মব জাস্টিস : নিষ্ঠুরতার এক নৃশংস চিত্র, প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:২৮ পিএম
বাংলাদেশে মব জাস্টিসবা জনতার বিচার একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। মব জাস্টিসের প্রধান কারন আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস। দির্ঘদিন যাবত অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না পাওয়ায় মানুসের মধ্যে এই আইন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস, অনাস্থার তৈরি হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ বিস্তারও এর অন্যতম কারন। অনেক সময় সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে পরার পর যখন ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় তখন মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে এবং কোন কোন সময় হত্যা পর্যন্ত ঘটে। কিন্তু এই ধরনের স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়া কতটা নিষ্ঠুর, ভয়ংকর তা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার উপর নজরপাত করলেই বুঝা যায় এবং এর ভয়াবহতা কত দূর গড়িয়েছে।
মব জাস্টিস: সংজ্ঞা ও কারণ
মব জাস্টিসহল জনগণের দ্বারা কোনো অপরাধীকে ধরে নিজের হাতে আইন চালিয়ে দেওয়া। সাধারণত কোনো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়। এই ধরনের ঘটনা সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় বেশি দেখা যায়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি কম এবং জনগণের আস্থা আইন ব্যবস্থার প্রতি কম থাকে।
বাংলাদেশে মব জাস্টিসের উদাহরণ
বাংলাদেশে মব জাস্টিসের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এই ধরনের ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে।মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান মতে চলতি বছরের, প্রথম চার মাসে ২৪ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলাও হয়েছে।
রেণু হত্যাকাণ্ড:
গণপিটুনিতে নির্দয় হত্যাকাণ্ডের বড় উদাহরণ রেনু হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারীকে। ওই সময়টায় ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পরেছিল। ২০১৮ সালে রেণু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনার বিচার এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই ঘটনাটি মব জাস্টিসের নৃশংসতার একটি উদাহরণ। ('মা কখন আসবে না এলে আমি ভাত খাব না' @ https://m.dailyinqilab.com/article/222270/ )
তোফাজ্জল গণহত্যা:
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে তাকে মারধর ও জেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে, তাকে নিয়ে হল ক্যানটিনে খাওয়ানো হয়। এরপর এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বুক, পিঠ, হাত ও পায়ে ব্যাপক মারধর করেন একদল শিক্ষার্থী। (তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যা, ঢাবির ৮ শিক্ষার্থী বহিষ্কার @ dailyinqilab.com/motropolis/news/688017)
যাত্রবাড়িতে গণপিটুনিতে দুই কিশোর নিহত:
১৪ আগস্ট ২০২৪ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে সাঈদ আরাফাত শরীফ (২০) ও সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন (১৯) নামে দুই যুবককে গণধোলাই দেওয়া । পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা শেষে তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
উপরের তিনটি গণপিটুনি, মব জাস্টিসের ঘটনাই ছিল নৃশংস এবং ভয়াবহ। শুধু তাই নয় তিনটি ঘটনাই ঘটেছে নিছক গুজব এবং ভয়ানক মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আরো তৎপর হতে হবে। দেশে গত দুই মাসে ৩৩ জনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। (গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যুঃ ( dailyinqilab.com/national/news/687718 ) আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানটিমব জাস্টিসের ভয়াবহতার একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। এছাড়াও মব জাস্টিসের শিকার হওয়ার বেশী ঝুঁকিতে তাখেন নারী, পাগল, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সহ অনেকেই। এমনকি এর স্বীকার আমি আপনিও হতে পারি।
মব জাস্টিসের অনেকগুলো নেতিবাচক দিক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নিরপরাধী মানুষ মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। মব জাস্টিসএক প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘন। এছাড়াও মব জাস্টিসসামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
মব জাস্টিসপ্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার
তথ্য-প্রযুক্তির অন্ধকার দিক: গুজবের বিপ্লবতথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবসভ্যতাকে বহুগুণে এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এই অগ্রগতির ছায়ায় লুকিয়ে রয়েছে গুজব ও ভুল তথ্যের একটি বিপজ্জনক দিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ বিস্তারের ফলে মিথ্যা তথ্য মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।আজকাল স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করে। এই গুজব প্রায়শই মব জাস্টিসের মতো ভয়াবহ পরিণতি ঘটিয়ে থাকে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাহত করে।
মব জাস্টিস: গুজবের এক ভয়াবহ পরিণতিগুজবের ফলে সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হল মব জাস্টিস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ঘটনা ভাইরাল হওয়ার সাথে সাথে জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং অভিযুক্তকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়। অনেক সময় নিরপরাধ মানুষও এই গণপিটুনির শিকার হয়। মব জাস্টিসআইনের শাসনকে দুর্বল করে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। কোনো তথ্য বা খবর শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করার পদ্ধতি
গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই
গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে মিলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
• সরকারের ভূমিকা: সরকারকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আইন প্রয়োগ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
• শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা শক্তি বিকাশ করতে হবে। তাদেরকে সত্য ও মিথ্যা আলাদা করতে শিখাতে হবে।
• সাংবাদিকতার ভূমিকা: সাংবাদিকদের সত্য সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
• সাধারণ মানুষের ভূমিকা: সাধারণ মানুষকে কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে।
মব জাস্টিসএকটি জরুরি সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামাজিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে মিলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেই আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে পারব। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে গুজবের বিপদ অনেক বেড়ে গেছে। এই বিপদের মোকাবিলা করতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে এবং মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই আমরা একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গড়তে পারব।
লেখক- আইসিটি বিশেষজ্ঞ
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়