ঢাকা   সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫ | ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-১

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সাইয়েদ মুহম্মদ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. (১১৭৩-১২৩৫ খ্রি.) ছিলেন দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ধর্মপ্রচারক ও সুফি সাধক। ‘কুতুবুল আকতাব’ ছিল তাঁর উপাধি। চিশতি তরিকা শুধুমাত্র আজমীর এবং নাগাউরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিল্লীতে স্থায়ীভাবে এই তরিকা প্রতিষ্ঠায় তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বংশলতিকা হযরত হোসাইন ইবনে আলী রা.-এর মাধ্যম হয়ে হযরত মুহম্মদ সা.-এর সাথে মিলিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. ধর্ম, বর্ণ ও জাত নির্বিশেষে মানুষের উপর প্রচÐভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। মানবসেবা, সম্প্রীতি ও ক্ষুধার্তকে অন্নদান ছিল তাঁর জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি রাজদরবারের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার নীতি অনুসরণ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার চিশতিয়া তরিকার সাধকরা মনে করেন, শাসকগোষ্ঠীর এবং সরকারের সাথে সখ্য গড়ে উঠলে তাদের দুনিয়াবি চিন্তা ও পার্থিব ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারে।

খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. সবসময় মজলিসের আয়োজন করে তরিকতের গোপন রহস্যতত্ত¡ নিজ শিষ্যদের কাছে উন্মোচিত করতেন। মজলিসে যেসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হতো সেগুলো হলো- আত্মত্যাগ, বাসনাশূন্য প্রেম, আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস, পবিত্র কুরআনের বিধিবিধান অনুশীলন, সুন্নাতে রাসূলের পায়রবী, সব মানুষের সাথে একইরূপ আচরণ ও যথাসম্ভব দুস্থদের সাহায্য। তাঁকে মানুষ যেসব অন্ন-বস্ত্র হাদিয়া দিতেন, তিনি সে দিনই ওইসব মানুষের মাঝে দান করে দিতেন। প্রতিদানের আশা না করে অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করার আদর্শকে সারাজীবন ধারণ করেন তিনি। সবশ্রেণির মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন কোমল, দয়ার্দ্র ও ¯েœহপ্রবণ। বেদনাক্লীষ্ট ও দুঃখী মানুষদের প্রবোধ ও আশার বাণী শোনাতেন তিনি।

ইতিহাসবিদ ইয়াকুত হামুভী লিখিত মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, খাজা বখতিয়ার কাকী রহ. মধ্যএশিয়ার পরগনার আউশ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কামালুদ্দীন। তাঁর দেড় বছর বয়সে বাবা ইন্তেকাল করলে মা তাঁকে লালন-পালন করেন। পাঁচ বছরে উন্নীত হলে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শাইখ আবু হিফস আউশীর কাছে পাঠান। পবিত্র কুরআন হিফয শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ গমন করেন। সেখানকার বড় বড় আলিমের কাছে তিনি কুরআন, হাদিস ও ফিকহে ইসলামীর ওপর পড়াশোনা করে ইলমে জাহেরিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. সফরের এক পর্যায়ে যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার রহ. তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। অতঃপর ২০ বছর যাবত তিনি তাঁর মুর্শিদে কামিলের সাহচর্যে অবস্থান করে আত্মশুদ্ধি অনুশীলনে ব্যাপৃত থাকেন। পবিত্র হজব্রতও তাঁর সাথে পালন করেন। বাগদাদে ফকিহ আবুল লাইছ সমরকন্দীর বরকতময় মসজিদে বহু বিখ্যাত আলিম ও শায়খদের উপস্থিতিতে হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. তাঁকে খিলাফত প্রদান করেন এবং সাথে করে দিল্লী নিয়ে আসেন (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, তারিখে দাওয়াত ওয়া আযীমত, ৩খÐ, করাচী, ১৯৮৩, পৃ.৩১)।

মুুর্শিদ হযরত খাজা মইনুদ্দীন চিশতি রহ. কর্তৃক তাঁকে দিল্লী আসার নির্দেশ প্রদানের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দিল্লী ছিল মুসলমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। প্রথমত, ভারতে ইসলামের সঠিক বাণী ও আদর্শ প্রচারের প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, শান্তি ও উদারতার নীতি অবলম্বন করে হিন্দুসমাজকে তাওহীদের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব সর্বোপরি রূহানী জিন্দেগীর দাওয়াত পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিল। এ দু’বুযুর্গের দ্বারা চিশতীয়া তরিকার মাধ্যমে হিন্দুদের সাথে সহনশীলতা ও উদারতার এক বৈপ্লবিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং ¯েœহ-মমতা ও ন¤্রতার দ্বারা তাদের হৃদয় জয় করা সম্ভব হয় (ড. আবদুল জলীল, ইসলামী বিশ্বকোষ, ৮ম খÐ, পৃ.৩১৬)।

দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ খাজা বখতিয়ার কাকী রহ.-কে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতেন। তিনি সপ্তাহে দু’বার খাজা সাহেবের খানাকায় যেতেন। সুলতান ইলতুৎমিশ খাজা কাকী রহ.-কে বহু ধনসম্পদ ও জায়গীর দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। মালিক ইযযুদ্দীনের মসজিদের পাশে একটি ছোট্ট খানাকা তৈরি করে ইবাদতে মশগুল থাকতেন তিনি। দরবেশী ও অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর পছন্দ। দিল্লীর সর্বস্তরের মানুষ সর্বদা তাঁর খানাকায় ভিড় জমাতে থাকায় তৎকালীন শায়খুল ইসলাম শায়খ নাজমুদ্দীন ছোগরা রহ. মনোকষ্টে ভোগেন। হযরত খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. আজমীর থেকে দিল্লী তাশরিফ আনলে শায়খ নাজমুদ্দীন ছোগরা রহ. তাঁকে খাজা কাকী রহ.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. তাঁর শিষ্য খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.-কে বলেন, ‘বাবা বখতিয়ার, এত তাড়াতাড়ি তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করেছ, আল্লাহর বান্দাদের মনে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি হয়েছে। দিল্লী ছেড়ে চলে এসো। আজমীর থাকো। তোমার খিদমতের জন্য আমি প্রস্তুত থাকবো।’ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. বলেন, ‘হে আমার শায়খ, আপনার সামনে বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোর যোগ্যতাও আমার নেই’ (তারিখে ফেরেশতা, ২খÐ, পৃ.১৯,৭২০; সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ৫৪)।

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ. আপন মুর্শিদের সাথে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দিল্লীর হাজার হাজার ভক্ত অনুরক্ত তাঁর পেছনে পেছনে জমায়েত হতে থাকেন। সুলতান ইলতুৎমিশও যাত্রায় শরিক হন। বখতিয়ার কাকী রহ.-এর কদম যেখানে পড়ছে সাধারণ মানুষ সেখানকার মাটি তুলে নিচ্ছেন বরকত মনে করে। চারদিকে বিদায়ের বিষাদে কান্নার রোলÑ এ অবস্থা দেখে খাজা মইনউদ্দীন চিশতি রহ. বলেন, ‘বাবা বখতিয়ার, তোমার বিদায়ে এতগুলো মানুষের অন্তরে কষ্ট দেখে আমি অভিভূত। তাঁদের মনে কষ্ট দিয়ে তোমাকে আজমীর নিয়ে যাওয়া আমি জায়েয মনে করি না। যাও দিল্লী শহর তোমার যিম্মায় দিয়ে দিলাম। আমি আজমীর চললাম’ (সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ৫৫)।

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ইরান-ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে
নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
আরও

আরও পড়ুন

জুলাই গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট কামালের ফাঁসির রায়

জুলাই গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট কামালের ফাঁসির রায়

মামলার রায়ে দেশবাসীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে : শামসুজ্জামান দুদু

মামলার রায়ে দেশবাসীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে : শামসুজ্জামান দুদু

খুলনায় শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপ

খুলনায় শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপ

জুলাই গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফাঁসির রায়

জুলাই গণহত্যার দায়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফাঁসির রায়

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে : ট্রাইব্যুনাল

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে : ট্রাইব্যুনাল

কুড়িগ্রামে আইডিইবির ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

কুড়িগ্রামে আইডিইবির ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ালো, ডান-বামের তীব্র লড়াই

চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ালো, ডান-বামের তীব্র লড়াই

ন্যায়বিচারই জাতিকে ট্রমা থেকে মুক্তি দিতে পারে: ফারুকী

ন্যায়বিচারই জাতিকে ট্রমা থেকে মুক্তি দিতে পারে: ফারুকী

ঝিনাইদহের মাহাবুব হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

ঝিনাইদহের মাহাবুব হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও  ভাইরাল

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও  ভাইরাল

নির্বাচন ভণ্ডুল করতে কিছু মহল উঠে পড়ে লেগেছে: সালাহউদ্দিন আহমেদ

নির্বাচন ভণ্ডুল করতে কিছু মহল উঠে পড়ে লেগেছে: সালাহউদ্দিন আহমেদ

রাজধানীতে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২৫ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার

রাজধানীতে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২৫ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার

৩২ নম্বরে বুলডোজার নিয়ে যাওয়া দলকে ‘রাজাকার’ আখ্যা ফ্যাসিস্ট দোসর শাওনের

৩২ নম্বরে বুলডোজার নিয়ে যাওয়া দলকে ‘রাজাকার’ আখ্যা ফ্যাসিস্ট দোসর শাওনের

ট্রাম্পের চাপের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় এলপিজি চুক্তি করল ভারত

ট্রাম্পের চাপের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় এলপিজি চুক্তি করল ভারত

শহর জনবহুল, কিন্তু পাবলিক টয়লেট অপ্রতুল

শহর জনবহুল, কিন্তু পাবলিক টয়লেট অপ্রতুল

ট্রাম্পের নীতিতে নিরাপদ নয় বৈধভাবে স্থায়ী অভিবাসীরাও

ট্রাম্পের নীতিতে নিরাপদ নয় বৈধভাবে স্থায়ী অভিবাসীরাও

জকসু নির্বাচন: ছাত্রদল ও ছাত্রঅধিকার মিলে ‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেল ঘোষণা

জকসু নির্বাচন: ছাত্রদল ও ছাত্রঅধিকার মিলে ‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেল ঘোষণা

সিংগাইরে অগ্নিকান্ডে ইসলামী ব্যাংক আংশিক পুড়ে ছাই

সিংগাইরে অগ্নিকান্ডে ইসলামী ব্যাংক আংশিক পুড়ে ছাই

আওয়ামী লীগের নাশকতা প্রতিহত করা হবে: মোঃ খোরশেদ আলম

আওয়ামী লীগের নাশকতা প্রতিহত করা হবে: মোঃ খোরশেদ আলম

ধানমন্ডি-৩২ ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার আহ্বান রাকসুর জিএস সালাউদ্দিনের

ধানমন্ডি-৩২ ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার আহ্বান রাকসুর জিএস সালাউদ্দিনের