (সা.)-এর সময়কালে, তাঁর বার্তা পৌঁছেছিল বাইজেন্টাইন এবং পারস্য সম্রাজ্যে। তাঁর শিক্ষার প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেখা গিয়েছে, যা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার প্রমাণ।
সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি: মহানবী (সা.) সমাজে সম্প্রীতি এবং সংহতির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি সামাজিক ও জাতিগত পার্থক্য দূর করার জন্য এবং সবাইকে একত্রিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামের প্রচারকালে, মহানবী (সা.) একাধিকবার বিভিন্ন গোত্রের নেতাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি স্থাপন করতে সাহায্য করেছেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও শিক্ষা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। তাঁর নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, এবং সাম্যের শিক্ষা শুধুমাত্র তার সময়ের সমাজকেই পরিবর্তন করেনি, বরং এটি পরবর্তীতে মানব সমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মহানবী (সা.)-এর ব্যবহৃত নীতিমালা ও পদক্ষেপগুলো আজও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি সকল মানুষের মধ্যে সমতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করেছেন, নারীদের অধিকার উন্নত করেছেন, এবং ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নির্দেশনায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সংহত সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করেছে। মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন একটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ হতে পারে। এটি আমাদের সকলকে মনে করিয়ে দেয় যে, একে অপরকে সম্মান জানানো, সহযোগিতা করা, এবং সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা আমাদের সামাজিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও কর্ম আজও মানবতার জন্য একটি অবিচলিত দিশারী হিসেবে কাজ করে এবং সকল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সাম্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। (সমাপ্ত)
লেখক: দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় মুরাদনগরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ
গুজব উড়িয়ে দিয়ে পুরোদমে অফিস করলেন প্রধান উপদেষ্টা
রাজশাহী থেকে চালু হচ্ছে কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন
ফরিদপুরের পদ্মায় চলছে ইলিশ মাছ ধরার মহা উৎসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরব নিথর।
নোবিপ্রবি বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের মতবিনিময়
তথ্য ও সস্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নবনিযুক্ত সচিবের মতবিনিময়
সরকারি ইন্ধনে তাণ্ডব হিন্দুদের, বাহরাইচে আতঙ্কে মুসলমানরা
রাজশাহীতে রেড ক্রিসেন্টের পিপিপি প্রকল্পের অবহিতকরণ সভা
কেরানীগঞ্জে অবৈধ শিশা কারখানায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান, জরিমানা ২ লক্ষ টাকা
বন, বনভূমি, ডলফিন সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
ইরানের সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়া চালাতে চায় সৌদি
কুষ্টিয়ায় হাসপাতালের ২০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি চার শতাধিক শিশু
সুন্দরবনে ৯০ অফিসের ৮শতাধিক বনকর্মীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ জেলায় প্রস্তুত ৩৫৯ আশ্রয় কেন্দ্র
পুলিশের ৬ কর্মকর্তাকে বদলি ও পদায়ন
পাসপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে যেভাবে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান হারুন
তবে কি ঐশী-শুভ'র প্রেমের গুঞ্জন সত্যি? সংসার জীবনের ইতি টানতে চলেছেন আরিফিন শুভ?
লক্ষ্মীপুরে ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি,লঞ্চঘাটে আটকা পড়েছে ভোলাগামী শতাধিক যাত্রী
সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন গ্রেপ্তার
সাড়ে ৩ বছর পর ফিরে ওয়াশিংটনের রেকর্ড গড়া বোলিং
৮ম আন্তর্জাতিক সম্মেলন করতে যাচ্ছে রাবির পরিসংখ্যান বিভাগ