কুতুবউদ্দিন আইবেক : নতুন ভারতের রাজসড়ক-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১২ মে ২০২৩, ১১:১১ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৫ পিএম

সুলতান মইজউদ্দিন ঘুরী (১১৪৯-১২০৬ খ্রি.) রাজধানী গজনীকে করে তুলেছিলেন শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। তাঁর সাম্রাজ্যের সীমাভুক্ত ছিলো বর্তমান আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ইরানের বিপুল অংশ। গজনীতে তিনি প্রাজ্ঞ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে বিশেষ মজমার আয়োজন করতেন। সেখানে আলিম, আমলা, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, দার্শনিক, কবি, সংগীতশিল্পী, সমরনায়ক ও অন্যান্য প্রভাবশালীও থাকতেন। জ্ঞানের আলাপ হতো। গান-কবিতা হতো। মজলিস গুলজার হতো হাসি-আনন্দ, বিতর্ক ও প্রজ্ঞাচর্চায়। এসব মজলিসের এক সদস্য ছিলেন সিরাজউদ্দিন মুহম্মদ তাজিক। ১১৮৬ খিস্টাব্দ/৫৮২ হিজরিতে তিনি মুহম্মদ ঘুরীর সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে নিয়োজিত হন। বিস্ময়কর বাগ্মিতার কারণে তিনি লাভ করেন আফসাহুল আজম বা অলঙ্কার বিশারদদের শ্রেষ্ঠজন উপাধি। নিজ পুত্র মিনহাজুস সিরাজকে তিনি এমন মজলিসে নিয়ে যেতেন। সেই পুত্র পরিণত বয়সে রচনা করেন বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ তাবাকাতে নাসিরী। এ গ্রন্থে মিনহাজ লেখেন, ঘুরীর মজলিস শেষ হলে গুণীদের দেওয়া হতো নানা উপহারÑ স্বর্ণমুদ্রা, উন্নত বাহন, জমি-জিরাত ইত্যাদি। একদা ঘুরীর দরবারের এক সদস্য নিজের প্রজ্ঞার দক্ষতা প্রদর্শন করে অনেক পুরস্কার লাভ করলেন, পরিমাণে যা সবার চেয়ে বেশি। তিনি আপন উপহার নিয়ে বাইরে এলেন এবং তুলনামূলকভাবে দরিদ্র যেসব জ্ঞানী, তাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। কাজটি করলেন রাতের অন্ধকারে, গোপনে। বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলে আলোচনা হতে লাগলো।

মুহম্মদ ঘুরীর কাছেও খবরটি পৌঁছালো। তিনি জানতে চাইলেন কে সেই দানশীল ব্যক্তি? জানা গেলো তিনি হলেন মুহম্মদ ঘুরীর ক্রীতদাস আইবেক, যার মূল নাম হলো কুতুবউদ্দিন। তার জন্ম হয়েছিলো তুর্কিস্থানে পাহাড়ী কবিলা আইবকদের এক ছায়ানিবিড় বসতিতে। বালক বয়সে তিনি ডাকাতদের কবলে পড়েন এবং তাদের দ্বারা দাস হিসেবে বিক্রীত হন নিশাপুরের বিচারক ফখরুদ্দিন আবদুল আজিজ কুফির কাছে। আবদুল আজিজ ছিলেন বহু বিদ্যায় পারদর্শী ও গুণী। বালকটিকে তিনি উত্তম শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ করেন। শেখান ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, ভূগোল, গণিত ও যুদ্ধবিদ্যা। বিচারকের স্নেহ ও সমাদরে আইবেক তার মেধার স্ফুরণ ঘটান। তার মৃত্যুর পরে তার সন্তানরা আইবেককে বিক্রি করে দেন এক ব্যবসায়ীর কাছে। সেই ব্যবসায়ী তাকে নিয়ে আসেন গজনীর বাজারে, আইবেক বিক্রীত হন মুহম্মদ ঘুরীর কাছে। বীরত্ব, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা, দানশীলতা, সামরিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বগুণে আইবেক অচিরেই ঘুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উত্তম আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে ঘুরী তাকে রাজকীয় অশ্বশালার প্রধান বা ‘আমির-ই-আকুর’ পদে নিয়োগ করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি হন সেনাবাহিনীর এক স্তম্ভ।

মুহম্মদ ঘুরী যখন ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন, আইবেক ছিলেন তার প্রায় নিত্যসঙ্গী এবং সাফল্যের অন্যতম কারিগর। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি ছিলেন ঘুরীর প্রধান ও বিজয়ী সেনাপতি। বিচক্ষণতা ও দক্ষতা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন তার যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুণ। ঘুরী তাকে ভারতে তার প্রতিনিধি ও শাসক নিয়োজিত করেন। এরপর আইবেক আপন দক্ষতার প্রকৃত প্রদর্শনী শুরু করেন। সীমান্তের হুমকিসমূহকে মোকাবেলা করেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই জয় করেন হানসী, মীরাট, কোল, দিল্লি ও রণথম্বোর। অতঃপর লাহোর থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেন দিল্লীতে। রাজা জয়চন্দ্রের হুমকি মোকাবেলা করে ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে কনৌজে জয় করেন। ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে অধিকার করেন গুজরাট। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে বদায়ুন এবং চাঁদোয়াকে দিল্লীর অধীনে আনেন। কালিঞ্জর ও মাহোবা অধিকার করেন ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে। লাহোর থেকে লাখনৌতি জুড়ে প্রসারিত হয় বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় বন্ধন, আইন-শৃঙ্খলা। এর মধ্যে আজমির ও মীরাটে মাথা তুলেছিলো বিদ্রোহীরা। দক্ষ হাতে একে একে তিনি তাদের দমন করেন।

সদরুদ্দিন হাসান নিজামীর বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ তাজুল মাসিরে দেখা যায়, আইবেক কীভাবে বিজিত অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, জনগণের নিরাপত্তা বিধান, ন্যায়বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনজীবনে বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরণে সচেষ্ট হন। তাঁর শাসনামল দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব ১১৯২ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ। এ সময়ে তিনি মুহম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি হিসেবে শাসন কাজ পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় পর্ব ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়ে তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীন সুলতান। উভয় পর্বে অত্যন্ত দক্ষ একজন সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাকে দেখা যাবে, যিনি বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত নানা রাজ্যকে বৃহত্তর ভারতের পাটাতনে সম্মিলিত করেছেন এবং একটি কল্যাণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিবেদিত রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা পালন করছেন। (চলবে)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে

৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে

৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে

হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন

হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন

আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০

আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০

বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী

বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী

ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ

ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ

নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস

নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪

গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য

নাইজারে মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থান নিল রুশ সেনা

নাইজারে মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থান নিল রুশ সেনা